Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অতিরিক্ত জিপিএ-৫: শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ভাবনা


৪ জুন ২০২০ ২০:৩২

এসএসসি পরীক্ষায় এ প্লাসের ছড়াছড়ি নিয়ে কথা উঠছে গত কয়েক বছর ধরেই। এটাকে অনেকেই দেখছেন নেতিবাচক দৃষ্টিতে। কিন্তু এটা আসলে নেতিবাচক নয়, যদি মূল্যায়ন ঠিক মতো হয়। সবচেয়ে ভালো দিকটা হলো এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়। ‘আমরা সবাই রাজা আমাদেরই রাজার রাজত্বে’ এমন একটা ভাব তাদের মধ্যে কাজ কর, যা ইতিবাচক। এটা কেনো ভালো তার একটা বাস্তব উদাহরণ দেই। আমি হলাম মেধাতালিকা যুগের ছাত্র। আমাদের সময়ে যাদের নাম পত্রিকায় আসত তাদেরকে কিছু বেসরকারি কলেজ সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ডেকে নিয়ে ভর্তি করাতো। আমি তেমনই একটা কলেজের ছাত্র ছিলাম। তবে সুযোগ সুবিধার চেয়ে আমার ভর্তি হওয়ার পেছনে কারণ ছিল ঐ কলেজের খোলামেলা প্রাকৃতিক পরিবেশ ও বিভিন্ন বোর্ডের মেধা তালিকায় স্থান পাওয়া ছাত্রদের সঙ্গে পড়ার সুযোগ।

বিজ্ঞাপন

যাইহোক, আমাদের সাথে একটা বোর্ডের প্রথম স্থান পাওয়া একজন ছিল। পারিপার্শ্বিক কারনে, সেই সময় যারা মেধা তালিকায় স্থান পেত তারা নিজেদেরকে
একটু আলাদা ভাবতো যা তাদেরকে অহম চর্চার সুযোগ করে দিত। কারও কারও ক্ষেত্রে এমন হতো যে তারা নিজ নিজ অহমের দাস বনে যেত। আমাদের মধ্যে প্রথম স্থান পাওয়া বন্ধুটির অবস্থা প্রায় ওই পর্যায়েরই ছিল। তবে অন্য আরেকটা বোর্ডের তৃতীয় হওয়া একজন ছিল যার অহম চর্চাটা মেনে নেওয়ার মতো ছিল। যেমন, আমরা যখন বিকেলে হোস্টেল থেকে চা খেতে বের হতাম তখন প্রথম হওয়া বন্ধুটি চাইত যে অন্য কেউ তার হাতে চায়ের কাপটা এনে দিয়ে যাক। কিন্তু তৃতীয় স্থানে থাকা বন্ধুটির মধ্যে তা ছিলনা। সে বরং মাঝেমধ্যে আমাদের সবার হাতে চা পৌঁছে দিত। আর তাই সে অল্প সময়েই সবার বন্ধু হয়ে যায়। কিন্তু প্রথম হওয়া বন্ধুটি একা হয়ে যায়। অহমের চর্চায় একা হওয়া সেই প্রথম স্থান পাওয়া বন্ধুটি এইচএসসিতে আর মেধা তালিকায় থাকতে পারেনি। বর্তমানে সেই বন্ধুটি তার মফস্বলে একটা চাকুরি করে। তবে এখনও আমি নিজ থেকে তার খবর রাখি। অন্যদিকে অহমের চর্চায় পিছিয়ে থাকা তৃতীয় স্থান পাওয়া বন্ধুটি এইচএসসিতে দ্বিতীয় স্থানে চলে আসে। বর্তমানে সে প্রথম সারির একটা আন্তর্জাতিক এনজিওর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে বিদেশে কর্মরত আছে। তার সাথে আমার এখনও যোগাযোগ আছে।

বিজ্ঞাপন

আমি যখন লন্ডন ইউসিএলএ পড়তাম, সে তখন এলএসইতে পড়ত। লন্ডনেও আমরা একই বাড়িতে থাকতাম। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমাদের ব্যাচ, আগের ব্যাচ এবং পরের ব্যাচের মেধা তালিকায় স্থান পাওয়া কিছু ছাত্রকে হারিয়ে যেতে দেখেছি শুধু অহমকে নিয়ন্ত্রন করতে না পারার কারণে। এর একটা কারণ হলো এই মেধাবীদের বেশীর ভাগই তার নিজ স্কুলে প্রথম থেকে দশম শ্রেনী পর্যন্ত সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে পেয়ে প্রশংসা কুড়িয়ে আসছিল যা তাদেরকে একটা বিশেষ স্থান দিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেও তারা ঐ সমীহপূর্ণ স্থানটা আশা করত কিন্তু তা না পেয়ে পীড়াবোধ করত। এই অহমের পীড়া তাদেরকে সামনের দিকে নেওয়ার বদলে একা করে দিত ও পিছিয়ে দিত। এখন বেশি জিপিএ পাওয়া ছাত্রদের কারও মধ্যে সেই ধ্বংসাত্মক অহমবোধ থাকার সম্ভাবনা কম। আর তাই বেশি জিপিএ পাওয়া কার্যত ইতিবাচক। আরেকটা কথা হলো যা দুষ্প্রাপ্য নয় তা পাওয়ার জন্য সবাই চেষ্টা করে। আর সবাই ভালো হোক এটা চাওয়া অবশ্যই ইতিবাচক।

এবার আসি শিক্ষা ব্যবস্থার কথায়। বাংলাদেশে জিপিএ পদ্ধতির আমদানিকারক হলো বুয়েট। ১৯৯১ সালে বুয়েটে এ পদ্ধতি চালু হয়েছিল পড়াশোনাকে বিশ্বমানে আনার জন্যই। ২০০১ সালে এসএসসিতে যুক্ত হওয়া এ পদ্ধতিতে প্রথম বছর জিপিএ-৫ পেয়েছিল মাত্র ৭৬ জন। কিন্তু প্রথম বছর যে জিপিএ-৫ এর রেজাল্ট শতকের ঘরেও যেতে পারেনি তা গত কয়েক বছর ধরে লাখ উপচিয়ে যাচ্ছে। এতে আসলে স্বজনরা খুশি হচ্ছেন।

কিন্তু সচেতন নাগরিকগন খুশি হতে পারছেন না। কারণ, জিপিএ-৫ পাওয়া ছাত্রটির লেখাজোখা, কাজকর্ম, কথাবার্তা ও চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে ফলাফলের সামঞ্জস্য পাওয়া যাচ্ছেনা। আর কম জিপিএ-৫ দিয়ে এ ভাবনাটা বন্ধ করলেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে তা কিন্তু নয়। আসল কথা হলো, শিক্ষা ব্যবস্থার কোন বিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের এমন অবস্থার জন্য দায়ী তা খুঁজে বের করতে হবে। যেমন, পাঠ্যক্রম, পাঠদান পদ্ধতি, পরীক্ষা নেয়ার পদ্ধতি, পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন পদ্ধতি, ইত্যাদি নিয়ে ভাবতে হবে। আগের মতো নকল করা ও প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা যাতে আবার ফিরে না আসে তার নিশ্চয়তা দেয়ার পরিবেশও তৈরি করতে হবে। সেই সঙ্গে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি বন্ধ করা অতি জরুরি। কারণ, ভালো শিক্ষক ভালো ছাত্র তৈরির কারিগর। সর্বোপরি ২০১০ সালে যে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়েছে তা কতটা বিশ্বমানের তাও খতিয়ে দেখা দরকার।

মনে রাখা দরকার যে-ভালো ছাত্র না হয়েও ভালো ফল পাওয়ার রীতি- কাজ না করেই পুরস্কার পাওয়ার মতো। এমন চিন্তা থেকেই পরিশ্রম না করেও ফল লাভের চেষ্টার প্রবৃত্তি তৈরী হয়। এটা শিক্ষার্থীর মানসিক বিকাশে খুবই ক্ষতিকর। তাই আগে ভালো ছাত্র বানাতে হবে তারপর ভালো ফল দিতে হবে। লাখ লাখ ভালো ছাত্র লাখ লাখ জিপিএ-৫ পাক তাতে কারও তো কোন সমস্যা নেই, বরং ভালো। পাশাপাশি আত্মহত্যার মতো দুর্ঘটনা দূর করতে শিক্ষার্থীদের মাথায় এই চিন্তাও ঢুকাতে হবে যে এসএসসি’র ফলাফল পরবর্তী জীবনের জন্য অতিশয় দরকারি হলেও, একটা ফলই সব নয়। তাই এমন শিক্ষক ও শিক্ষা ব্যবস্থা দরকার যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মেধা ও মননে নতুন নতুন জানালা খুলবে। আর তা কেনো দরকার তারও ব্যাখ্যা দিচ্ছি আরেকটা বাস্তব উদাহরণ দিয়ে। বর্তমান বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় হার্ভার্ড এর ব্যাচ, ১৯৪০ এর ছাত্র ছিলেন জন এফ কেনেডি ও পিট সিগার। এর মধ্যে পিট সিগার ছিলেন ঝরে পড়াদের একজন আর জন এফ কেনেডি ছিলেন সফল ছাত্র ও পরবর্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। কিন্তু জন এফ কেনেডিকে পৃথিবীর মানুষ যতটা মনে করে পিট সিগারের কথা তার চেয়ে বেশিই বলে। সফল সংগীতজ্ঞ পিট সিগারের “উই শ্যাল ওভার কাম” পৃথিবীর সেরা আত্মবিশ্বাস জাগরণী গান। তার মানে হলো- যার যার রাজ্যে সে সে রাজা। তবে সে রাজ্যটা অবশ্যই বাড়ি-গাড়ি বা কাড়ি কাড়ি টাকার জন্য নয়, নিজ উদ্যোগে নিজের আত্মা ও মানবতার সেবা করার রাজ্য। শিক্ষক ও শিক্ষা ব্যবস্থাকে এমনভাবে সাজাতে হবে যাতে সব শিক্ষার্থীর মননে ও মগজে এমন রাজ্য প্রত্যাশী চিন্তাধারার চাষবাস হয়।

জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ ১৯৮৯ অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচের সবাই শিশু। সেই হিসেবে এসএসসি পর্যায়ের সবাই শিশু। এইসব শিশুদের মধ্যে আলোকিত মনন আনায়নের জন্য একটা সহজ উপায় আছে । বাংলাদেশ শিশু একাডেমিতে শিশুদের বেড়ে ওঠার পরিবেশ কি রকম রাখলে- তার ফলাফল কী হয় তার একটা গাইডলাইন আছে যা মনোবিজ্ঞানী ও স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীদের দ্বারা পরীক্ষিত। যেমন একটা বলি- প্রশংসার মাঝে বেড়ে উঠলে– শিশু মূল্যায়ন করতে শেখে। এমন প্রায় বারোটা আছে। এ গাইডলাইন দেখে দেখে মা-বাবা ও শিক্ষকগন তাদের ছেলেমেয়েদের মনন ও আচরণ গঠনে কাজ করতে পারেন। এর মানে এই নয় যে শুধু শিশুর সঙ্গে এ আচরণ করতে হবে বরং পুরো আশপাশটাকেই বদলে ফেলতে হবে। যেমন বাইরের যে ভদ্রলোক বা ভদ্রমহিলা বাসার কাজে সহযোগিতা করছেন তার সাথে কি আচরণ করা হচ্ছে তা দেখেও শিশু শেখে। তাই সবদিক শিশুবান্ধব করে সাজাতে হবে। এক্ষেত্রে ভালো ফল পাওয়ার জন্য অতি শৈশব থেকেই এসবের চর্চা শুরু করতে হবে। এর কারণ তো সবারই জানা- কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ, পাঁকলে করে ঠাস ঠাস। দেশ বিদেশ ঘুরে এত এত মানুষ আর এত এত মত ও পথ দেখার পর এই বাংলাদেশেই পেয়েছিলাম একজন ক্ষনজন্মা ও খ্যাতিবিমুখ দার্শনিকের দেখা। আর তিনি হলেন দার্শনিক সবুজ শিশির। তিনি বলেছিলেন- একটা সুন্দর প্রজন্ম দেখাতে পারে একটা সুন্দর পৃথিবী গড়ার সিঁড়ি। তাই আমাদের সবার, বিশেষ করে নীতিপ্রণেতাদের উচিত প্রত্যাশিত শিক্ষক ও শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করা। নিশ্চয়তা দিয়ে সুন্দর প্রজন্ম গঠনে হাত দেয়া।

সবার শেষে বলি, শিক্ষার্থীদের মনে রাখতে হবে যে- ভালো ফলাফল এবং ভালো জীবন এ দুটোই নির্ভর করে নিজের ইচ্ছার উপর। আর এর জন্য যা দরকার তা হলো- ১. পরিশ্রম ২. নিয়মানুবর্তিতা ৩. আত্মবিশ্বাস ৪. আন্তরিকতা ও ৫. মেধা। তার মানে মেধার স্থান সবার শেষে। অর্থাৎ, মেধা আমার নাই, আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবেনা তাই, এই ভেবে আর বসে থাকা চলবেনা যে ভাই!

রাশেদ রাফি- জনস্বাস্থ্য ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষক

জিপিএ-৫ রাশেদ রাফি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর