Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নিজ নিজ প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার রাখুন


১২ জুন ২০২০ ১৮:১৭

সাধারন ছুটি খুলে দেওয়াটা মেনে নিতে পারেনননি অনেকেই। কেউ কেউ ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। একজন আধুনিক শিক্ষিতা মা লিখেছিলেন- তার স্বামী প্রতিদিন গণপরিবহন ব্যবহার করে আসা যাওয়ার কারণে যদি কোনোভাবে আক্রান্ত হয়ে যান এবং সবকিছুর অজান্তে যদি তার শারীরিকভাবে দুর্বল কিন্তু মেধাবী দুই শিশু ও বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ি আক্রান্ত হন তবে তিনি তা কীভাবে সামলাবেন। এরই মধ্যে জনপ্রিয় বৃটিশ সাময়িকী দ্যা ইকোনোমিস্টের খবর শুনে আমাদের অনেকের মনে এখন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো অবস্থা। ৬ জুন প্রকাশিত খবরে বলা হয়- বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান করোনা আক্রান্তদের সঠিক সংখ্যা দিচ্ছেনা। তাদের দেওয়া এর চেয়ে নৈরাশ্যজনক খবরটি হলো- শুধু ঢাকাতেই আক্রান্তের সংখ্যা সাড়ে সাত লাখের বেশী। অবশ্য ইতোমধ্যে আইসিডিডিআরবি’র মহাপরিচালক ড. জন ক্লেমেন্স দাবি করেছেন যে ইকোনোমিস্ট পত্রিকা তার বক্তব্যটি যথাযথভাবে প্রকাশ করেনি।

বিজ্ঞাপন

যাইহোক, দেশে চলমান করুন পরিস্থিতি তো সবারই জানা। এক পরিবারে একজনের মৃত্যু হয়েছে তো আরেকজন আইসিওইউতে আশংকাজনক অবস্থায়। পুলিশ, ডাক্তার, নার্সসহ যারা এমন কঠিন দিনকে সহজ করার জন্য লড়ে যাচ্ছেন তাদের মধ্য থেকে আসছে মর্মান্তিক মৃত্যুর খবর। ডা. মুরসালিনের বাবা ডা. আবুল মোকারিম মারা গেলেন, এরপর মারা গেলেন তার বোন ও নানী। বাবা যেদিন মারা যান এর পরদিনই আইসিইউতে নেয়া হয় মাকে। আর নিজেও যে পজিটিভ তাতো আগেই জেনেছেন। এমনই জটিল সময় পার করছি আমরা। এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে দু’একদিন পর পর আসছে মৃত্যুহার বৃদ্ধির নতুন নতুন রেকর্ড; যেমন-সর্বশেষ আজ ১২ জুন (শুক্রবার) মারা গেছে ৪৬ জন। পরিচিতজনদের মৃত্যুর খবর শুনে শুনে মনে হচ্ছে যেন চারদিক থেকে ধেয়ে আসছে আঁধার। কিন্তু এ নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতিকে তো প্রশ্রয় দেয়া যাবেনা, তাহলে তো সে আরো ঝেঁকে বসবে। তাই আমাদেরকে ভাবতে হবে ইতিবাচক অবস্থা ফিরিয়ে আনার উপায় নিয়ে।

বিজ্ঞাপন

আমাদের জন্য এখন সবচেয়ে বড় আশাবাদ হলো ভ্যাকসিন আবিষ্কার। এরই মধ্যে খবর পাওয়া গেছে আগস্টেই আসছে অক্সফোর্ডের ইনহেলার ভ্যাক্সিন, সেইসাথে তৈরী হচ্ছে ২ বিলিয়ন ডোজ ইঞ্জেকশন ভ্যাক্সিন। তথ্যসূত্র- রয়টার্স, জুন-০৮, বিবিসি, জুন-০৫। তাই যাদের অন্তত আগামী জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত স্বেচ্ছায় ঘরবন্দী থাকতে কোনো সমস্যা নেই তাদের জন্য একটাই সিদ্ধান্ত- চেয়ে চেয়ে দেখা কখন আসবে ‘ভ্যাকসিন জাহাজ’। কিন্তু যাদেরকে প্রতিদিন বের হতে হবে বা মাঝে মাঝে বের হতে হবে তারা কি করবেন? তারা নিজ দায়িত্বে যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবেন এবং আশা বাঁধবেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি’র দেয়া সংজ্ঞাকে সামনে রেখে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও সিডিসি’র সংজ্ঞা অনুযায়ী- কোভিড-১৯ এ যারা আক্রান্ত হন তাদের বেশিরভাগের মধ্যে হালকা থেকে মাঝারি ধরনের সর্দি, কাশির লক্ষণ দেখা দেয়; আর যাদের স্বাস্থ্য ভালো তারা কোন চিকিৎসা ছাড়াই সুস্থ হয়ে যান। তবে যারা বয়স্ক এবং ডায়াবেটিস, ফুসফুসের রোগ, হৃদরোগসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত তাদের ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাহলে সংজ্ঞার প্রথম অংশের মধ্যে যারা পড়ে তাদের জন্য সুখবর হলো সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমাদের ইমিউন সিস্টেমকে শক্ত পোক্ত রেখে আমরা এ রোগের ভয়াবহতা থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে পারি। এখন কথা হলো, বৃটেনের সাময়িকী ইকোনোমিস্ট পত্রিকার কথা যদি সত্যিই হয়ে যায় তাহলে সেই আক্রান্ত সাড়ে সাত লাখ লোক গেল কোথায়? এর উত্তর হলো- তাদের মধ্যে কোন লক্ষণ নেই, তাই জানছেনা কেউ। আর লক্ষণ না থাকার কারণ হলো- ‘তাদের ইমিউন সিস্টেম শক্তপোক্ত’, ‘তারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে ভিটামিন সি, ডিসহ সকল পুষ্টিকর খাবার খাচ্ছেন’ এবং ‘কালজিরা ও আমলকির মতো পথ্য খাচ্ছেন’ যার কারণে ভাইরাস কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেনা। সর্বোপরি হতে পারে ঐ ধারণাই ঠিক যে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার উষ্ণ দেশগুলোতে কোভিড-১৯ এর জিনের শক্তি কম। কারণ, তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশে মৃত্যুহার অনেক কম। যেমন সুইডেনে মৃত্যুহার ১২ শতাংশ যেখানে বাংলাদেশে মাত্র ১.৩৫ শতাংশ।

এখন কথা হলো এই কঠিন সময়ে কোন স্বাস্থ্যবিধি মানবো? একেকজন তো বলছে একেক কথা! দেখুন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফসহ বাংলাদেশে বিদ্যমান জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার সাথে যৌথ উদ্যোগে আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কোভিড-৯ প্রতিরোধে জনস্বার্থে একটা সংক্ষিপ্ত স্বাস্থ্যবিধি বার্তা বিতরণ করেছে। তাছাড়া যুক্তরাজ্যের এনএইচএস (ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস), যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি (সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল), এএসএন (আমেরিকান সোসাইটি ফর নিউট্রিশন) ও সিএনএন হেলথ তাদের ওয়েবসাইটে কোভিড-১৯ প্রতিরোধে বিশেষ স্বাস্থ্যবার্তা ছেড়েছে। এইসব স্বাস্থ্যবার্তা অনুসরণ করে আমরা সবাই নিজ নিজ দায়িত্বে প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করতে পারি। ঐসব স্বাস্থ্যবিধির বার্তাগুলো সংক্ষেপে এমন- প্রতিদিন খেতে হবে- ভিটামিন সি, সমৃদ্ধ খাবার যেমন- আমলকি, জাম্বুরা, লেবুসহ মৌসুমি ফল ও শাকসব্জি; ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার যেমন- টুনা ও সার্টিন জাতীয় মাছ, কলিজে, ডিমের কুসুম, মাশরুম ইত্যাদি; জিংক সমৃদ্ধ খাবার যেমন- মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, বাদাম ও বীচি জাতীয় খাবার, ম্যাগনেশিয়াম সমৃদ্ধ খাবার- শিম, ছোলা, পালং শাক, ঢেঁড়স, তেতুল, টক দই ইত্যাদি; সেইসাথে প্রতিদিন দরকার ৮-১০ গ্লাস পানি পান (কুসুম গরম)। এছাড়া দরকার- পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও ঘুম, প্রতিদিন ৩০ মিনিট ব্যায়াম, প্রতিদিন কমপক্ষে ১৫ মিনিট রোদ পোহানো।

উপরের সবগুলো সংস্থার ওয়েবসাইটে মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার উপর জোর দেয়া হয়েছে। আর মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য আতঙ্ক ও মানসিক চাপ এড়িয়ে ফুরফুরে মেজাজে থাকার কথা বলা হয়েছে। সিডিসি ও এএসএন মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য আর,পি,এ টার্মটির কথা লিখেছে যার মানে হলো যথাক্রমে রেগুলার প্রিভেনশন একশন ও রেগুলার ফিজিক্যাল এক্টিভিটি। এএসএন উল্লেখ করেছে যে- ফিজিক্যাল এক্টিভিটি বা ব্যায়াম করলে মস্তিষ্ক সিরোটোনিন ও এন্ডরফিনস নামক ক্যামিক্যালদ্বয় ছাড়ে যা মেজাজ ফুরফুরে রাখতে সহায়তা করে। তাছাড়া টেবিলে লাগাতার বসে থাকার উপরেও নিয়ন্ত্রন আনতে বলেছে এএসএন। বাংলাদেশে প্রনীত স্বাস্থ্য বার্তায় বাইরের প্রক্রিয়াজাত খাবার খেতে নিষেধ করা হয়েছে। সাথে আরো কিছু জরুরী স্বাস্থ্যবার্তা হলো- পুষ্টিগুন সম্পন্ন হলেও এমন খাবার খাবেন না যা নিজের রুচি ও শরীরের সাথে যায়না। বিকল্প খাবার খেতে হবে নতুবা শরীর উলটো দিকে যাবে। তাছাড়া কন্ঠনালী পরিষ্কার রাখতে আমলকী বা কালিজিরা চিবিয়ে খেয়ে কুসুম গরম পানি খেলে ভালো কাজ দেয়। আর কোভিড যেহেতু ফুসফুসের রোগ তাই ফুসফুসকে ভালো রাখতে ধুমপান এড়িয়ে চলুন। বিশেষ করে যারা সিওপিডি (ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমুনারি ডিজিজ) গ্রুপের কোন রোগে আক্রান্ত তারা সদা সতর্ক থাকুন। তাজা বাতাসের শ্বাস ফুসফুসের এলবিউলি শক্তপোক্ত ও কার্যকর রাখে। তাই জানালা খোলা রাখুন ও সম্ভব হলে দুএকবার ছাদে যান। যারা আক্রান্ত হয়ে গেছেন তাদের মধ্যে কোন লক্ষন না থাকলে বা মৃদু লক্ষণ থাকলে বাসায় থাকতে পারেন। কিন্তু লক্ষণ উর্ধ্বমুখী হতে শুরু করলে দ্রুত হাসপাতালে যান। কারন বেশী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে গেলে চিকিৎসা কাজে লাগেনা, শংকা বেড়ে যায়, তাই আগেভাগেই চলে যান। কোন চিকিৎসা নাই, একথা ঠিক না। হাসপাতালে গেলে ডাক্তার আপনার প্রয়োজনানুযায়ী চিকিৎসা দিবেন। যেমন- অক্সিজেনসহ পরিচর্যা, প্লাজমা থেরাপি, স্ক্যাবো জাতীয় কোন ওষুধ বা অন্য কোন নতুন কিছু যা ডাক্তারগন জানবেন, যেমন –এন্টিবডি থেরাপি; এর সবই চিকিৎসা।

এরপর যারা সাহস করে সব কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন এবং নিজেদের ইমিউন সিস্টেমকে কোভিড মোকাবেলায় যথেষ্ট শক্তিশালী মনে করছেন তাদের জন্য একটা পরামর্শ আছে। আর তা হলো হার্ড ইমিউনিটি। কোন দেশের ৭০%-৯০% মানুষ এন্টিবডি প্রাপ্ত হলে এটি অর্জিত হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়। ভ্যাক্সিন না থাকলে এটি অর্জনের উপায় হলো দলে দলে আক্রান্ত হয়ে, যুদ্ধ করে, জয়ী হয়ে ফেরা। এ সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আগের একটা লেখায় আমি যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের একসময়ের পক্স পার্টির কথা বলেছিলাম। সেই ৮০, ৯০ এর দশকে গুটি বসন্তে হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের জন্য তারা ইচ্ছে করে দলে দলে গুটি বসন্তে আক্রান্ত হতেন যাতে শরীরে এন্টিবডি হয়। কারণ, একবার এন্টিবডি হলে সারাজীবনের জন্য প্রায় মুক্ত বললেই চলে। এটাই তাদের পক্স পার্টি। পক্স বা গুটিবসন্তে মৃত্যুহার প্রায় শূণ্যের কোঠায় ছিল বলে এটা করা যেত। কিন্তু এই মুহূর্তে, কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে ইউরোপ আমারিকায় তা ভাবাও ভুল। বাংলাদেশের জন্যও হার্ড ইমিউনিটি প্রযোজ্য নয়। তবে যেহেতু এখানে ইউরোপ আমেরিকার চেয়ে মৃত্যুহার অনেক কম, সেহেতু আতঙ্কিত না হয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে যুদ্ধ করা উত্তম। কর্মজীবীদের মধ্যে যাদের বাসায় শিশু, বৃদ্ধ বা রোগাক্রান্ত লোকজন আছেন তাদের উচিত অন্তত ছয়মাস আলাদা বাসায় থাকা। মোবাইলে কথা হবে, দেখা হবে।

আরেকটা কথা, যারা শিক্ষিত ও সচেতন তাদের আক্রান্ত হলে সমস্যা কম। কারণ তাদের বেশিরভাগেরই ইমিউন সিস্টেম ভালো বা বোঝেন কখন কী করা উচিত। কিন্তু, দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠির অবস্থা এর বিপরীতে। তাই সরকারের উচিত তাদেরকে উপজেলা নির্বাহি অফিসারের মাধ্যমে কমিটি গঠন করে মাসভিত্তিক টাকা দিয়ে অন্তত আরও ছয় মাস ঘরে বসিয়ে রাখা। বিশ্ব ব্যাংকের সাথে সরকারের কোভিড-১৯ বিষয়ক তিন বছরের যে প্রকল্প হয়েছে এ বিষয়টি সরকার সেই প্রকল্পের আওতাভূক্ত করতে পারেন। সেইসাথে সরকারের উচিত হবে, এ প্রকল্পের আওতায় বা বিল গেটস ফাউন্ডেশনের ঘোষিত ভ্যাকসিন প্রকল্পের সহযোগিতা নিয়ে বাজারে ভ্যাকসিন আসার সাথে সাথে প্রান্তিক জনগোষ্ঠিকে সবার আগে বিনামূল্যে তা দিয়ে দেওয়া। সচেতন ও পয়সাওয়ালাদেরকে এর পাশাপাশি বা পরবর্তিতে স্বল্পমূল্যে বিতরণ করা যাবে। কারণ সমস্যা ঐ দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠিকে নিয়েই। শেষে বলি, মাস্ক ব্যবহার ও হাত ধোয়ার পাশাপাশি নিজ নিজ শরীরে করোনা প্রতিরোধ সেল শক্তিশালী করুন, যুদ্ধে জয়ী হয়ে পৃথিবীকে দ্রুত করোনার চাপ থেকে মুক্ত করুন।

লেখক- জনস্বাস্থ্য ও সমাজবিজ্ঞান গবেষক

রাশেদ রাফি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর