Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শ্রমিক ছাঁটাই নয়, বিকল্প পথ খুজুন


১০ জুন ২০২০ ১৯:১৫

করোনাভাইরাসের প্রভাবে সারা বিশ্বের মতো হুমকির মুখে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পও। করোনার কারণে শিল্প উৎপাদন ও রপ্তানিতে ব্যাঘাত ঘটায় চরম দুর্ভোগে গার্মেন্টস মালিকরা। নানা দিক থেকে গার্মেন্টসগুলো পড়েছে সমস্যায়। আমাদের গার্মেন্টস শিল্প মূলত টিকে আছে ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু করোনার কারণে কমে গেছে তাদের আমদানির চাহিদা। সুতরাং অনেক শতাংশ কমে গেছে রপ্তানিও। এ পর্যন্ত প্রায় ৩০০ কোটি ডলারের রপ্তানি আদেশ বাতিল হয়েছে। তেমন একটা বিবৃতি দিয়ে গার্মেন্টসকর্মী ছাটাইকরণের কথা উল্লেখ করে গত ৪ জুন বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে বিজিএমআই শ্রমিক ছাঁটাইয়ের কথা উল্লেক্ষ করে।

বলা হয় করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিশ্বে ভোক্তাদের চাহিদা কমে যাচ্ছে। দেশের পোষাক কারখানার কাজও ৫৫ শতাংশ কমেছে। এমন অবস্থায় জুন থেকে শ্রমিক ছাটাই শুরু হবে। সংবাদ সম্মেলনে বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক বলেন, ৫৫ শতাংশ ক্যাপাসিটরের উপর গার্মেন্টস চলছে। সুতরাং শ্রমিক ছাটাই ছাড়া কোন উপায় দেখছি না। তবে এ অবস্থা বদলেও যেতে পারে। তখন ছাটাইকৃত শ্রমিকরাই কাজে অগ্রাধিকার পাবে।বিজিএমইএ এর সভাপতি বলেন জুলায়ের দিকে আমাদের কি হবে বলা যাচ্ছে না সেই সময়ে আরো বড় ধাক্কা খেতে হতে পারে তা অসম্ভব কিছুই না। বিজিএমইএ এর অন্তর্ভুক্ত কারখানা ছিলো ২ হাজার ২৭৪ টি কিন্তু বর্তমানে কারখানা চালু আছে ১ হাজার ৯২৬ টি। তার মানে করোনাতে বেশ কিছু গার্মেন্টস বন্ধ আছে।

করোনার এই সময়ে ৩.১৫ বিলিয়ন ডলারের পন্য রপ্তানির ক্রয়াদেশ বাতিল হয়েছে। এর মধ্যে ২৬ শতাংশ ফেরত এসেছে। বিশ্বে ভোক্তার চাহিদা কমে যাওয়ায় আগামীতে ৬৫ শতাংশ চাহিদা কমে যাবে। সুতরাং দেশের কারখানাও ৫০ শতাংশ বন্ধ হয়ে যাবে। করোনার প্রভাবে চীন থেকে ৫৫ শতাংশ বিনিয়োগ তুলে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। বাংলাদেশ থেকেও দুই শতাংশ কমিয়েছে।

করোনা মহামারির কারণে এ বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে এসে আগামী তিন মাসের মধ্যে বিশ্বের সাড়ে ১৯ কোটি মানুষ তাদের পূর্ণকালীন চাকরি হারাতে যাচ্ছে। এতে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোয় চাকরি হারাতে যাচ্ছে সাড়ে ১২ কোটি মানুষ। বর্তমানে বিশ্বের পূর্ণ বা খণ্ডকালীন মোট কর্মশক্তির প্রতি পাঁচজনের মধ্যে চারজনের পেশা কোন না কোনভাবে কোভিড-১৯ এর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

করোনার এই প্রকোপে কতোটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বাংলাদেশ? পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের এক বিবৃতিতে উঠে এসেছে, বাংলাদেশ থেকে যে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়, তার ৬৩ শতাংশ ইউরোপে যায়, বাকি ১৫ শতাংশ যায় আমেরিকায়। বলা যায়, বেশিরভাগ যাচ্ছে, ওই দুইটি বাজারে। সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ, মানুষজন ঘরের ভেতরে। করোনাভাইরাসের প্রভাব শুরু হওয়ার পর এখন পর্যন্ত ৩.২ বিলিয়ন ডলারের অর্ডার বাতিল হচ্ছে। তারা বলছে, অর্ডার হোল্ড করতে। সেটা একটা বিরাট ধাক্কা।

গত বছরের মার্চ মাসের তুলনায় এবছর মার্চ মাসে রপ্তানি হয়েছে ৩০ শতাংশ কম। এপ্রিলে সম্ভাবনা রয়েছে, গত বছরের তুলনায় ৭০ শতাংশ রপ্তানি হারানোর। আর এর সঙ্গে জড়িত ৪৫ লাখ চাকরি।

এর বাইরে অন্যান্য পণ্যের রপ্তানি শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। সেই সঙ্গে বড় একটি ধাক্কা হতে যাচ্ছে রেমিটেন্সে। সেখানে একটা বিরাট ধ্বস নেমেছে। বাংলাদেশের মূল বাজার মূলত তিনটি। উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, আরেকটা পূর্ব এশিয়া। প্রথম দুইটা বাজারের অবস্থা খুব খারাপ। এদিকে মধ্যপ্রাচ্যে তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় সেখানেও চাকরিচ্যুতি শুরু হয়ে গেছে। ফলে এসব দেশে বিপুল পরিমাণ বাংলাদেশি শ্রমিক চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে পড়েছেন।

এর মধ্যেই বিশ্বব্যাংক একটি পূর্বাভাসে বলেছে বাংলাদেশে এই বছর প্রবৃদ্ধির হার ২ থেকে ৩ শতাংশে নেমে আসতে পারে। বাংলাদেশের শ্রমিকদের নিয়ে গবেষণা করেন, এমন সংস্থাগুলো বলছে, করোনাভাইরাসের কারণে এর মধ্যেই শ্রমবাজারে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন বলেছে, শতাধিক কারখানায় কর্মী ছাটাই করা হয়েছে। শুধু কর্মী নয়, অনেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদেরও স্বেচ্ছায় অন্তত ছয়মাসের ছুটিতে যেতে বলেছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। এই সময়ে তাদের চাকরি থাকলেও তারা বেতনভাতা পাবেন না।

করোনাভাইরাসজনিত পরিস্থিতিতে ২৬ শে মার্চ থেকে বাংলাদেশে যে অঘোষিত লকডাউন শুরু হয়েছে, এর ফলে যারা হোটেল-রেস্তোরা, নির্মাণ খাতের মতো অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন, সেসব খাতে শ্রমিকরা দীর্ঘদিন বেকার বসে রয়েছেন। অনেকেই বেতন ভাতা পাচ্ছেন না। আর্থিক কারণে এরকম কোন প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে তখন সেটির শ্রমিকরা সেখান থেকে কোন আর্থিক সুবিধা পান না। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সবচেয়ে বেশি কাজ হারাতে পারেন নির্মাণ খাতের শ্রমিকরা। এরপরেও খুচরা ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকরা কাজ হারাবেন। তবে খাতভিত্তিক চিন্তা করলে হোটেল-রেস্তোরা ও সেবা খাতের কর্মীরা বেশি কাজ হারাতে পারেন।

করোনার এই বিষাক্ত ছোবল লন্ডভন্ড করে দিয়েছে খেটে খাওয়া মানুষজনসহ বিভিন্ন সেবামূলক বা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকদের। সেই সঙ্গে হুককির মুখে পতিত করেছে এই সব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সকল শ্রমিকদের। উৎপাদন হলেও নেই বেচাকেনা, বন্ধ সকল প্রকার রপ্তানিও। স্বাভাবিকভাবেই বেচাকেনা না হওয়াতে নেই কোন লভ্যাংশ। দিনের পর দিন গুনতে হচ্ছে লোকসান। অনুপায় হয়ে করতে হচ্ছে কর্মী ছাটাই। যার বাস্তবতার বড় রূপ আমাদের গার্মেন্টস শিল্প।

দেশের বর্তমান এই সংকটকালীন সময়ে যদি গার্মেন্টস শিল্প থেকে শ্রমিক ছাটাই হয় তাহলে তা গার্মেন্টস শিল্প,  শ্রমিক ও দেশে অস্থিরতা তৈরি করবে। চলতি মাসেই যখন শ্রমিক ছাটাই হবে তখন শ্রমিকদের মাঝে দেখা দেবে অসন্তোষ, তারা তাদের চাকরি ও জীবিকার জন্য বিদ্রোহী হয়ে উঠবে। করোনার এই ভয়াবহ অবস্থাতেও তারা নেমে আসবে রাজপথে। সেই সঙ্গে পূর্ব ইতিহাস বলে আন্দোলন সহিংস রূপ নিয়ে মিটিং-মিছিল, কলকারখানায় তালা দেওয়া, ভাংচুর পর্যন্ত গড়াতে পারে। তাই শ্রমিকদের কথাও ভাবুন। শ্রমিকরা হঠাৎ করে চাকরি হারালে দেশে নামবে দুর্ভিক্ষ তখন তারা নিরুপায় হয়ে লিপ্ত হবে নানা ধরনের দূর্নীতিমূলক কাজে। যার প্রভাব পড়বে আমাদের সমাজ ও গোটা দেশের উপর এবং তার পরিণতি হতে পারে বেশ ভয়ংকর। হঠাৎ করে কাজ থেকে বিচ্যুত হলে মহামারির এই সময়ে তাদের জন্য অন্য কোথাও কাজ পাওয়া মুশকিল হবে।

সুতরাং, শ্রমিক ছাঁটাই না করে বা, তাদের চাকরিচ্যুত না করে বেতনের হার কিছুটা কমিয়ে আনা হোক। কথায় আছে নেই মামা থেকে কানা মামা ভালো। এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার তাদের ন্যায্য অধিকার প্রদান করা হবে এমন সিদ্ধান্তে আসা হোক। সরকারের ঘোষিত ৩ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন হোক। প্রয়োজনে সরকারি পরামর্শ ও সরকারি হস্তক্ষেপের জন্য আবেদন করা হোক। তবুও শ্রমিক ছাঁটাই নয়। বিকল্প পথ খুঁজুন এখনই।


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর