Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অর্থনীতিতে এমন সংকট আগে কখনো হয়নি


৮ জুন ২০২০ ১৭:৫৭

অর্থনীতিতে এমনটা এর আগে কখনো হয়নি। এর আগে কখনো উৎপাদনকারীকে কম উৎপাদন করতে এবং ভোক্তাকে কম ভোগ করার জন্য উৎসাহিত করা হয়নি। জানুয়ারিতে আইএমএফ সারা বিশ্বে প্রবৃদ্ধি ধরেছিল +৩% যেটা এপ্রিলে এসে -৩% হয়ে গেছে। আবার জানুযারীতে আইএমএফ সারা বিশ্বের ১৬০ দেশের মাথাপিছু আয়ের ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি আশা করেছিল, এখন ইতিমধ্যে ১৭০ দেশের মাথাপিছু আয়ের প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হয়ে গেছে।

অর্থনীতিতে সব সময় অনিশ্চিয়তা থাকে। এবছরের অনিশ্চিয়তা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। অর্থনীতিবিদরা সবসময় ব্যাস্টিক বা সামস্টিক অর্থনৈতিক মডেল দিয়ে এ অনিশ্চিয়তা দূর করার চেষ্টা করে থাকে, কিন্তু এ বছর করোনাভাইরাসের ভূত ভবিষ্যতের সাথে অর্থচিন্তার সংশ্লেষ ঘটিয়ে অনিশ্চিয়তা দূর করার চেষ্টা করতে হবে। অর্থাৎ প্রচলিত চিন্তার বাইরে গিয়ে এবার অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে।

বিজ্ঞাপন

এখন শুরুতেই যে কাজটি করা হয়েছে তা হলো আমেরিকাসহ পৃথিবীর উন্নত অর্থনীতিসমুহ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষনা করেছে। এখানে দু ধরণের প্রণোদনা ঘোষনা করা হয়েছে। একটি হলো ফিসকাল স্টিমুলাস (রাজস্ব প্রণোদনা), অন্যটি মনিটারী স্টিমুলাস (টাকার সরবরাহ বাড়িয়ে প্রণোদনা)।

প্রশ্ন আসতে পারে এ প্রণোদনার প্রয়োজন কতটুকু ছিল? এটি কি ভালো হল নাকি খারাপ। সে প্রসঙ্গে বলা যায়, অর্থনীতি এখন স্থবির হয়ে আছে। এ মুহুর্তে ফিসকাল বা মনিটারী প্রণোদনা না পেলে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানই দেউলিয়া হয়ে যাবে এবং বহু লোক বেকার হয়ে যাবে। এটা অর্থনীতিতে একটা ভীতির সঞ্চার করবে যা করোনা পরবর্তী পূণরুদ্ধার প্রক্রিয়াকে সময়ক্ষেপনের মাধ্যমে বাধাগ্রস্থ করবে। এখানে যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক কত দ্রুত এবং কত কার্যকরীভাবে এরকম কঠিন সময়ে এ ফিসকাল বা মনিটারী স্টিমুলাস/প্রণোদনা অর্থনীতিতে অনুপ্রাণিত করতে পারে।

বিজ্ঞাপন

দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, এ প্রণোদনা অর্থনীতির উপর কি প্রভাব ফেলবে? সে প্রসঙ্গে বলা যায়, যেখানে ফিসকাল স্টিমুলাস প্যাকেজ দেয়া হয়েছে, তা প্রত্যর্পণ করার কথাও বলা হয়েছে। অর্থাৎ এখানে করদাতাদের স্বার্থ ও সংরক্ষন করা হয়েছে। এখানে টাকার স্থানান্তর হয়েছে। মুক্ত বা বদ্ধ অর্থনীতি, কোনটাতেই এ প্রণোদনায় কোন সমস্যা নাই। আর যেখানে মনিটারী স্টিমুলাস প্যাকেজ দেয়া হয়েছে বা হবে সেখানে মুদ্রাস্ফীতির প্রবল সম্ভাবনা থাকে। তবে এ সম্ভাবনা অর্থনীতিভেদে বিভিন্ন রকম হবে। উন্নত অর্থনীতিতে টাকা ছাপিয়ে প্রণোদনা দিলে উন্নত অর্থনীতির দেশসমূহে তার প্রভাব সহজে পড়ে না। কারণ, তাদের মৌলিক অর্থনীতির কাঠামো যথাযথ থাকে, তাদের কারেন্সি সাধারণত হার্ড কারেন্সি (যে কারেন্সির মুল্য সহজে কমে যায় না), তাদের বৈদেশিক মুদ্রার অনেক সহজ একসেস থাকে। সর্বোপরি তাদের ডিমান্ড ও সাপ্লাই ম্যানেজমেন্ট অনেক স্ট্রাকচারাল থাকে, ফলে হঠাৎ করে বিশাল চাহিদাও তৈরি হয় না এবং দামও সেভাবে বাড়েনা। ফলে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকে। অন্যদিকে উন্নয়নশীল অর্থনীতির প্রথম সমস্যা হচ্ছে তাদের কারেন্সি হার্ড কারেন্সি নয়। বৈদেশিক মুদ্রায় তাদের সহজ একসেস কম থাকে। অর্থনীতির মৌলিক কাঠামো ঠিক থাকে না, এমনকি ডিমান্ড ও সাপ্লাই ম্যানেজমেন্ট ও দুর্বল থাকে। অর্থাৎ, এখানে মুদ্রাস্ফীতির সম্ভাবনা অনেক বেশি।

তাছাড়া একটা জিনিস খুবই সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ। সেটা হলো, উন্নয়নশীল দেশগুলোর অনেক বৈদেশিক মুদ্রার পাওনা পরিশোধের বিষয় থাকে। এখন, উন্নয়নশীল দেশ যদি মনিটারী প্রণোদনা প্যাকেজ দেয়, আর তাতে যদি মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যায় তাহলে লোকাল কারেন্সি ডেপরিসিয়েট করবে এবং বিদেশী মুদ্রার দাম বেড়ে যাবে। এতে বৈদেশিক পাওনা পরিশোধ অনেক কঠিন হবে। তাছাড়াও মুদ্রাস্ফীতির আরও অনেক নেতিবাচক প্রভাব আছে। সেক্ষেত্রে ফিসকাল স্টিমুলাস প্যাকেজের মাধ্যমে সমাধান করতে পারলে সবচেয়ে ভালো। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত সে চেষ্টাই করছে।

এখন আসি করোনা কীভাবে বিভিন্ন ধরণের অর্থনীতিকে নাড়া দিবে। প্রথমে বলে রাখি, যেসব অর্থনীতির মৌলিক কাঠামো ভালো সেসব অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব এতটা পড়বে না। ভালো অর্থনীতির একটা লক্ষণ হল তাদের বিভিন্ন ধরনের ফাইনানসিয়াল এসেটের অনেক বাফার স্টক থাকে।

তবে উন্নয়নশীল অর্থনীতি নানা দিক থেকে ঝামেলায় পড়বে। প্রথমত তাদের স্বাস্থ্যখাত দুর্বল থাকায় শুরুতেই ঝামেলায় পড়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, অনেকে কমোডিটি রপ্তানি করে, যেমন গার্মেন্টস (বাংলাদেশ), তেল (সৈাদি, ইরান) ইত্যাদি, এগুলোর দাম পড়ে যাবে। তৃতীয়ত, যারা রেমিট্যান্সের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল (বাংলাদেশ) তারাও বিপদে পড়বে কারণ রেমিট্যান্স কমে যেতে পারে (আইএমএফ এর মতে তা ২০-৩০%)। আবার কিছু কিছু দেশ আছে অতিমাত্রায় ট্যুরিজমের ওপর নির্ভরশীল, তারা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। যেমন মালদ্বীপ। সবশেষে, উল্লেখিত কারণে অনেক উন্নয়নশীল দেশই বৈদেশিক দেনা পরিশোধ করা নিয়ে বিপদে পড়বে।

তাছাড়া, অন্য একটি দিক থেকে করোনা অনেক উন্নয়নশীল দেশকে বিরাট উভয়সংকটে ফেলে দিয়েছে। তাদের সমস্যা হচ্ছে মানুষ কি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাবে নাকি না খেয়ে মরবে। এর কারণ হচ্ছে, উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতির বিশাল একটা অংশ হচ্ছে ইনফরমাল সেক্টর। অর্থাৎ বেশিরভাগ মানুষ দিনে আনে দিনে খায় টাইপের আর এই ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সরাসরি করের আওতাভুক্ত নয় এবং কোন মনিটরিং অথরিটি নাই। ফলে ডাটা গ্যাপ অনেক বেশি থাকে এবং যথাযথ পলিসি নেয়া যায় না। ফলে উন্নত দেশের মতো মানুষকে সরকারিভাবে বেশিদিন খাওয়ানোর ক্ষমতা সরকারের থাকে না। যেমনটা কানাডা পারলেও বাংলাদেশ পারবে না।

সমস্যা তো জানা হল, এখন উপায়?

প্রথমত, করোনা মুক্ত পৃথিবীই সর্বোত্তম উপায়। করোনার কারণে সৃষ্ট সমস্যাগুলোর সমাধান করোনার তিরোধানেই সম্ভব, আপাতত বিকল্প কোন ব্যবস্থা তৈরি হয়নি।

দ্বিতীয়ত, বৈদেশিক দেনার ক্ষেত্রে পাওনাদার দেশগুলো এগিয়ে আসতে পারে। তারা তাদের পাওনা পরিশোধের সময় বাড়িয়ে দিতে পারে যা Debt Moratorium নামে পরিচিত। G20 ভুক্ত দেশগুলোই পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় পাওনাদার। এরা সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে পারে। তাছাড়া আন্তজার্তিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা প্যাকেজ নিয়ে আসতে পারে যা স্বল্প সুদে বা বিনা সুদে গরীব দেশগুলোকে দেয়া হবে (আইএম এফ এর সুত্র মতে তারা এ উদ্দেশ্যে ১ ট্রিলিয়ন ডলারের ফান্ড গঠন করেছে)। এখানে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে দক্ষ কূটনীতি তাদের অর্থনীতি পূণরুদ্ধারের ক্ষেত্রে অনেক অবদান রাখবে।

সবশেষে, যে দেশগুলোর মৌলিক অর্থনীতি অনেক ভালো, তারা করোনার এ ঝাপটা ভালোভাবে সামলাবে। তারাই অর্থনীতির নতুন অর্ডার সৃষ্টি করবে নতুন নতুন উদ্ভাবন দিয়ে। তাছাড়া, ই-কমার্স, ই-পেমেন্ট, ই-বিজনেস এসব ব্যবসায়িক ধারণাগুলো আরও শক্তভাবে জায়গা করে নিবে। এক কথায় একটা বড় ধরনের ডিজিটাল পরিবর্তন হবে। উৎপাদক আর ভোক্তার মধ্যে একটা ডিজিটাল মেলবন্ধন তৈরি হবে। ডিজিটাইজেশনে যারা কাজ করে তারা লাভবান হবে।

লেখক: সহকারী কমিশনার (ভূমি), রাজবাড়ী সদর, রাজবাড়ী। এমএসএস (অর্থনীতি), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণের পথ আরিফুর রহমান করোনা পরবর্তী দেশের অর্থনীতি করোনাকালে দেশের অর্থনীতি

বিজ্ঞাপন

নামেই শুধু চসিকের হাসপাতাল!
২২ নভেম্বর ২০২৪ ২২:০৬

আরো

সম্পর্কিত খবর