গ্রামে থাকা একজন করোনারোগীর ‘যুদ্ধের’ অভিজ্ঞতা
১ জুন ২০২০ ১৬:২৮
করোনা (কোভিড-১৯) ভাইরাসের নাম হলেও গ্রামাঞ্চলে এটি একটি আতংকের নাম। মুহুর্তের মধ্যেই এই আতংক ছড়িয়ে পড়ে। একটি শব্দ পজিটিভ যে মুহুর্তের মধ্যে পরিস্থিতি বদলে দিতে পারে তার সাক্ষী আমি। করোনা নিয়ে গ্রামে অবস্থান করায় আমার অভিজ্ঞতাটা অন্যরকম। করোনার পাশাপাশি মানুষের সাথেও যুদ্ধ করতে হয়েছে আমাকে। সবচেয়ে বেশি খারাপ লেগেছে সুস্থ থেকেও ঈদুল ফিতরের নামাজটা পড়তে যেতে পারিনি।
গত ১ মে থেকে হালকা গলা ব্যাথা, জ্বর এবং সাথে লাল লাল হয়ে হাত পা চুলকাচ্ছিল। প্রথম তিনদিন আমার এক ডাক্তার বন্ধুর পরামর্শে ঔষধ খাচ্ছিলাম কিন্তু চুলকানি আর জ্বর সেরে গেলেও গলা ব্যাথা যাচ্ছিলো না। তাই ৪ মে আমি ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট ফেনী সদর হাসপাতালে চলে যাই এবং ‘ফ্লু কর্নারে’ ডাক্তার দেখাই। ডাক্তার আমাকে কিছু ঔষধ ও কোভিড-১৯ টেস্ট করানোর পরামর্শ দেন। ডাক্তারের পরামর্শমতো আমি ঐদিনই নমুনা দিয়ে আসি এবং বাড়িতে এসে ডাক্তারের পরামর্শ মতো ঔষধ খেতে থাকি আর নিজেকে কোয়ারান্টাইনে রাখি। ৩/৪ দিন ঔষধ খাওয়ার পর আমার শরীরে সুস্থতা অনুভব করি।
আমাকে হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছিল যদি রিপোর্ট নেগেটিভ আসে তাহলে জানানো হবে না। তাই ৭/৮ দিন যাওয়ার পর আমি ধরে নিয়েছিলাম আমার রিপোর্ট নেগেটিভ আসবে। কিন্তু না, আমার ধারণা মিথ্যা হলো। ১৩ মে সকালে প্রতিদিনের মতো ঘুমাচ্ছিলাম, হঠাৎ মোবাইলে কল আসার শব্দে ঘুম ভাঙ্গে। ওপাশ থেকে ফেনী সদর হাসপাতালের আরএমও জানালেন আমার কোভিড-১৯ পজিটিভ। মুহুর্তের মধ্যে পরিস্থিতি বদলে গেল। জানালা দিয়ে লক্ষ্য করলাম আমার বাড়ির সামনে লোকজন জড়ো হচ্ছে। আমাকে নিয়ে কথাবার্তা বলছে। পরে জানতে পারি ফেনীর কয়েকটা সংবাদমাধ্যমে আমার ইউনিয়নের নাম দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী করোনা আক্রান্ত লিখে নিউজ করেছে। তাতেই সবাই ধরে নিয়েছে এটা আমি। এরপর একে একে থানা, ক্যান্টেনমেন্ট, ইউএনও অফিসসহ বিভিন্ন যায়গা থেকে কল আসতে থাকে। মজার ব্যপার হলো, অনেকে ফোন করে আমার কাছে জানতে চাচ্ছে আক্রান্ত ব্যক্তিকে আমি চিনি কিনা!
এদিকে এলাকায় শুরু হয় নানা ধরনের গুজব। আমি ঢাকা থেকে ১৯শে মার্চ বাড়িতে আসা সত্ত্বেও কেউ বলছে আমি ঢাকা থেকে ৪/৫ দিন আগে এসেছি আবার কেউ বলছে আমি ঢাকা থেকে এলাকায় করোনা নিয়ে এসেছি। ১৩ মে দুপুরে ডাক্তার এসে আমি এবং আমার আম্মুর করোনা টেস্টের জন্য নমুনা নিয়ে যায় এবং আমাকে হোম আইসোলেশনে থাকার পরামর্শ দিয়ে যায়। তখন ডাক্তার দেখার জন্য আমার বাড়ির সামনে ভীড় জমে যা আমাকে রীতিমতো অবাক করেছে। এবারও গুজব চলে, কেউ বলছে পুলিশ আমাকে ঢাকা নিয়ে গেছে আবার কেউ বলে থানায় নিয়ে গেছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
এদিকে চারদিক থেকে কল আর মেসেজের উত্তর দিতে দিতে শারীরিকভাবে কিছুটা সুস্থ থাকলেও নিজেকে অসুস্থ মনে হচ্ছিল। তবুও সবাইকে যথাসম্ভব বিষয়টা ক্লিয়ার করার চেষ্টা করেছি আমি। যাই হোক, ঐদিন রাতেই স্থানীয় প্রশাসন আমাদের বাড়ির সামনে দুটি লাল পতাকা ঝুলিয়ে বাড়ি লকডাউন করে। ১৩ মে (বুধবার) দিনটা আমার কাছে স্বরণীয় হয়ে থাকবে। নিজেকে মানসিকভাবে অসহায় মনে হচ্ছিল সেদিন। সুস্থ থাকার পরেও নিজেকে অসুস্থ মনে হচ্ছিল।
এই করোনা আমাকে মানুষ চিনতে সহায়তা করেছে। আমার বন্ধু যারা আমার সাথে মিশেছে তাদেরও নানাভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়েছে। যদিও পরে আমার আম্মু এবং বন্ধু সবারই করোনা নেগেটিভ আসে। আমার হোম আইসোলেশনের দ্বিতীয় দিন এক মজার ঘটনা ঘটে, আমার আম্মু পান আনার জন্য এক ছোট ভাইকে দুর থেকে টাকা ছুঁড়ে দেয়। দোকান থেকে পান আনা হয়। পরে জানতে পারি দোকানদার আমার আম্মুর হাতের ছোঁয়া টাকাটা সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলে। তবে আমার এই পরিস্থিতিতে ডাক্তার, আমার শিক্ষক, পুলিশ, আমার সাংবাদিক সহকর্মী, বন্ধু এবং স্থানীয় নেতাদের কাছ থেকে যথেষ্ট সহায়তা পেয়েছি। আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ।
১৩ মে-তে নেয়া নমুনায় ১৫ মে আমার করোনা নেগেটিভ আসে অর্থাৎ করোনা পজিটিভ রেজাল্ট আসার আগেই আমি সুস্থ হয়ে গেছি। আর সুস্থ অবস্থায় লকডাউনসহ মানুষের নানা রূপ দেখেছি আমি। পরবর্তীতে দ্বিতীয় টেস্টের নমুনার ফলাফল নেগেটিভ আসার একদিনের মধ্যে তৃতীয় টেস্ট নেয়া গেলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ট্রান্সপোর্ট সমস্যার কথা দেখিয়ে আমার তৃতীয় নমুনা নেয়া হয় ২০ মে। কিন্তু এখানে বাঁধে আরেক ঝামেলা। ২০ মে নেয়া নমুনার ফলাফল আসে নি। ২৫ মে সদর হাসপাতাল থেকে আমাকে বলা হয় আমার নমুনা সঠিকভাবে নেয়া হয়নি তাই রেজাল্ট আসবে না, আমাকে আবার নমুনা দিতে হবে। আমাকে নমুনা দেয়ার জন্য হাসপাতালে যেতে বলা হয়। এদিকে আমার বাড়ি লকডাউন তাই আমি উনাদেরকে চেয়ারম্যানের অনুমতি নিয়ে দিতে বলি। অবশেষে চেয়ারম্যানের অনুমতি পেয়ে আমি ২৭ মে আবার নমুনা দিয়ে আসি এবং ২৯ মে আমার করোনা নেগেটিভ আসে এবং আমাক সম্পূর্ণ সুস্থ ঘোষণা করা হয়।
আমি মনে করি, এভাবে অধিক সময় টেস্টের জন্য ব্যয় হলে একজন সুস্থ মানুষও মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়বে। আমি সুস্থ থাকার পরও ১৭ দিন ঘরবন্দী থাকতে হলো। ঈদের নামাজটা পড়তে পারলাম না। আর যেন কারো সাথে এমন না হয় এই প্রত্যাশা থাকবে। আমি ৪/৫ দিনেই সহজেই করোনা থেকে সুস্থ হয়েছি। করোনা সুস্থতায় আমার কিছু পরামর্শ হলো-
হোম আইসোলেশন:
আমার পরিবারের সদস্য শুধু আমি এবং আম্মু হওয়ায় আমার জন্য হোম আইসোলেশনটা সহজ ছিল। আমি টেস্ট দেয়ার পর থেকেই একটা রুমে নিজেকে আলাদা করে ফেলি এবং নিজের ব্যবহৃত সবকিছু আলাদা রেখেছিলাম। এবং ডাক্তারের পরামর্শ মতো চলেছি। যার ফলে আমার আম্মু সুস্থ থাকতে পেরেছেন। সুতরাং করোনা আক্রান্ত হলে নিজের পরিবারের স্বার্থে নিজেকে আলাদা করে ফেলুন।
করোনা প্রতিরোধে করণীয়:
করোনা প্রতিরোধে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকা জরুরি। তাই বেশি বেশি প্রোটিন জাতীয় খাবার খেতে হবে। আমি যা করেছিলাম-
১. লবণ মিশ্রিত গরম পানি দিয়ে দিনে ৫/৬ বার গার্গেল করেছি। এছাড়াও খাওয়াসহ সকল কাজে গরম পানি
ব্যবহার করছি।
২. কিছুক্ষণ পর পর লেবু ও আদা চা খেয়েছি।
৩. নিয়মিত দুধ,ডিম, ভিটামিন সি জাতীয় খাবার ও ফলমূল খেয়েছি।
৪. বাসায় শারীরিক ফিটনেসের জন্য কিছু ব্যায়াম করা যেতে পারে
৫. সর্বশেষ ডাক্তারের পরামর্শ মতো চলেছি।
মনোবল শক্ত রাখুন:
করোনার সবচেয়ে বড় চিকিৎসা হলো মনোবল ঠিক রাখা। আশেপাশে মানুষের কথায় কান না দিয়ে ডাক্তারের নির্দেশনা মতো চলুন। চিন্তিত না হয়ে মনোবল ঠিক রাখলে করোনা থেকে সহজেই মুক্তি পাওয়া যায়।
সবশেষে বলবো ,আশপাশে কারো করোনা হলে তাকে মানসিকভাবে সাপোর্ট দিন। করোনা কোন মরণব্যাধি নয়, তাই অকারণে ঘাবড়ে যাবেন না। সচেতন থাকুন, সুস্থ থাকুন।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী ও শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়