Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সামাজিক দূরত্ব, অন্য রকম এক লড়াই!


৫ জুন ২০২০ ১৬:০০

আমার সংসার, আমার দেশ, আমার পৃথিবী। সুস্থ থাকতে চাই, পরিবারের সদস্যদের সুস্থ রাখতে চাই, প্রতিবেশীকেও! ঘরেই থাকতে চাই। বাইরে গেলে সামাজিক দূরত্ব মানতে চাই। কিন্তু কীভাবে? আমাদের দেশে করোনা ভাইরাস শুরু হওয়ার পর সামাজিক দূরত্ব মানার বিষয়টি নিয়ে অনেক আলোচনা শুরু হয় । অনেকেই সমালোচনাও করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ট্রলও দেখা গেছে। সরকারের পক্ষ থেকে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার জন্য নানা রকম উদ্যোগ নিলেও বাস্তবায়ন তেমন হয়নি বলা চলে। প্রশ্ন আসে কেন সামাজিক যোগাযোগ দূরত্ব নিশ্চিত সম্ভব হয়নি? বর্তমানেই বা হচ্ছেনা কেন? আড়াই যুগ আগের কথা বলছি। বর্তমান গণমাধ্যমে কাজ করা অনেকেই হয়তবা প্রত্যক্ষ ছিলেন নিশ্চয়। আমি তৃণমূলের গণমাধ্যমকর্মী থাকা অবস্থায় ক্যামেরায় ছবি তুলেছি অসংখ্য। ‘বাঁশের মাচায় করে জরুরী রোগীকে উপজেলা সদরের হাসপাতালে আনা হতো চিকিৎসার জন্য’। সেই বাঁশের মাচার যুগ কিন্তু আর নেই। তবুও প্রত্যন্ত গ্রাম শব্দটা গণমাধ্যমে ব্যবহৃত হয় এখনো। তথ্য প্রযুক্তির যুগেও গ্রামের মানুষ কেন করোনাভাইরাস মহামারি থেকে রক্ষা পেতে সামাজিক দূরত্ব মানছেন না? শহরেও কি সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত হচ্ছে? না হওয়ার পেছনে তাহলে কি সচেতনতার অভাব?

বিজ্ঞাপন

আমার বেশ কয়েকদিনের অভিজ্ঞতা বলে এটি সচেতনতার অভাব নয়। যারা সামাজিক দূরত্ব মানছেন না, তারা নিজেকে একে এক ধরণের বাহাদুরি মনে করছেন। কারও কারও ক্ষেত্রে একরোখা স্বভাব! আমার স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি আছে, আমার মতো অনেকেরই থাকতে পারে। আমার ভয় আছে করোনাভাইরাস নিয়ে। তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা গণমাধ্যমে যখন দেখি বাইরে সামাজিক দূরত্ব মানা হচ্ছে না তখন ভাবিয়ে তোলে। করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হওয়ার পর বাংলাদেশে প্রথম যেদিন সরকারের পক্ষ থেকে রোগী শনাক্তের ঘোষণা দেওয়া হল সেদিন থেকে সরকারের বিধিবিধান মেনে চলার চেষ্টা করেছি। দেশের সচেতন নাগরিকের যা করা উচিত, তা করেছি। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হইনি। একটা পরিবারের অনেক রকম চাহিদা থাকে সবার। আমারও আছে। আপনারও। খুব কষ্ট করেই কোনরকম জীবনযাপন করে আসছি। এতদিন যে কয়েকবার ঘর থেকে বাইরে অতি প্রয়োজনে বের হয়েছি সেসব অভিজ্ঞতা ভয়ানক।

বিজ্ঞাপন

বিশ্বব্যাপি করোনা মহামারিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, গণমাধ্যম ও মাইকিং ছাড়াও আমার মনে হয় প্রত্যেক ঘরে ঘরে এই বার্তা নিশ্চয় সবাই জানি যে, ঘরের বাইরে গেলে কীভাবে চলতে হবে। সামাজিক দূরত্ব কী? তবুও এখনো কেন আমরা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখছি না। প্রিয় জন্মভূমির নিয়ম না মানা এসব মানুষকে কিছু কী বলার আছে?

করোনাভাইরাস মহামারি নিয়ে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখছেন। পরামর্শ, সচেতন হওয়ার উপায়সহ অনেক কিছুই। ভালোই লাগে। তবে কিছু কিছু বিষয় আমাকে ভাবায়। আমি কেন এই মহামারির সময় কিছু করতে পারিনি? এই ব্যর্থতা আমার। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার সন্তোষপুর বনাঞ্চল। এখানের বানরদের জন্য করোনার সময় সরকারের পক্ষ থেকে আগের থেকে বেশি অর্থ বরাদ্দ হয়েছে। শুনে আনন্দিত হয়েছি। কারণ, প্রকৃতির এই বন্যপ্রাণিরা এতে প্রতিদিন একটু বেশি খাবার পাচ্ছে।

এছাড়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পরিচালিত সবজি বাজার, পুলিশের ইতিবাচক অনেক কাজ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ দেখে ও পড়ে আনন্দিত হই। দেশের ক্রান্তিকালে সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা যেভাবে মানুষের কল্যাণে কাজ করছেন, তাতে গর্ববোধ লাগে। করোনা ভাইরাসের সময় অনেকেই নীরবে নিভৃতে মানুষের পাশে আছেন। তারা গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হোক বা ফেইসবুকে আত্মপ্রচার কামনা করেন না। নিরবে নিভৃতে মানুষের সেবা করে যাচ্ছেন।

আমার প্রাক্তণ স্কুল শিক্ষক বাবা মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করলেও সার্টিফিকেট নেননি। অনেক সময় প্রশ্ন করতাম বাবাকে। কেন নেননি ? উত্তর দিতেন, মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেটের স্বীকৃতি আমার দরকার নাই। করোনার সময় কিছুটা বুঝলাম বাবা কেন এই কথা বলতেন। অনেকেই আছেন নীরবে নিভৃতে অসহায় মানুষের পাশে থাককে পছন্দ করেন। কাজী নজরুল ইসলামের মানুষ কবিতার, ‘গাহি সাম্যের গান- মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান।’ সেই গানের বাণীকে ধারন করে মানবসেবাই করতে চেয়েছেন তিনি। নিভৃতচারী থেকে যারা করোনা মহামারির সময় মানুষের সেবা করছেন, তাদের স্যালুট জানাই।

করোনার প্রেক্ষাপটে আমার এই লেখাটি। হয়তোবা আমার এই অন্যরকম লড়াইয়ের সাথে কারও মিল থাকতে পারে নিশ্চয়। আবার নাও থাকতে পারে। সাদামাটা এই লেখনি। তবে সামাজিক দূরত্ব নিয়ে আমার অন্যরকম এক লড়াই করার কথা জানাতে চাই। ৩ জুন, ২০২০। দুপুরে বাসা থেকে বলা হলো কিছু জরুরি ওষুধ ও অল্প বাজার লাগছেই। কী করা। যেতে তো হবেই। মুখে মাস্ক ও প্যান্টের পকেটে ছোট হ্যাক্সিসল নিলাম। দুপুরে বের হয়ে প্রথমে বাজার শেষ করে একটি ফার্মেসিতে গেলাম। যেয়ে শুনলাম, ফার্মেসির মালিক ও চার সহোদর করোনার সাথে বর্তমানে যুদ্ধ করছেন। ওষুধ কিনলাম।

মূলত আমি হেঁটে হেঁটেই চলাফেরা করি। বাজারে গিয়ে বুঝলাম, ইচ্ছা করলে সামাজিক দূরত্ব সবাই মানতে পারেন। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ আমার মনে হয় ইচ্ছা করেই শরীরের ওপর এসে পড়েন। ভাবটা এরকম যে, আমি দূরে কেন? কারণটা জানি না। বোঝার চেষ্টাও করিনি। জিনিসপত্র কেনার পর টাকা হাতে না দিলে বা খুচরা পয়সা হাতে না নিলে দোকানদার যেভাবে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন, মনে হয় আমি অনেক বড় অপরাধ করছি। সত্যিই কি অপরাধ করেছি? জানি না। জানার চেষ্টা করেই বা কী হবে।

যাহোক, রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসা বা যাওয়ার সময় একজন (অনুর্ধ্ব আঠার) খুব কাছে এসে শরীর ঘেঁষে পড়েন। বয়স্করাও কেউ কেউ। দীর্ঘদিন পর আজকেই শুধু কৌতুহলী হয়ে কয়েক তরুণকে জিজ্ঞেস করলাম এরকম করার মানে কী? কোনে সমস্যা কিনা? উত্তর পেলাম, এত নিয়ম মানলে আপনি ঘরেই থাকেন! বাসায় ফিরে এ নিয়ে লেখার সময় ভাবছি, হ্যাঁ আমি ঘরেই থাকতে চাই। কিন্তু নিয়ম না মানা কেউ কি আছেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় খাবার, বাজার ও ওষুধ একটু দিয়ে যাবেন? না, তাদের কাউকে এমন কাজে পাওয়া যাবে না।

তারপর বাজার থেকে শৈশবের খেলা দাড়িয়াবান্দার (আমার জেলা ময়মনসিংহের ভাষা) মতো বাসায় আসা হলো অন্যরকম এক লড়াই করে। কিন্তু সম্ভব হলো কি? ফিরে আগে গোসল করলাম। তারপর বাজার রাখার কাজ শেষ করলাম। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কয়েকদিনের। যা বুঝলাম। সাদামাটা উত্তর হলো, ইচ্ছা করেই বেশিরভাগ মানুষ সামাজিক দূরত্ব মানেন না। এটা একেবারেই স্বচ্ছ গ্লাসের মতো পরিষ্কার। শুধু তাই নয়, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে চাইলেও বিরক্ত করেন অনেকেই।

এদেরই অনেকে আবার সরকারের সমালোচনা করেন খুব সহজেই। কারণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখতে আর কত সময়! একটু ইতিবাচক ভাবুন, দেখুন চারপাশে, মানুষ কেন একটু দূরত্ব রাখছেন না। এছাড়া ঘরে থাকুন প্রোফাইল দিয়েছেন যারা, ফেইসবুকে লাইভ করে ঘরে থাকা ও সামাজিক দূরত্ব মানার সচেতন করার কথা বলছেন, এটা ভালো দিক! কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বাস্তবে কী বাইরে গিয়ে পারছেন মানতে বা কাউকে মানাতে? এবার আসুন নিজেও মেনে চলি, অন্যদের মেনে চলতে বলি। আমার ও আপনার অনেক ভুল। সামাজিক দূরত্ব মানার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নানা রকম চেষ্টা করা হয়েছে। বর্তমানেও হচ্ছে। কিন্তু আমরা নিজেরা সব বুঝেও যখন মানছি না, তাহলে সরকারের গঠনমূলক সমালোচনার পাশাপাশি আসুন আমাদের নিজেদের দোষের সমালোচনাও করি।

লেখক- সাবেক গণমাধ্যম কর্মী

বিজ্ঞাপন

নামেই শুধু চসিকের হাসপাতাল!
২২ নভেম্বর ২০২৪ ২২:০৬

আরো

সম্পর্কিত খবর