মহামারি করোনা; শাক দিয়ে মাছ ঢাকছি না তো আমরা?
৯ জুন ২০২০ ১৬:৩৩
করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ও সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার এলাকাভিত্তিক লকডাউনের উদ্যোগ নিয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেশের তিনটি বিভাগ, ৫০টি জেলা ও ৪০০টি উপজেলাকে পুরোপুরি লকডাউন (রেড জোন বিবেচিত) দেখানো হচ্ছে। আংশিক লকডাউন (ইয়েলো জোন বিবেচিত) দেখানো হচ্ছে পাঁচটি বিভাগ, ১৩টি জেলা ও ১৯টি উপজেলাকে। আর লকডাউন নয় (গ্রিন জোন বিবেচিত) এমন জেলা দেখানো হচ্ছে একটি এবং উপজেলা দেখানো হচ্ছে ৭৫টি।
এর আগেও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে লকডাউন হয়েছে। সেই লকডাউন কোনো কাজে আসেনি। দীর্ঘ আড়াই মাস সাধারণ ছুটি নামে সরকার মানুষকে ঘরে থাকার কথা বলেছে। এতে কার্যত ফলাফল খুব একটা ‘ভালো’ আসেনি। মানুষ বেশিদিন ঘরে থাকেনি।
সরকার শপিংমল, দোকানপাট, গার্মেন্টস, অফিস-আদালতসহ সবকিছু খুলে দিয়েছে। চালু করেছে গণপরিবহনও। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কোনোটাই নিশ্চিত করা যায়নি। ইতিমধ্যে করোনা ব্যাপকহারে বীজ বুনে দিয়েছে। এখন আমাদের এই ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা’র কাজ করলে কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না। তবু আমরা দেখি। আশা তো বাঁধতে চাই। উৎকণ্ঠা অকারণ নয়। কেননা কারোই কাম্য নয়, আমাদের দেশে করোনা আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করুক।
সাধারণ ছুটি আর না বাড়ানোর পিছনে প্রধান চিন্তাটি অর্থনীতি। মহামারি এখনও রীতিমতো উপস্থিত, আক্রান্ত সংখ্যা, মৃত্যুর সংখ্যা বরং বাড়ছে। তবুও অর্থনীতির স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারে, মানুষের অভাব-ক্ষুধা-কষ্ট কমানোর জন্য দেশের অবস্থা সচলতা আনবার প্রয়োজনে সাধারণ ছুটি আর হচ্ছে না। জীবিকা, অর্থনীতি মূল্যবান, কিন্তু জীবন তারও আগে।
দুই.
সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অব্যবস্থাপনা-দুর্নীতির কারণে পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থা আজ চূড়ান্তভাবে ভেঙে পড়েছে। তার কোনো নমুনা আমি আর দিচ্ছি না। বিষয়গুলো সবাই জানেন। বিষয়গুলো বিস্তর। কিন্তু মনে করিয়ে দিতে চাই, চিকিৎসা মানুষের সাংবিধানিক অধিকার। বেসরকারি খাতের মালিকরা স্বাস্থ্যখাতকে এতোদিন ধরে নানাভাবে জিম্মি করে রেখেছে। অভিযোগ রয়েছে, তারা এ সময়কালে ডাক্তারদের পুরো বেতন দেয়নি। মানসিকভাবে তাদেরকে নিপীড়নও করেছে। এখন আবার এ বেসরকারি হাসপাতালগুলো করোনার মতো স্পর্শকাতর এ চিকিৎসা নিয়ে একটা বড় ধরনের বাণিজ্য করছে।
আপনারা নিশ্চয় জানেন আনোয়ার খান মর্ডান হসপিটাল, ইউনাইটেড হসপিটালের খবর। আনোয়ার খান মর্ডান হসপিটাল শুধুমাত্র নাপা, এক্সটা ও গ্যাসের ওষুধের বিল করেছে ১ লক্ষ ৭০ হাজার। সেবা নামে তারা জনগণের টাকা হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। রোগীদের কাছে গলাকাটা চিকিৎসা ও শয্যা ফি আদায়ের মাধ্যমে রমরমা চিকিৎসা বাণিজ্য করা বেসরকারি হাসপাতালগুলো দেশের ক্রান্তিলগ্নে জবাবদিহিতার উর্ধ্বে চলার কৌশল কতটা যুক্তিসঙ্গত?
স্বাস্থ্যখাতকে এমনভাবে বাণিজ্যিকীকরণ করা হয়েছে, অনিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যাঙের ছাতার মতো বেড়ে উঠেছে প্রাইভেট ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্যাক্তিমালিকানাধীন হাসপাতালের সংখ্যা। দেশের আনাচে-কানাচে গড়ে উঠা প্রাইভেট হাসপাতাল, ডায়গনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিক মালিকরা চিকিৎসার নামে রমরমা ব্যবসা করেন। তাছাড়া বিভিন্ন ফার্মেসিতেও আমরা দেখছি, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রির দামও অনেক চড়া। আবার বিভিন্ন পণ্য সামগ্রির মধ্যে ভেজাল পাওয়ার খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
এখন প্রশ্ন রয়েছে, কেনো মানুষ বেসরকারি হাসপাতালের দিকে যাচ্ছে বা যাবে। প্রশ্নটা প্রাসঙ্গিক ও যৌক্তিক। সরকারি হাসপাতালগুলোতে সেবার নানা অপ্রতুলতা রয়েছে, প্রয়োজনের তুলনায় স্বাস্থ্যসেবা কম, বেড সংখ্যা কম, চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মী সংকট, উন্নত মানের আইসিইউ নেই, ডায়াগনস্টিক যন্ত্রণাংশ সংকট। তাছাড়া ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি ও দুর্নীতির কারণে সরকারি হাসপাতালগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা কম।
মোটা দাগে বলতে হয়, সরকার স্বাস্থ্যখাতকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। তবু সাধারণ মানুষ এখনও সরকারি হাসপাতালের প্রতি আস্থা রাখতে চায়, সেবা নেয়ার জন্য ছুটে বেড়ায়। দেশে প্রতিদিন যত জরুরি সেবা প্রদানের ঘটনা ঘটছে তার ৯৯ ভাগই প্রদান করা হয় সরকারি হাসপাতাল থেকে। বেসরকারি কিছু হাসপাতালে ভাল জরুরি সেবা আছে, কিন্তু সেসব অত্যন্ত ব্যয়বহুল।
সরকার তার হাসপাতালগুলোর প্রতি যত্নবান হলে, সেবার মান উন্নত ও নিশ্চিত এবং একই সাথে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িতদের জবাবদিহিতার মধ্যে নিয়ে আসতে পারলে এসব বেসরকারি হাসপাতালের দিকে মানুষকে যেতে হয় না। বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার ভেতরেও জরুরি স্বাস্থ্যসেবায় সরকারি হাসপাতালের ধারে কাছেও নেই বেসরকারি হাসপাতাল। সরকার আন্তরিকভাবে চাইলে সরকারি হাসপাতালকে ঢেলে সাজাতে পারে। কিন্তু তা না করে বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করেছে।
প্রবাসে থাকা আমার এক বন্ধু বলছে, টাকা দিলে বেসরকারি হাসপাতালে ভালো চিকিৎসা পাওয়া যায়। এই যে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের একটা তারতম্য, বেসরকারি হাসপাতালের দিকে মানুষের সহজাত ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা, এটা তো এমনি এমনি হয়নি। তার জন্য কে বা কারা দায়ী? সরকার নিজেই নয় কি?
তিন,
ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব পরিবর্তন হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকও নাকি পরিবর্তন হবে, এরকম একটা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। কিন্তু যিনি এ মন্ত্রণলায়ের প্রধান, মাননীয় মন্ত্রী, সমস্ত অব্যবস্থাপনা-দুর্নীতির দায় তো তিনি কোনোভাবে এড়াতে পারেন না। সুতরাং তাকেও এ পদ থেকে সরাতে হবে। আমরা দেখেছি প্রথম থেকেই তিনি নানাভাবে অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।
সম্প্রতি ‘দি ইকোনমিস্ট’ পত্রিকা একটা রিপোর্ট করেছে, শুধু ঢাকা শহরে ৭ থেকে ৮ লক্ষ মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। এ রিপোর্ট এখন সবার জানা। কিন্তু সরকারি হিসাব বলছে অন্য কথা। বাংলাদেশের অনেক গণমাধ্যমে ইকোনমিস্টের বরাত দিয়ে রিপোর্টটি এসেছে। সরকারি হিসাব ও ইকোনমিস্টের দেওয়া হিসাবের মধ্যে মানুষ কোনটাকে বিশ্বাস করবে।
অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, সরকার এ জাতীয় পরিস্থিতিতে জনগণকে কখনই সঠিক তথ্য দেয় না। অধিকাংশ দেশের সরকারই এটা করে। যদি সরকারি হিসাবটাকেও গণ্য করি, তাহলে এতো মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, তাদের চিকিৎসা দেয়ার জন্য সরকার কি প্রস্তুত? মানুষকে কেনো চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে হণ্য হয়ে ঘুরে বেড়াতে হয়। কেনো কোভিড-১৯ পরীক্ষা করতে হয়রানির শিকার হতে হয়?
চার,
লকডাউনের কথা বলছিলাম। আদৌ কি লকডাউন হবে? মানুষকে মানানোর কোনো সক্রিয় উদ্যোগ সরকার নিতে পারবে? সংক্রমণের মাত্রা এখন বেশি পরিমাণ, তাতে সরকার কতটুকু নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবে, বলাটা খুব মুশকিল।
কলকাতার আমার এক বন্ধুর সাথে কথা হলো, সে জানালো, কলকাতায় নাকি একইরকম অবস্থা, সেখানেও লকডাউন মানার প্রবণতা খুব কম। সেই হাওয়া আমাদের দেশেও আছে। পাড়া-মহল্লায় দেখি, কোনোরকম দূরত্ব তো নেই, স্বাস্থ্য সুরক্ষার মাস্ক, গ্লাভসও তারা ব্যবহার করছে না। বুক ফুলিয়ে তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছেলে- মেয়েরা বিধি-নিষেধ তোয়াক্কা না করে পাড়ার অলি-গলিতে আড্ডা দিচ্ছে। সিগারেট খাচ্ছে। অথচ সংক্রামক ব্যাধি আইনে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট শাস্তির বিধান আছে।
তাহলে কি বাঙালি জন্মগতভাবে শৃঙ্খলা না মানার মধ্যে থাকতে চায়? এদেশের মানুষের মধ্যে স্বাধীনচেতার একটা বড় প্রভাব রয়েছে। কোনো শৃঙ্খলা বা গৃহবন্ধীর মধ্যে থাকতে তারা আগ্রহী না। বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের নৈপথ্য সহযোগিতায় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে কমিউনিটি পুলিশিং গড়ে উঠেছে। অথচ এ সময়কালে তাদের কার্যক্রমও চোখে পড়ার মতো না। সরকার বলছে, মাস্ক না পড়লে ১ লক্ষ টাকা জরিমানা করবে। এখন পর্যন্ত শাস্তি দেওয়ার কোনো নজির কিন্তু আমাদের নেই। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ও সংক্রমণ ঠেকাতে সরকারকেই কঠোর ভূমিকা নিতে হবে। নাহলে শাক দিয়ে মাছও ঢাকা যাবে না।
লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, ঢাকা মহানগর