Sunday 29 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

করোনাকালীন ত্রাণ: সঠিক ব্যবস্থাপনায় বাঁচবে কৃষক, মিলবে পুষ্টিমান


২৯ মে ২০২০ ১১:২৬

খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করার সুবাদে করোনাকালীন দুর্যোগে ত্রাণ সহায়তা কার্যক্রমগুলো কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। সৌভাগ্য হয়েছে সীমিত আকারে সশরীরে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার কাজে জড়িত থাকার। সে কারণেই কিনা সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে, উন্নয়ন সংস্থা, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তি উদ্যোগ; সবখানেই সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আন্তরিকতার কমতি খুঁজে পাইনি। কিন্তু ঘাটতি অন্যখানে; ত্রাণের খাদ্যতালিকায়। সহায়তা হিসেবে দেওয়া খাদ্যসামগ্রীতে পুষ্টির ঘাটতি চোখে পড়ার মতো। অথচ চাইলেই সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পুষ্টি ব্যবস্থাপনা বিনির্মাণ করা যায়, পাশাপাশি এর মাধ্যমে প্রান্তিক কৃষক ও খামারিদের পাশে দাঁড়ানো যায়।

বিজ্ঞাপন

ত্রাণের খাদ্যসামগ্রীতে পুষ্টিমান সঠিক আছে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ ছিল স্বয়ং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়েরও। যে কারণে গত ১২ মার্চ জাতীয় পুষ্টি কাউন্সিলের মহাপরিচালক ডা. মো. খলিলুর রহমানকে সভাপতি করে খাদ্য ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে ১১ সদস্যের একটি কারিগরি কমিটি গঠন করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এই কমিটির প্রতিবেদনে আনুষ্ঠানিকভাবে ত্রাণ হিসেবে দেওয়া খাদ্যসামগ্রীতে পুষ্টি সঙ্কটের বিষয়টি উঠে আসে। প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে করোনাকালীন ত্রাণের খাদ্যসামগ্রীতে আন্তর্জাতিক গাইডলাইন অনুযায়ী পুষ্টিমান নেই। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক গাইডলাইনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে, দুর্যোগকালীন খাদ্য সরবরাহ থেকে প্রতিদিন একজন ব্যক্তির জন্য ২ হাজার ১০০ কিলোক্যালরি শক্তির প্রয়োজন। যার মধ্যে ১০-১৫ শতাংশ আসতে হবে আমিষ থেকে, ১৭-৩০ শতাংশ আসতে হবে চর্বি থেকে। অথচ সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ত্রাণ প্যাকেজে যেসব খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ করা হচ্ছে, তাতে আছে মোটাদাগে ১ হাজার ৭১১ কিলোক্যালরি। যেখানে ১৭.৬ শতাংশ তেল ও ৭.৮ শতাংশ আসে প্রোটিন থেকে।

বিজ্ঞাপন

আমরা দেখেছি, করোনাকালীন খাদ্য সহায়তার তালিকায় থাকছে চাল, ডাল, পেঁয়াজ, আলু, চিনি, লবণ, তেল। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কমিটির পক্ষ থেকে এসব সামগ্রীতে পরিবর্তন আনার সুপারিশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, দুর্যোগকালীন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে তাৎক্ষণিক পুষ্টি চাহিদা পূরণে ন্যূনতম দুই থেকে তিনদিনের শুকনো খাবার দেয়া প্রয়োজন। এছাড়া চাল, ডাল, পেঁয়াজ, আলুর পাশাপাশি ভিটামিন ও মিনারেলযুক্ত শাকসবজি, ফলমূল, মাছ, মাংস যুক্ত করার। সরাসরিভাবে সম্ভব না হলে এগুলো কেনার জন্য নগদ অর্থ সহায়তা দেওয়ার।

এখন প্রশ্ন হলো, পুষ্টিমান কেন জরুরী? জনসংখ্যার দিক থেকে অতিকায় বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এমনিতেই পুষ্টি সচেতন নয়। সেদিক থেকে এমন দুর্যোগকালীন সময়ে যখন অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটছে, তখন জীবন বাঁচানোর লড়াইয়ে পুষ্টি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। এমনিতেই বাংলাদেশের নারীরা জেনে বা না জেনে অপুষ্টিহীনতায় ভুগে থাকেন। এই মুহূর্তে দেশের ৬০ ভাগ নারী কোন না কোনভাবে অপুষ্টিজনিত স্বাস্থ্য জটিলতায় ভুগছেন। প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীদের মধ্যে রক্তশূন্যতায় ভোগার পরিমাণও বাড়ছে। দেশজুড়ে এর অংক শতকরা ৪৪ শতাংশ।

২০১৯ সালে বাংলাদেশ সরকার এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) যৌথভাবে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যেখানে উঠে আসে, বাংলাদেশের প্রতি ৮ জনের মধ্যে ১ জনের পুষ্টিকর খাবার কেনার সামর্থ্য নেই। আর সুষম খাবার কেনার সামর্থ্য নেই অর্ধেকের বেশি মানুষের। অর্থাৎ পুষ্টিহীনতা বাংলাদেশের জন্য পুরনো অভিশাপ।

ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বছরে দেশের ৮ শতাংশ খাদ্য অপচয় হয়। তাতে একদিকে যেমন অপুষ্টিজনিত সমস্যা বাড়ছে, তেমনই বাড়ছে স্থুলকায় মানুষের সংখ্যা। ২০০৪ সাল থেকে দেশে ১৫-৪৯ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে স্থুলকায় ছিলেন ৯ শতাংশ, যা এখন ২৪ শতাংশ ছাড়িয়েছে। আর্থিক সামর্থ্য বেড়ে যাওয়ায় মিষ্টি ও মিষ্টি জাতীয় খাবার বেশি খাচ্ছেন তারা। ফলে স্থুলকায়ের সংখ্যা বাড়ছে, পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না।

সবকিছু মিলিয়েই চলমান করোনা সঙ্কটে খাদ্য নিরাপত্তা যখন হুমকির মুখে পড়ছে, তখন সব পক্ষের একান্ত প্রচেষ্টায় খাদ্য সহায়তা দেওয়ার মাত্রাও বাড়ছে। এমন অবস্থায় সাধারণ সময়ের চেয়ে বর্তমান সঙ্কটে পুষ্টিহীনতার পরিধি নিঃসন্দেহে বাড়ছে। যা দীর্ঘ প্রচেষ্টার স্বাস্থ্যবিষয়ক সাফল্যের ফলগুলোকে উল্টো পথে হাঁটতে বাধ্য করবে।

অন্যদিকে সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকায় টানা লকডাউনে কৃষকের উৎপাদিত কৃষিপণ্য ক্ষেতেই নষ্ট হচ্ছে। কিংবা বাজার পর্যন্ত নিয়ে আসলেও পরিবহন সঙ্কটের কারণে ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন কৃষক, যা আগামী আবাদের উপর বড় ধরণের প্রভাব ফেলতে পারে।

সম্প্রতি কৃষি বাজেট নিয়ে আমরা একটি অনলাইন সেমিনারের আয়োজন করেছিলাম। সেখানে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব উপস্থিত ছিলেন। তিনি নিজেও চলমান সঙ্কটে কৃষকদের এই ন্যায্যমূল্য না পাওয়া নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন। তার বক্তব্যে কৃষকদের জন্য কাজ করতে গিয়ে নানান বাঁধা ও বিপত্তির কথা উঠে আসে। সেমিনারে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হচ্ছেন সবজি চাষিরা। এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে কৃষিপণ্য পরিবহনে এরই মধ্যে বিআরটিসি ও ডাক বিভাগের গাড়িগুলো ব্যবহারের প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে।

তবে ‘প্রস্তাবনা’ শব্দটা বেশ সময়সাপেক্ষ। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় প্রস্তাবনা ও বাস্তবায়নের মাঝে যে সময় প্রয়োজন, তা এখন আছে বলে মনে হয় না। সে কারণেই ত্রাণের পুষ্টিমান বৃদ্ধিতে কৃষকের উৎপাদিত সবজি যুক্ত করা যেতে পারে। উপরেই উল্লেখ করেছি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কমিটি ত্রাণের খাদ্য সামগ্রীতে শাকসবজি, ফলমূল, দুধ ইত্যাদি যুক্ত করার কথা বলেছেন। কিন্তু তারা যখন এই সুপারিশ করছেন, প্রান্তিক কৃষক তখন চার টাকা কেজিতে মরিচ বিক্রি করছেন, কখনও তিন টাকা কেজিতে শসা, আড়াই টাকা কেজিতে করলা। অথচ এই সময়ে গ্রীষ্মকালীন সবজিতে বাজার ছেয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কৃষকের মুখে হাসি ফোঁটার কথা ছিল। কিন্তু হচ্ছে তার উল্টো। দাম না থাকায় ক্ষতির পরিমাণ এতো বেশি হচ্ছে যে কৃষকরা ক্ষেত থেকে সবজিই ওঠাচ্ছেন না। অর্থাৎ ক্ষেতেই পচে নষ্ট হচ্ছে সবজি। পাশাপাশি পরিবহন সঙ্কট তো রয়েছেই। এমন অবস্থায় যদি সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে কৃষকদের কাছ থেকে এসব সবজি সঠিক দামে কিনে ত্রাণের প্যাকেজে অন্তর্ভুক্ত করা যেতো, তাহলে কৃষকরা উপকৃত হতেন।

আমরা সবাই দেখেছি, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিসরে ‘সেনাবাহিনীর এক মিনিটের বাজার’ কতটা জনপ্রিয় হয়েছে। বেশ কিছু উন্নয়ন সংস্থা কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি সবজি ও ফসল কিনে নিজেদের ত্রাণ কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করছে। কিন্তু সারা দেশের হিসেবে তা নিতান্তই ক্ষুদ্র। পুরো ত্রাণ ব্যবস্থাপনাকে এর আওতায় আনতে সরকারি উদ্যোগের বিকল্প নেই। মাছ, মাংস কিনতে নগদ অর্থের প্রয়োজন, কারণ সংরক্ষণের বিষয় আছে। কিন্তু শাকসবজির বেশিরভাগই সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ত্রাণের খাদ্য সামগ্রীতে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব। তাহলে সবজি চাষিরা কিছুটা হলেও সুফল পাবেন, দেশ তার নাগরিকের খাদ্য তালিকায় পৌঁছে দিতে পারবে সুষম খাদ্য।

তবে শুধু সবজি নয়। নজর দিতে হবে পোল্ট্রি ও দুগ্ধখাতেও। করোনার কারণে মার্চের শেষদিক থেকে বড় ধরণের সঙ্কটের মুখে পড়ে এই দুটি খাত। বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) এর তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন দেশে ৩ হাজার ২৭ টন মুরগির মাংস উৎপাদিত হয়, চলমান সঙ্কটে যার ৭০ শতাংশ অবিক্রিত থেকে যাচ্ছে। ফলে ক্ষতি হচ্ছে দৈনিক ২১ কোটি টাকা। ডিম উৎপাদিত হচ্ছে দৈনিক ৪ কোটি ৬৬ লাখ, যার ৬০ শতাংশ বিক্রি কমে গেছে। ক্ষতি হচ্ছে প্রায় সোয়া ১৫ কোটি টাকারও বেশি।

বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনস জানাচ্ছে, করোনার দিনগুলোতে প্রতিদিন ১৫০ লাখ লিটার দুধ অবিক্রিত থেকে যাচ্ছে। যার বাজারমূল্য ৫৭ কোটি টাকা।

এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য-অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের হিসেবে, করোনাকালীন সময়ে শস্য উৎপাদন, প্রাণিসম্পদ এবং মৎস্যসম্পদ খাতে দৈনিক ক্ষতির পরিমাণ ২০০ কোটি টাকা!

এই যে বিশাল ক্ষতির খেরো খাতা, তাতে কৃষক, খামারীদের হাহাকারের চিত্র উঠে আসে। উঠে আসে আগামীর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বাস্থ্য সঙ্কট ও খাদ্য অনিরাপত্তা। একইভাবে এই সঙ্কটই আমাদের দেখায় মুক্তির পথ। সরকার চাইলেই নিজস্ব উদ্যোগ ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সমন্বয়ের মাধ্যমে ত্রাণের খাদ্য সামগ্রীতে পরিবর্তন আনার পাশাপাশি কার্যক্রমে নতুনত্ব আনতে পারে। তাতে লকডাউনে ঘরবন্দী হতদরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষ তাদের খাদ্য তালিকায় সঠিক পুষ্টিমান যুক্ত করতে পারবেন, একই সাথে কৃষকদের উৎপাদিত ফসলের ব্যবস্থাপনা নিয়ে যে সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে পুরো দেশ, তার চালচিত্রও বদলে যাবে।

তাছাড়া এরই মধ্যে সরকার আগামী ৩১ মে থেকে সীমিত আকারে গণপরিবহন চলাচলের অনুমতি দিচ্ছে। এই অবস্থায় কৃষকের পণ্য পরিবহনের মাত্রাও বেড়ে যাবে। বাজারে সবজিও উঠবে। অন্যদিকে ত্রাণ কার্যক্রমও চলতে থাকবে। সবকিছু মিলিয়ে সামনে একটা সুযোগ আসছে কৃষক ও পুষ্টি সঙ্কট; উভয়কেই প্রতিরোধের।

সময় এখন সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া ও সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সেগুলো বাস্তবায়নের।

লেখক: যোগাযোগ কর্মকর্তা, খাদ্য নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক (খানি), বাংলাদেশ

করোনাকালীন ত্রাণ ত্রাণের পুষ্টিমান পুষ্টি ঘাটতি পুষ্টি ব্যবস্থাপনা

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর