শেখ হাসিনার কারামুক্তি ও গণতন্ত্রবিরোধী সব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ
১১ জুন ২০২০ ১৫:১১
দীর্ঘ প্রায় ১১ মাস কারাভোগের পর ২০০৮ সালের ১১ জুন সংসদ ভবন চত্বরে স্থাপিত বিশেষ কারাগার থেকে মুক্তি পান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কারামুক্তি দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এর আগে সেনাসমর্থিত ১/১১-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই গ্রেফতার হন শেখ হাসিনা।
এ সময় কারাগারের অভ্যন্তরে শেখ হাসিনা অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন বিদেশে চিকিৎসার জন্য তাকে মুক্তি দেওয়ার দাবি ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে। আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের ক্রমাগত চাপ, আপসহীন মনোভাব ও অনড় দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার শেখ হাসিনাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
২০০৭ সালের ১৬ জুলাই মিথ্যা মামলায় অযৌক্তিকভাবে তৎকালীন সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গ্রেফতার করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা যে কোনো সময় গ্রেফতার হতে পারেন- এরকম একটি আশঙ্কা দেশবাসী আগে থেকেই করেছিল। অবশেষে আশঙ্কাটি সত্যে পরিণত হয়। ১৬ জুলাই ২০০৭, সোমবার, ভোর ৬টায় শ্রাবণের প্রবল বর্ষণের মধ্যে সুধাসদনে প্রবেশ করে যৌথবাহিনী। সকাল ৭টা ৩২ মিনিটে যৌথবাহিনীর সদস্যরা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করে সুধাসদন থেকে। সুধাসদনের চতুর্দিক বিভিন্ন বাহিনীর দুই সহস্রাধিক সদস্য ঘিরে রাখে।
বঙ্গবন্ধুকন্যা এর মধ্যে ফজরের নামাজ আদায় করেন। সাদা শাড়ি পরিহিতা বঙ্গবন্ধুকন্যা যৌথবাহিনীর কাছে জানতে চান, কেন তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। দেশে কি সামরিক শাসন জারি হয়েছে। তেমন কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকেরা। বরং যুদ্ধংদেহী মনোভাবে সাজসাজ রব তুলে শেখ হাসিনাকে নিয়ে গাড়ির বহর হাজির হয় ঢাকার সিএমএম আদালতে। মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোসাম্মৎ কামরুন্নাহার প্রচলিত নিয়মের তোয়াক্কা না করে আদালত বসার ঘণ্টা দুয়েক বাকি থাকতে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী জামিন নামঞ্জুর করে সংসদ ভবনের সাব-জেলে প্রেরণ করে দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনাকে।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার মতো একজন মর্যাদাসম্পন্ন জাতীয় নেতাকে গ্রেফতার থেকে জেলহাজতে প্রেরণ করা পর্যন্ত পুরো ঘটনায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যৌথবাহিনী কোনো সংযমের পরিচয় দেয়নি। সিএমএম কোর্টে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা সেসময়কার সরকারের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে আইনি ভাষায় ৩৬ মিনিট বক্তব্য রাখেন। সে সময় একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে কোর্ট প্রাঙ্গণে ছুটে গিয়েছিলাম অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাতে। গ্রেফতারের পূর্ব-মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশবাসীর উদ্দেশ্যে একটি চিঠি লিখে যান। দেশ ও জাতির সংকট মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুকন্যার ওই চিঠিটি গণতন্ত্রকামী মানুষের মাঝে নতুন আশার সঞ্চার করে। উজ্জীবিত হয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। সমসাময়িককালের রাজনৈতিক ইতিহাসে শেখ হাসিনার চিঠিটি একটি অমূল্য দলিল। চিঠিতে শেখ হাসিনা দেশবাসীর প্রতি তার আস্থার কথা যেমন ব্যক্ত করেছেন। তেমনি গণতন্ত্রের দুঃসময়ে নেতা-কর্মীদের করণীয় কি তাও সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন।
পাঠকদের জন্য চিঠিটি হুবহু উল্লেখ করছি-
প্রিয় দেশবাসী,
আমার ছালাম নিবেন। আমাকে সরকার গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্ছে। কোথায় জানি না।
আমি আপনাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যেই সারাজীবন সংগ্রাম করেছি। জীবনে কোনো অন্যায় করিনি। তারপরও মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। উপরে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ও আপনারা দেশবাসী আপনাদের উপর আমার ভরসা।
আমার প্রিয় দেশবাসী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের কাছে আবেদন কখনও মনোবল হারাবেন না। অন্যায়ের প্রতিবাদ করবেন। যে যেভাবে আছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন। মাথা নত করবেন না। সত্যের জয় হবেই।
আমি আছি আপনাদের সাথে, আমৃত্যু থাকব। আমার ভাগ্যে যাহাই ঘটুক না কেন আপনারা বাংলার জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যান। জয় জনগণের হবেই।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়বই দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটাবোই।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু
শেখ হাসিনা
১৬.০৭.২০০৭
এই চিঠির ভাষাই প্রমাণ করে শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের যোগ্য উত্তরসূরি। বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ গ্রেফতারের আগে যেমনিভাবে চূড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে বলেছেন, শেখ হাসিনাও তেমনিভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর অঙ্কুরিত নেতৃত্বই পারে সাহসের সঙ্গে যে কোনো পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে, সেই সত্য আবারও নতুন করে প্রমাণিত হলো। প্রায় চার দশকের দেশের গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির লড়াইয়ে শেখ হাসিনা নেতৃত্বের অগ্নিপরীক্ষায় বরাবরই সফল হয়েছেন। পাকিস্তানের কারাগারে নয় মাস বন্দী থাকাকালে এদেশের মুক্তিকামী বাঙালিরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা অনুযায়ী স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছে, লড়াই করে বিজয় অর্জন করেছে। শেখ হাসিনা ৩৩১ দিন কারাবাসের সময়গুলোতেও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তেমনি তার নির্দেশনা অনুযায়ী গণতন্ত্র মুক্তির সংগ্রামে জনমতকে সংগঠিত করেছিল। শেখ হাসিনা দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করতেন, সত্যের জয় হবেই। শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র হয়েছিল। এমনকি তার জীবন বিপন্ন করারও অপচেষ্টা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুকন্যার সাহসী ভূমিকা ও জনমতের কাছে গণতন্ত্রবিরোধী সব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়ে যায়। প্রায় এক বছর কারাবাসের পরে জনতার মাঝে ফিরে আসেন জনগণের নেত্রী শেখ হাসিনা। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পান শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় প্রবেশ করেছে। মাথাপিছু আয় এক হাজার ৭৫২ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। আমরা এখন স্যাটেলাইট যুগে প্রবেশ করেছি। বাংলাদেশ এখন বিশ্বসভায় আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আওয়ামী লীগ সরকার কাজ করে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারাজীবন সামনে থেকে ত্যাগ, সংগ্রাম করে এসেছেন। এমনকি বর্তমানে সময়ের প্রাণঘাতী ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছেন। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর থেকে প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ের কার্যক্রম সমন্বয় করে আসছেন। এই সংকট মোকাবিলায় তিনি ১ এপ্রিল ৩১টি, ১৬ এপ্রিল ১০টি, ২০ এপ্রিল ১৩টি এবং ২৭ এপ্রিল ১০টি নির্দেশনা দেন। কিভাবে হাঁচি-কাশি দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে তাও তিনি ভিডিও কনফারেন্সে নিজে সবাইকে দেখিয়েছেন। নিজে কাজ করছেন মাস্ক ও গ্লাভস পরে। আসন্ন বাজেট অধিবেশন সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাস্থ্যবিধি মেনে মন্ত্রিপরিষদ বৈঠক থেকে শুরু করে অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট বিষয়ে প্রয়োজনীয় সভা নিয়মিত করে যাচ্ছেন।এমনকি কোভিড-১৯ ঠেকানোর লড়াইয়ে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে গণভবন থেকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামেও অংশ নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
গণভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ পর্যন্ত মোট ১১ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলারের ১৯টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন, যা দেশের মোট জিডিপির ৩.৭ শতাংশ। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সেবা খাতের সংস্থাগুলোর জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকার, ক্ষুদ্র (কুটির শিল্পসহ) ও মাঝারি শিল্পের চলতি মূলধন সরবরাহের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন। তার নির্দেশে করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত ৫০ লাখ পরিবারকে ঈদ উপলক্ষে আড়াই হাজার টাকা করে নগদ সহায়তা প্রদান করে সরকার।
করোনা মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন দুই হাজার ডাক্তার ও পাঁচ হাজার ৫৪ জন নার্স নিয়োগ দিয়েছে। আরও পাঁচ হাজার স্বাস্থ্য টেকনোলজিস্ট নিয়োগের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সংকট মোকাবিলায় তিন হাজার মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট নিয়োগের প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যেসব সরকারি স্বাস্থ্যকর্মী প্রত্যক্ষভাবে করোনাভাইরাস রোগীদের নিয়ে কাজ করছেন, তাদের বিশেষ সম্মানী দেওয়া হবে। এ জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। দায়িত্ব পালনকালে যদি কেউ আক্রান্ত হন, তাহলে পদমর্যাদা অনুযায়ী প্রত্যেকে পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকা পাবেন। মৃত্যুর ক্ষেত্রে এই পরিমাণ ৫ গুণ বৃদ্ধি পাবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লড়াই করতে জানেন। কিভাবে সব বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যেতে হয়। তাই এই মহামারি করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিজয়ী হবেন।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগ