করোনারোগীদের প্রতি অমানবিক আচরণ নয়
৯ জুন ২০২০ ১৪:৪৪
জাতি হিসেবে আমাদের অনেক গর্ব হয় কারণ ভাষা আন্দোলনে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, ছয় দফা দাবি উপস্থাপন করে একটি অলিখিত স্বাধীকার আদায়ে চেষ্টা করেছে, যুদ্ধে নেমে বিজয় ছিনিয়ে আনাসহ অনেক ইতিহাস। সেই সঙ্গে আমাদের
কিছু কলঙ্কিত অর্জনও আছে।
গ্রামে অনেক কথা শোনা যায়। যেমন বাঙালী অতিচালাক জাতি, বাঙালি এক লাইন বেশি বুঝে চলে, বাঙালী স্বার্থবাদী, বাঙালী লেট অর্থাৎ নির্ধারিত সময়ের থেকে দেরিতে আসে ইত্যাদি। যা আমাদের জন্য লজ্জাজনক। একসময় ভাবতাম এগুলো মনে হয় শুধু গ্রামের নিরক্ষরদের মধ্যেই আছে। কিন্তু না, এখন দেখি এই বোঝার ব্যাপারটা অনেকের মধ্যেই আছে। আসলে এমনভাবে বোঝা বাঙালীর অর্জন নয়, বরং বাঙালীকে কলঙ্কিতই করেছে।
বিশ্বব্যাপী এক প্রকার যুুদ্ধই চলছে বলা যায়। যার এক প্রান্তে সকল দেশের জনগণ আর অপর প্রান্তে করোনা। সকলের মধ্যে কাজ করছে মানসিক চাপ। বিশ্বব্যাপী এক আতঙ্কের নাম করোনাভাইরাস। করোনা এখন অভিশপ্ত নামও বটে। করোনার ভয়াল থাবায় শিকার বিশ্বের প্রায় ২১০ টি দেশ। আর করোনার প্রভাব পড়েছে আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা ও অর্থনীতিসহ সকল কিছুর ওপর। প্রতিদিনই দীর্ঘ হচ্ছে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সারি। কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না এই মৃত্যুর মিছিল। বিশ্বের মোড়ল রাষ্ট্রগুলোও করোনার কাছে আজ পরাজিত। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য মতে, বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসে ৮ জুন সোমবার পর্যন্ত মোট নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ৪১০৯৩৭ টি। মোট ৬৮৫০৪ জন এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে ৯৩০ জন।
গত ৩১ ডিসেম্বর চীনের মধ্যাঞ্চলীয় হুবেই প্রদেশের উহান শহরে প্রথম করোনাভাইরাসের উপস্থিতি ধরা পরে। তারপর থেকেই চলছে করোনার তান্ডব। করোনাকালে আমার দেখা সেরা সহযোগীতা পাচ্ছে দেশের মানুষ। সরকার এই সংকটময় সময়ে যা দিয়েছে তা মাইলফলক। কিন্তু এই সময়ে জনমনে দেখা দিচ্ছে একটি বিষাদময় সংবাদ। এই সংকটময় সময়ে বাঙালির সেই কলঙ্কিত অর্জনের বিষয়টি আবারও অনুধাবন করতে পারলাম। আর তা হলো করোনারোগীর প্রতি অমানবিক আচরণ। পত্র- পত্রিকা বা টেলিভিশন চ্যানেলে অনেক খবরই দেখছি যে, করোনা রোগীকে খাবার দেয়া হচ্ছে না। করোনা রোগীকে ঘর ভাড়া দিচ্ছে না। সবচেয়ে মর্মান্তিক বিষয় হলো করোনা রোগে কেউ মারা গেলে তার পরিবারের সাথে কেউ যোগাযোগ করছে না। মনে হচ্ছে করোনা হওয়া অর্থই সে যেন সমাজের নিকৃষ্ট মানুষে পরিণত হয়েছে। যার কারণে অনেকে এই রোগে আক্রান্ত হলেও কাউকে বলছে না। মনে হচ্ছে এই রোগটা হওয়া অর্থই যেন নির্ঘাত মৃত্যু আর সমাজ থেকে বিচ্ছেদ।
কিন্তু কেন? আসলে কি এই রোগটি এমন? আমরা বাংলাতে ভাবসম্প্রসারণ পড়েছি, ‘পাপকে ঘৃনা করো, পাপীকে নয়।’ অর্থ্যাৎ একজন যদি চুরি করে তাহলে তার সেই চুরি বিদ্যাকে ঘৃণা করতে হবে। কারণ সেই চুরি করাটা মহাপাপ। কিন্তু আমরা যদি চোরকে ঘৃণা করি তাহলে সে কখনও ভালো পথে আসবে না। সে যদি ভালো পথে না আসে তাহলে কিন্তু সমাজে চুরির ঘটনা ঘটতেই থাকবে। তাহলে বিষয়টা কি হলো? তাকে কিন্তু ভালো হবার সুযোগ দেওয়া হলো না। সামাজিকভাবে সে যেন এই অপরাধে জড়িত না থাকে সেটা বলা যেতে পারে বা শাস্তি দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু তাকে অবহেলা করার মধ্যে কোন কৃতিত্ব আছে বলে আমার মনে হয় না। বরং চোরকে যদি কেউ কোন পরামর্শ দিয়ে ভালো পথে আনতে পারে সেটাই সফলতা।
করোনার ক্ষেত্রেও কিন্তু একই পরামর্শ। একজন করোনা আক্রান্ত রোগী তো মহাপাপী বা অপরাধী না। এটা প্রাকৃতিক কারণে হচ্ছে। তাহলে তাকে তাচ্ছিল্য করার কোন কারণ তো আমি দেখি না। হোম কোয়ারেনটাইনে থাকা অর্থ- সে অপরাধী নয়। যে রোগের যে চিকিৎসা। করোনা রোগে কেউ আক্রান্ত হলে তাকে আলাদা রাখা উচিত কারণ তার সঙ্গে কারো সংস্পর্শ হলে রোগের বিস্তার ঘটতে পারে বা বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে রোগটি সংক্রমিত হতে পারে। রোগীর ও পরিবারের সুস্বাস্থ্য চিন্তা করে এই প্রতিকার। তাহলে কেন করোনা হলেই সমাজের নিকৃষ্ট মানুষ তাকে ভাবা হচ্ছে? আমার মনে হয় বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তেই এমন প্রচার-প্রচারণা বা প্রবণতা রয়েছে বিশেষ করে গ্রামে এটি বেশি ভাবা হচ্ছে কারণ গ্রামের অধিকাংশ মানুষ নিরক্ষর।
কিন্তু প্রত্যেকটা মানুষেরই স্ব স্ব মর্যাদা নিয়ে বাঁচার অধিকার রয়েছে। তাছাড়া এমন প্রবণতার কারণে অনেকের মধ্যে আতঙ্ক বা চাপ কাজ করছে। ফলে আগে থেকেই অসুস্থ ব্যক্তিরা এই মনোবৃত্তিতেই মারা যাচ্ছে বা যেতে পারে। আমার মনে হয়, আমাদের সকলের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তি নয় বরং এই সংকটময় সময়ে যারা চাল চুরি বা জনগণের টাকা পকেটে রেখে পকেট ভারী করছে তাদের ঘৃণা করা উচিত। আমরা যদি চাল চোরকে ঘৃণা না করে সঙ্গ দিতে পারি, সমাজে ধর্ষণ করে তাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারি তাহলে করোনা রোগী কেন অপরাধী হবে? সে কি করোনা নিজে সৃষ্টি করেছে, সে কি ইচ্ছে করে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে? প্রত্যেকেরই কিন্তু নিজ নিজ জীবনের মূল্য আছে। করোনা একটি রোগ এবং এই রোগ নির্মূল করা যাবে না তাও না।
আপনারা অনেকেই দেখেছেন এই রোগ থেকে বিশ্বের অনেক দেশের অনেকেই সুস্থ হয়েছে। বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে ৮ জুন সোমবার পর্যন্ত সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন ১৪৫৬০ জন। বর্তমানে করোনা রোগীই বেশি মূল্যবান আমার মনে হয়। গণমাধ্যম করোনার জন্য আলাদা বার্তা বিভাগ করেছে বা গুরুত্বসহকারে করোনার সার্বিক অবস্থা তুলে ধরছেন। বিবেচনায় বলে, করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের এখন আমাদের বেশি মূল্যায়ন করা উচিত তার ও আমাদের সুস্বাস্থ্যের জন্য। সঠিক নিয়ম ও সর্তকতা অনুসরণ করলে করোনা বাংলাদেশে তেমন ক্ষতি করবে না বলে আশা করা যায়।
চীনা গবেষণায় বলা হচ্ছে, উত্তর গোলার্ধে গ্রীষ্ম ও বর্ষা মৌসুমের সময় করোনা ঝুঁকি কমে যাবে। উত্তর গোলার্ধ বেশ কয়েকটি দেশ রয়েছে। তবে এশিয়া মহাদেশের পূর্ব তিমুর, ইন্দোনেশিয়া ও মালদ্বীপ রয়েছে এই দক্ষিণ গোলার্ধে। আর এশিয়ার বাকি দেশগুলোর অবস্থান উত্তর গোলার্ধে।
উইকিপিডিয়া বলছে, বাংলাদেশের অবস্থান উত্তর গোলার্ধে। আর এই গোলার্ধে গ্রীষ্ম ও বর্ষা মৌসুমে কমে যাবে করোনার ঝুঁকি। চীনা গবেষকদের মতে, এই গোলার্ধ করোনার ভয়াল থাবা থেকে মুক্তি পেতে পারে। তাই সেই বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, বাংলাদেশে করোনার ঝুঁকিটা কিছুটা হলেও কম। প্রত্যাশা করি সকলে মিলে সচেতনতার মাধ্যমে করোনার বিদায় ঘন্টা বাজিয়ে দেবার। পৃথিবীটা মানুষের জীবনের অনুরূপ। সুখ-দুঃখ আর আনন্দ-বেদনা নিয়েই জীবন। সুখও দীর্ঘস্থায়ী নয় আবার দুঃখও দীর্ঘস্থায়ী নয়। সেই ধারাবাহিকতায় করোনাও দীর্ঘস্থায়ী নয়। প্রকৃতির এই ভয়াল ভাইরাসে কারো ওপর দোষ না চাপিয়ে, করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিকে ঘৃণা না করে সকলে মিলে আইন ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি। আইন না মানা এক প্রকার গুরুতর অপরাধ। আর আইনতো আমাদের জন্যই।
একসময় দেশে ক্যান্সার হলে, যক্ষা হলে রক্ষা ছিল না। এখন এই মরণব্যাধীরও ওষুধ বের হয়েছে। এখন আর যক্ষারোগীকে কেউ আলাদা মনে করে না। তাই করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিও আলাদা নয়। আমরা করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির পরিবারের প্রতি সদয় হই, তাদের খোঁজ-খবর নেই। করোনা দূর করতে শক্তি ও সাহস দেই। পাশাপাশি করোনা যেন আমাদের মাঝে দুরত্বের সৃষ্টি না করে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। আমরা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে পারি। তবে এই অজুহাতে আমরা যেন নির্দয় না হই। বরং করোনার কারণে আমাদের মাঝে যাদের দূরত্ব আছে তাদের করোনা পরবর্তীকালে একত্রিত হতে হবে। কারণ এই করোনা আমাদের শিখিয়ে যাচ্ছে রাগ-হিংসা-ঈর্ষা কোনটাই আমাদের নয়।
এই মন্দ অভ্যাসগুলো আমাদের কোন ভালো কিছু করতে সাহায্য করে না। কেউ কী এমন সংবাদ পেয়েছেন- কোন এলাকায় কোন মানুষের হিংসার কারণে করোনা থেকে মুক্তি পেয়েছেন? পাই নাই কিন্তু। বরং অসামাজিক মানুষ করোনায় মারা গেলে লোক মুখে প্রচার হবে লোকটি খুব অসামাজিক ছিল তাই সৃষ্টিকর্তা তাকে তুলে নিয়েছেন। এই যে সমাজের মন্দ অভ্যাস সেগুলো আমরা করোনার সাথে দূর করার চেষ্টা করতে পারি সবাই মিলে। সমাজের এই অসঙ্গতিগুলো দূর করার দায়িত্ব কিন্তু আমাদের সকলের। বিশেষ করে সমাজের গুণীজন বা দায়িত্বশীল সুনাগরিক রয়েছে আমাদের সকলের উচিত যারা করোনাকে নিয়ে এমন প্রবণতার পরিচয় দিচ্ছে তাদের বোঝানো।
করোনা অর্থ কলঙ্কিত নয়। করোনা রোগ নিরাময়যোগ্য। শুধু করোনা নিয়েই নয়, সমাজের সকল অসঙ্গতির বিষয়ে সঠিক পরামর্শ তুলে ধরা আমাদের সকলের দায়িত্ব। আমার মনে হয় করোনা নিয়ে এই বিকৃত তথ্য আরও বাড়তে থাকবে। তবে এমন অসচেতনতামূলক কথা বাড়তে দেওয়া যাবে না। করোনারোগীর মনোবল হারানো যাবে না। করোনা থেকে শিক্ষা নেই, সকলে মিলে হাতে হাত রেখে পাপকে ঘৃণা করে, আক্রান্ত ব্যক্তিকে ভাল পথে সুস্থ জীবন গড়তে উৎসাহিত করি। তাহলেই সমাজে বিস্তৃতি পাবে না অপসংস্কৃতি বা অসঙ্গতি। সকলের মর্যাদা হবে সমান। সরকারের প্রতি অনুরোধ করোনা রোগীর সামাজিক মর্যাদা ও নিরাপত্তা রক্ষায় সচেষ্ট থাকুন। মনে রাখতে হবে নমুনা সংগ্রহ করলেও সেই ব্যক্তি করোনা আক্রান্ত নাও হতে পারে । কারণ পরীক্ষা করা হয়েছে অনেকের সকলেই কিন্তু রোগী নয়। রোগী তারাই যাদের মেডিকেল থেকে চিহ্নিত করা হবে।
তাই গুজবে কেউ কান দিবেন না। মানুষের জীবন অর্থই রোগ-ব্যাধী সুস্থতা সবকিছু মিলে। তবে বর্তমানে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতির কারণে কোন রোগই আর রোগ নয়। যেকোন রোগেরই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে ও ওষুধ খেলে মুক্তি মেলে। আসুন আমরা সকলে মিলে করোনারোগীর খোঁজ-খবর নিয়ে করোনার কলঙ্ক মুক্ত করি। প্রিয় মানুষগুলোকে বাঁচতে অনুপ্রেরণা দেই। সর্বোপরি সরকারে প্রতি দৃষ্টিপাত করছি, করোনারোগীর প্রতি অমানবিক আচরণ বন্ধ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।