আবার শুরু? প্রস্তুতি কোথায়?
২৮ মে ২০২০ ২১:২৪
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম রোগী শনাক্ত হয়েছিল মার্চের ৮ তারিখ। আর প্রথম মারা যাওয়ার ঘোষণা করা হয় মার্চের ১৮ তারিখে। সরকারিভাবে মার্চের ২৬ তারিখে সাধারণ ছুটি ঘোষণা দেওয়া হয় যা দফায় দফায় বাড়িয়ে চলতি মে মাসের ৩০ তারিখ পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২৬ এপ্রিল থেকে গার্মেন্টস শিল্প-প্রতিষ্ঠান চালু করার অনুমতি দেওয়া হয়, ঈদকে মাথায় রেখে দোকানপাটও খুলে দেওয়ার ঘোষণা হয়। মসজিদ ও অন্যান্য উপাসনাস্থলে মানুষের যাতায়াতের অনুমতি দেওয়া হয় রমজান ও ঈদকে মাথায় রেখে।
বাংলাদেশে ২৮ মে পর্যন্ত সরকারিভাবে করোনাভাইরাসের মোট রোগী রিপোর্ট করা হয়েছে ৪০ হাজার ৩২১ জন। এ সময় পর্যন্ত মারা যাওয়ার সংখ্যা ৫৫৯ জন। সুস্থ হয়েছেন বা হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেওয়া হয়েছে ৮ হাজার ৪২৫ জনকে। মোট পরীক্ষা করা হয়েছে ২ লাখ ৭৫ হাজার ৮১৯ জনকে যা দেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ০.১৭%। যেহেতু মোট পরীক্ষার সংখ্যা মোট জনসংখ্যার তুলনায় খুবই নগণ্য, তাই মোট কতজন পজিটিভ শনাক্ত হয়েছেন তা আমাদের অবস্থা সম্পর্কে খুব সঠিক চিত্র দেখায় না। বরং কিছুটা ভালো ধারনা পাওয়া যাবে যদি আমরা কত শতাংশ মানুষের পরীক্ষায় পজিটিভ এসেছে তার একটা ট্রেন্ড দেখি। গত ৩ সপ্তাহের তথ্যের গ্রাফ (তথ্য https://www.iedcr.gov.bd/ থেকে নেওয়া) ঊর্ধ্বমুখী একটি চিত্র দেয়। তথ্যগুলোর লিনিয়ার প্রজেকশন দেখায় যে, সামনে গ্রাফটি আরও উপরের দিকেই যাবে।
চিত্র: পরীক্ষার তুলনায় কোভিড-১৯ পজিটিভ প্রাপ্তির সংখ্যা (শতাংশে) এবং লিনিয়ার প্রজেকশন (লাল বিন্দু বিন্দু দাগ)
এই পরিস্থিতিতে সরকার সাধারণ ছুটি ৩০ মের পরে আর না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত আড়াই মাসে এটা পরিষ্কার যে বাংলাদেশের এক বৃহৎ জনগোষ্ঠী কোভিড এর কারণে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে পড়েছেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় তা উঠে এসেছে। আর্থিকভাবে শক্তিশালী অনেক দেশের মত বাংলাদেশ সরকারের বেশি সময় ধরে এই জনগোষ্ঠীকে সাহায্য করে যাওয়ার সক্ষমতা নেই। যদিও সরকার বিশাল আকারের আর্থিক প্রণোদনা আর সাহায্যের ঘোষণা দিয়েছে এবং তার কিছু কিছু বাস্তবায়নও হচ্ছে।
কিন্তু প্রস্তুতি আর সঠিক প্রচারণা এবং নির্দেশনার কঠোর প্রয়োগ না করতে পারলে আমাদের দ্বিতীয়বারের মত লকডাউনে যেতে হতে পারে যার অর্থনৈতিক পরিণতি হবে আরও বেশি ভয়াবহ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দ্বিতীয় ওয়েভ আসার ব্যাপারে কয়েকদিন আগেই সব দেশকে সতর্ক করেছে। প্রস্তুতি, প্রচারণা আর নির্দেশনার কঠোর প্রয়োগ ছাড়া অনেক বেশি মানুষ আক্রান্ত হবেন আর মারা যাবেন, এই আশংকা তো আছেই; স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরলস ও অক্লান্ত প্রচেষ্টার পরও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়তে পারে। এটি ঠেকানোর জন্য ন্যূনতম এই কাজগুলো করা উচিৎ বলে মনে করি:
• সরকারি স্বাস্থ্যবিধি কী কী, তা গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, সরাসরি প্রচারের মাধ্যমে নিশ্চিত করা যেন সবাই বিস্তারিত জানতে পারে। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে সমন্বয়হীন কিছু নির্দেশনা কোনভাবেই যথেষ্ট নয়। কারণ অধিকাংশ মানুষের কাছে এসব পৌঁছায় না, দেখলেও মানুষ পড়ে না।
• সীমিত আকার বলতে কী বোঝায় তা সঠিক ও বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা দরকার। অফিস-আদালত, কলকারখানায়, ইনফরমাল ইকোনমির ক্ষেত্রে সীমিত আকার কী হবে তা বিস্তারিত জানানো প্রয়োজন। সরকারি বক্তব্যে সীমিত আকারের কথা এসেছে বারবার, কিন্তু বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাস্তবিকভাবে সীমিত আকারে কার্যক্রম কীভাবে চলবে তার নির্দেশনা, প্রচার ও বাস্তবায়ন নেই।
• প্রশাসন ও পুলিশের মাধ্যমে নির্দেশনাগুলোর কঠোর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। কঠোর বাস্তবায়ন মানে কারো জন্য এটি প্রযোজ্য, কারো জন্য নয়– এমনটা যাতে না হয়।
• প্রত্যেক জেলা-উপজেলায় এবং বড় শহরে মানুষের জন্য সুবিধাজনক জায়গায় কোভিড-১৯ টেস্ট করার সুব্যবস্থা করা প্রয়োজন। বিশেষ করে অফিস, কলকারখানা যেখানে জনসমাগম বেশি, সেখানে মোবাইল স্যাম্পল কালেকশনের ব্যবস্থা করা উচিত।
• টেস্টে পজিটিভ আসা রোগীদের কঠোরভাবে আইসোলেশন নিশ্চিত করা, তাদের বাড়িতে নয়, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে। যারা তাদের সংস্পর্শে এসেছে, তাদের কোয়ারেনটাইনে কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করা এবং কারও করোনাভাইরাসের লক্ষণ দেখা দিলে আইসোলেশনে নেওয়া।
• যেসব আক্রান্ত রোগীর অবস্থার অবনতি হবে তাদের হাসপাতালে ভর্তির মাধ্যমে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। সরকার সব হাসপাতালে করোনাভাইরাস চিকিৎসার নির্দেশনা দিয়েছে, কিন্তু অন্য রোগীদের থেকে কীভাবে হাসপাতালে আলাদাভাবে পরীক্ষা হবে, কোভিড-১৯ রোগীরা কীভাবে আলাদা থাকবেন তা নিশ্চিত করা হচ্ছে না।
• মাস্ক, সাবান, স্যানিটাইজারের সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। সকল অফিস-আদালত-কলকারখানা-উন্মুক্ত স্থানে এসবের সহজ প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে।
• স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা সামগ্রী যেমন এন-৯৫ বা সমমানের মাস্ক, ফেস শিল্ড, গ্লাভসের সরবরাহ নিশ্চিত করা।
• লোকসমাগম হয় এমন স্থানগুলো প্রতিদিন নিয়মিত জীবাণুমুক্ত করার ব্যবস্থা করতে হবে।
এসব বাস্তবায়ন করতে যদি আরও এক সপ্তাহ বা ১০ দিন অতিরিক্ত প্রস্তুতি লাগে, তবে তা নিশ্চিত করেই সব খোলার ব্যবস্থা করা উচিত হবে। মানুষ তাদের ব্যক্তিগত ব্যবস্থা করার জন্যও সময় ও সুযোগ পাবে। সম্ভাব্য দ্বিতীয় লকডাউনের ধাক্কা বাংলাদেশের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি করে দিতে পারে, যা আমাদের গত দুই-তিন দশকের অর্জনকে ধূলিসাৎ করে দেবে। বিভিন্ন প্রেসার গ্রুপের কারণে সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং সেই সিদ্ধান্তগুলো আবার বদলে যাওয়ায় আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। লকডাউন না বলে ছুটি ঘোষণা, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতা, গার্মেন্টস খোলা রাখার জন্য কয়েকবারের চেষ্টা এবং অনেক শ্রমিকের বারবার ঢাকায় আসা-যাওয়াতে বাধ্য করানো, ঈদে গণপরিবহন বন্ধ রেখে প্রাইভেট গাড়ি চলার অনুমতি দেওয়া, মানুষের অসচেতনতা দূর করার কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া– এই ভুলগুলো যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। কিন্তু আরেকবার যদি আমরা সমন্বয় ও পরিকল্পনা ছাড়াই সব খুলে দেওয়ার পথে থাকি, তবে তার সম্ভাব্য ফল ভোগের ক্ষমতা আমাদের আছে কি না সন্দেহ হয়।
লেখক: সাদরুদ্দীন ইমরান, আন্তর্জাতিক গবেষণা ও প্রকল্প বাস্তবায়ন সংস্থা ইনোভিশন কন্সাল্টিং এর চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী