কৃষ্ণাঙ্গও মানুষ, তবে বৈষম্য কেন?
৩ জুন ২০২০ ১৩:৩৯
বিশ্বে শুধু একটাই খবর করোনাভাইরাস। গত কয়েক মাস ধরে এই ভাইরাসের ভয়াবহতা লক্ষ্য করছে মানুষ। কিন্তু সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের এক কৃষ্ণাঙ্গ মারা যাওয়ার ঘটনায় তোলপাড় বিশ্ব। এই হত্যাকাণ্ডের জেরে বিভিন্ন দেশ প্রতিবাদ জানিয়েছে। এমনকি এখনো হোয়াইট হাউজের সামনে বিক্ষোভ, প্রতিবাদ চলমান।
গত ২৫ মে মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের মিনিয়েপোলিস শহরে পুলিশ হেফাজতে মারা যান কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েড। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, এক পুলিশ কর্মকর্তা ফ্লয়েডের ঘাড়ের ওপর হাঁটু দিয়ে তাকে মাটিতে চেপে ধরে রেখেছেন। সে সময় ফ্লয়েড বলতে থাকেন, ‘প্লিজ, আমি শ্বাস নিতে পারছি না।’ পরে অ্যাম্বুলেন্সে করে ফ্লয়েডকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকেরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এই ঘটনায় সংশ্লিষ্ট চার পুলিশ সদস্যকে বরখাস্ত করা হয়েছে। চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্য ডেরেক চাওভিনকে নরহত্যার জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছে।
এদিকে পুলিশ হেফাজতে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর ন্যায়বিচারের দাবিতে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। গত সোমবার সপ্তম দিনে ৭৫টির বেশি শহরে বিক্ষোভ হয়। এ সময় ব্যাপক সহিংসতা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। কয়েকটি শহরে পুলিশকে লক্ষ্য করে হামলা হয়েছে। এ অবস্থায় বিক্ষোভকারীদের দমাতে এবং অস্থিরতার অবসানে সেনাবাহিনী নামানোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এদিকে জর্জ ফ্লয়েডের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এটি হত্যাকাণ্ড, শ্বাসরোধের কারণেই তার মৃত্যু হয়েছে।
সহিংস বিক্ষোভ এড়াতে সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের কমপক্ষে ৪০টি শহরে কারফিউ জারি ছিল, কিন্তু বেশির ভাগ শহরে কারফিউ অমান্য করে বিক্ষোভ হয়েছে। নিউ ইয়র্ক শহরে গতকাল মঙ্গলবার স্থানীয় সময় সকাল ৫টা পর্যন্ত লকডাউন জারি রয়েছে। ওয়াশিংটনে আরো দুই রাতের জন্য কারফিউ বাড়ানো হয়েছে। এরপরও কারফিউ ভেঙে বিক্ষোভ করে হাজার হাজার মানুষ। বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভের সময় পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। সেন্ট লুইসে ও লাস ভেগাসে পুলিশের পাঁচ সদস্য গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। নিউ ইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের বাফেলোতে পুলিশের দুই সদস্যের ওপর গাড়ি তুলে দেওয়া হয়েছে। শিকাগোতে বিক্ষোভকালে দুইজন নিহত হয়েছেন। কেন্টাকির লুইসভিলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে এক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন। বিভিন্ন শহরে সহিংসতার সময় শত শত বিক্ষোভকারীকে আটক করা হয়েছে। অন্যদিকে হোয়াইট হাউজের সামনে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছুড়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে বিক্ষোভকারীদের দমন করতে সেনাবাহিনী নামানোর হুমকি দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে তিনি বলেন, ‘অঙ্গরাজ্যগুলো ও শহরের কর্তৃপক্ষ যদি বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয় অথবা ব্যবস্থা নিতে অস্বীকার করে, তাহলে তাদের হয়ে আমিই সমস্যার দ্রুত সমাধান করে দেব।’
তিনি বলেন, ‘আমি ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হাজার হাজার সেনা পাঠাচ্ছি। তারা দাঙ্গা, লুটপাট, ভাঙচুর, হামলা ও সম্পদের যথেচ্ছ ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধ করবে।’
তিনি আরও বলেন, জর্জ ফ্লয়েডের নৃশংস মৃত্যুতে সব মার্কিন নাগরিক বিতৃষ্ণ হয়ে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। কিন্তু ক্ষুব্ধ জনতা তার স্মৃতিকে যেন নষ্ট না করে দেয়।
ট্রাম্প বিক্ষোভকারীদের পেশাদার নৈরাজ্যবাদী বলে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, বিক্ষোভে মদত দিচ্ছে পেশাদার নৈরাজ্যবাদী ও ফ্যাসিবাদবিরোধী গোষ্ঠী অ্যান্টিফা।
অ্যান্টিফা গোষ্ঠীকে তিনি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বিক্ষোভে মদতদানকারীদের গুরুতর অপরাধের জন্য দণ্ড ভোগ করতে হবে বলে হুঁশিয়ার করেন তিনি।
এর আগে ট্রাম্প বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের গভর্নর ও মেয়রদের কঠোর অবস্থানে থাকতে বলেন। তিনি যখন এই বক্তব্য দিচ্ছিলেন, তখন ভেসে আসছিল বিক্ষোভের শব্দ। পুলিশ সে সময় হোয়াইট হাউজের কাছেই একটি পার্কে অবস্থান নেওয়া বিক্ষোভকারীদের টিয়ার গ্যাস ও রাবার বুলেট ছুড়ে সরিয়ে দেয়। রবিবার হোয়াইট হাউজের কাছেই একটি গির্জা পুড়িয়ে দিয়েছিল বিক্ষোভকারীরা।
সোমবার হোয়াইট হাউজের বাইরে থেকে বিক্ষোভকারীদের হটিয়ে দেওয়ার পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পায়ে হেঁটে ক্ষতিগ্রস্ত গির্জা পরিদর্শনে যান। পরে গির্জার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলেন ট্রাম্প। এদিকে ট্রাম্পের সেনা নামানোর ঘোষণায় ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জো বাইডেন বলেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আমেরিকার সেনাদের আমেরিকার জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছেন।’
ট্রাম্পের উদ্দেশ্যে হিউস্টনের পুলিশ প্রধান আর্ট অ্যাকেভেডো বলেছেন, ‘আপনার যদি গঠনমূলক কিছু বলার না থাকে, তাহলে মুখ বন্ধ রাখুন। কারণ, তরুণ ছেলেমেয়েদের আপনি ঝুঁকিতে ফেলছেন। এটা কর্তৃত্ব ফলানোর নয়, মানুষের হূদয় ও মন জয় করার বিষয়। অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে বর্তমানে আমাদের নেতৃত্ব সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। এটা হলিউড নয়, বাস্তব জীবন।’
আমেরিকানদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘দয়া করে পুলিশের সঙ্গেই থাকুন। আপনারা প্রতিবাদ করুন। শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করুন।’
ট্রাম্পের সেনা নামানোর ঘোষণায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মকর্তাও। অন্যদিকে জর্জ ফ্লয়েডের মরদেহের ময়নাতদন্তের পর তার মৃত্যুকে আনুষ্ঠানিকভাবে হত্যাকাণ্ড বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রেফতারের সময় গলায় অতিরিক্ত বল প্রয়োগের কারণে তার হূদ্যন্ত্রে রক্ত চলাচল ব্যাহত হয়ে ‘হার্ট অ্যাটাক’ হয়েছিল।
ওয়াশিংটন পোস্ট সংবাদপত্রের সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে আমেরিকায় পুলিশের গুলিতে মারা গেছে ১০১৪ জন এবং বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, আমেরিকায় পুলিশের গুলিতে নিহতদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে বেশিরভাগই কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান।
ম্যাপিং পুলিশ ভায়োলেন্স নামে একটি বেসরকারি সংস্থার চালানো জরিপে দাবি করা হয়েছে যে, আমেরিকায় পুলিশের গুলিতে শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় তিনগুণ বেশি মারা যায় কৃষ্ণাঙ্গরা। কিন্তু কেন কৃষ্ণাঙ্গরা বেশি মারা যায়। তারাও তো মানুষ। শ্বেতাঙ্গদের যা আছে। একজন কৃষ্ণাঙ্গের তাই আছে। তাহলে বৈষম্য কেন? এই বৈষম্যের ভেদাভেদ ভুলে নতুন দিনের সূচনা হোক এই প্রত্যাশা করি।
দেশটিতে পুলিশি নির্মমতার প্রতিক্রিয়ার ফলশ্রুতিতে গড়ে উঠেছে #BlackLivesMatter (কৃষ্ণাঙ্গদের জীবনও মূল্যবান) নামের আন্দোলন। গায়ক বিয়োন্সে, বাস্কেটবল খেলোয়াড় লেব্রন জেমসের মতো তারকারা এই আন্দোলনকে প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছেন।
লেখক: শিক্ষার্থী ও সংবাদকর্মী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়