বাঙালির মুক্তির সনদ ঐতিহাসিক ৬ দফা
৭ জুন ২০২০ ২০:১৬
বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে অনন্য প্রতিবাদী আত্মত্যাগের একটি দিন ৭ জুন যা ঐতিহাসিক ৬ দফা দিবস ও বাঙালী জাতির মুক্তির সনদ নামে পরিচিত। ১৯৬৬ সালের এই দিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ছয় দফা দাবির পক্ষে দেশব্যাপী তীব্র গণআন্দোলনের সূচনা হয়েছিলো। আর সেই গণ আন্দোলন বাংলার স্বাধীনতার আন্দোলনকে স্পষ্টত নতুন পর্যায়ে উন্নীত করে। স্বাধীনতা সংগ্রাম রূপ নেয় কঠোর আন্দোলনে।
পাকিস্তানি শাসন-শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে স্বৈরাচারী শাষক আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সব বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে ডাকা এক জাতীয় সম্মেলনে পূর্ব বাংলার জনগণের পক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬-দফা দাবী উত্থাপন করেন। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১১ ফেব্রুয়ারি দেশে ফিরে ৬ দফার পক্ষে দেশব্যাপী প্রচার অভিযান শুরু করেন এবং বাংলার আনাচে-কানাচে প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে জনগণের সামনে ৬-দফার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।
বাংলার সর্বস্তরের জনগণ এই ৬-দফা সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন করে এবং ৬ দফার প্রতি স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন জানায়। ৬-দফা নিয়ে দারুণ জনমত গড়ে ওঠে। এমনকি ৬-দফা হয়ে ওঠে পূর্ব বাংলার শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির সনদ। ৬ দফার প্রতি ব্যাপক জনসমর্থন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে স্বৈরাচার আইয়ুব সরকার ১৯৬৬ সালের ৮ মে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠায়।
ছয় দফার সমর্থনে ১৯৬৬ সালের ১৩ মে আওয়ামী লীগ আয়োজিত পল্টনের জনসভায় ৭ জুন হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। মাসব্যাপী ৬ দফা প্রচারে ব্যাপক কর্মসূচিও ঘোষণা করা হয়। ঘোষিত কর্মসূচী অনুসারে ৭ জুন হরতালে নিরস্ত্র জনতার ওপর পুলিশ ও তৎকালীন ইপিআর গুলিবর্ষণ করে। এতে ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জে মনু মিয়া, সফিক ও শামসুল হকসহ ১১ জন শহীদ হন। শহীদের রক্তে ৬-দফা আন্দোলন স্ফুলিঙ্গের মতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র রাজপথে নেমে আসে বাংলার মুক্তিকামী জনগণ। ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলনের তীব্র দাবানল।
ছয় দফায় ছিলো বাঙালীর মুক্তির দাবি, বাঙালীর অধিকার আদায়ের দাবি। সেই ঐতিহাসিক ছয় দফার, প্রথম দফার বিষয়বস্তু ছিল লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তানকে একটি ফেডারেশনে রূপান্তর, সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থাকরণ, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার এবং আইন পরিষদের সার্বভৌমত্ব। দ্বিতীয় দফায় বলা হয়, বৈদেশিক সম্পর্ক ও প্রতিরক্ষা থাকবে কেন্দ্রীয় বা যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের হাতে এবং অন্যান্য খাত ন্যস্ত থাকবে প্রদেশের হাতে। তৃতীয় দফায় পাকিস্তানের দুটি অঞ্চলের জন্য পৃথক অথচ অবাধে বিনিময়যোগ্য মুদ্রাব্যবস্থার প্রবর্তনের কথা বলা হয়েছে। তবে এ কথাও বলা হয়েছে যে, একটি মুদ্রাব্যবস্থাও থাকতে পারে কিন্তু এরূপ হলে একটি ফেডারেল ব্যাংকের অধীনে এমন ব্যবস্থা করতে হবে যাতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে অর্থ পাচার না হতে পারে। চতুর্থ দফার বিষয়বস্তু হলো পাকিস্তানের প্রদেশগুলোর হাতে শুল্ক ধার্য করার ক্ষমতা অর্পণ এবং এ ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রদেশের শুল্ক আয়ের একটি অংশ প্রদান। পঞ্চম দফাটি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার পৃথক হিসাব রাখা সম্পর্কিত। আর শেষ দফাটি ছিল প্রত্যেক প্রদেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আধাসামরিক বাহিনী গড়ে তোলার ক্ষমতা প্রদান বিষয়ক।
একটু গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করলে বা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা কর্মসূচি ছিল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সমস্যাবলির নিয়মতান্ত্রিক সমাধানের লক্ষ্যে প্রণীত একটি বাস্তবায়নযোগ্য রাজনৈতিক কর্মসূচি। এতে উভয় প্রদেশের জন্যই পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি করা হয়। বস্তুত ছয় দফা কর্মসূচিতে উভয় প্রদেশের জন্য নিয়মতান্ত্রিকতার ভেতরে থেকে ন্যায়বিচার চাওয়া হয়েছিল।
আর এই ছয় দফা দাবির পক্ষে বাঙালি জাতির সর্বাত্মক রায় ঘোষিত হয় ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচনের মধ্যদিয়ে। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বাঙালিরা বিজয় লাভ করে।অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর দলকে জনগণ বিজয়ী করলেও স্বৈরাচারী পাক শাসকরা বিজয়ী দলকে সরকার গঠন করতে না দিলে আবারো বঙ্গবন্ধু জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতার পক্ষে আন্দোলন শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের।
আজ ২০২০ সালের ৭ জুন ৫৪ তম ছয় দফা দিবসে সেই দূরদর্শী মহান ব্যক্তি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি সহস্র সালাম ও ভালোবাসা জানাই।যিনি সময়োপযোগী ছয় দফা কর্মসূচি দিয়ে এবং পরবর্তীকালে একাত্তরের ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমে ধীরে ধীরে স্বাধীনতা অর্জনের অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে সবাইকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।মুক্ত করেছিলেন শোষকের হাত থেকে এই বাংলাকে, এই বাংলার মানুষকে। যার জীবনের ত্যাগ তিতীক্ষার বিনিময়ে আমরা পেয়েছি আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ।সোনার বাংলাদেশ।
লেখক: শিক্ষার্থী ও সংবাদকর্মী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।