Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আমরা কি এক বিবেকহীন জাতিতে পরিণত হচ্ছি?


১৮ জুন ২০২০ ১৪:২৮

চরম সঙ্কটকাল অতিক্রম করছে দেশ। এ সঙ্কটের নাম করোনা সঙ্কট। হুটহাট মারা যাচ্ছে মানুষ। পালিয়েও বাঁচতে পারছে না কেউ। শিশু থেকে বৃদ্ধ, বস্তিবাসী থেকে প্রাসাদবাসী, শহর থেকে গ্রাম; কেউই রেহাই পাচ্ছে না অদৃশ্য ঘাতক করোনাভাইরাসের হাত থেকে। আজ যে সুস্থ আছে কাল সে মৃতের কাতারে শামিল হবে না, এমন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারছে না। শোনা যাচ্ছে, কোনো কোনো দেশে মানুষ টাকা-পয়সা থেকে শুরু করে তাদের সর্বস্ব বিলিয়ে দিচ্ছে অথবা ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে রাস্তাঘাটে। তাদের বোধোদয় হয়েছে, টাকা-পয়সা, সহায়-সম্পদ মানুষকে রক্ষা করতে পারে না। এসবই মূল্যহীন।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু এমন অবস্থায়ও আমাদের দেশে দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র। কোথাও নীতি-নৈতিকতা কিংবা বিবেকবোধের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

করোনা নিয়ে আমাদের বিবেকহীনতার প্রকাশ শুরু মূলত মৃত্যুপুরি ইতালি থেকে আসা একদল প্রবাসীর মাধ্যমে। গত ১৪ মার্চ ইতালি থেকে দেশে আসা ১৪২ জনকে রাজধানীর আশকোনা হজ ক্যাম্পে কোয়ারেন্টাইনে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু সে নির্দেশ না মেনে তারা হট্টগোল ও বিক্ষোভ প্রদর্শন শুরু করে। ক্যাম্পের পরিবেশ নোংরা, থাকার অনুপযোগী; এমন অভিযোগ তুলে সেখানে থাকতে অস্বীকৃতি জানায় তারা। তাদের এ হট্টগোলের ফলে পরবর্তী সময়ে দেশে আসাদেরও আর প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে রাখা সম্ভব হয় না। ফল যা হওয়ার তাই হতে থাকে। ধীরে ধীরে দেশে প্রবেশ করতে থাকে করোনাভাইরাস। সেদিন যদি এই প্রবাসীরা সামান্য কষ্ট সহ্য করে হলেও বিবেকবোধের পরিচয় দিতে পারত তাহলে আজকে করোনার বিরুদ্ধে আমাদের যে সার্বিক লড়াই সেটা হয়তো আরও সহজ হতো।

বাংলাদেশে করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার শুরু থেকেই একদিকে স্বজন কর্তৃক রোগীদের সাথে বিভিন্ন অমানবিক আচরণ, অন্যদিকে এলাকাবাসী কর্তৃক রোগীর পরিবারের সঙ্গে অমানবিক আচরণের খবর আসতে শুরু করে। অনেকের সঙ্গে এমন আচরণও করা হতে থাকে যে তারা অসুস্থতার সঙ্গে লড়াইয়ের পাশাপাশি প্রচন্ড অপরাধবোধেও ভুগতে থাকে। বিভিন্ন স্থানে করোনার চিকিৎসা কেন্দ্র, আইসোলেশন সেন্টার স্থাপনে বাধা আসতে থাকে। কোথাও কোথাও কবরস্থানে করোনা রোগীকে দাফনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেও এলাকাবাসীকে সোচ্চার হতে দেখা যায়। পরবর্তীতে করোনা রোগীর মৃত্যুতে কাউকে কাউকে উল্লসিত হতেও দেখা যায়। এমন অমানবিক আচরণ এদেশবাসীকে এর আগে আর কোনোদিন করতে দেখা গেছে বলে মনে হয় না। তাদের আচার-আচরণে মনে হতে থাকে, করোনা আক্রান্তরা চরম পাপী, চরম অপরাধী। তাদের প্রতি কারও কোনো দায়দায়িত্ব নেই। অথচ আজ যে ব্যক্তি সুস্থ কাল যে সেও করোনায় আক্রান্ত হতে পারে, কাল যে তাকে নিয়েও এমন অমানবিক আচরণ হতে পারে এমনটা যেন তারা বেমালুম ভুলে যায়।

বিজ্ঞাপন

এ তো গেল অমানবিকতা। এরপরে আসি অনৈতিকতা এবং দুর্নীতির প্রসঙ্গে। করোনাভাইরাসের কারণে সারা দেশ লকডাউনের শুরুর দিকেই সরকার কর্মহীন মানুষ এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে খাদ্য সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু দুর্নীতির কারণে এমন ভালো একটি উদ্যোগও সুষ্ঠুভাবে কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। হতদরিদ্রদের জন্য দশ টাকা কেজি দরে চাল দেওয়া শুরু হতেই সারা দেশ থেকে অনিয়ম আর দুর্নীতির অভিযোগ আসা শুরু হয়। এ কারণে বেশ কয়েকজনকে জেল-জরিমানাও করা হয়।

এ ছাড়া গত ঈদুল ফিতরের আগে দুর্দশাগ্রস্ত পঞ্চাশ লাখ দরিদ্র পরিবারকে আড়াই হাজার টাকা করে প্রধানমন্ত্রীর উপহার প্রদানের কথা ঘোষণা দেন সরকার প্রধান শেখ হাসিনা। কিন্তু তার সময়োপযোগী এ উদ্যোগও কার্যত উদ্দেশ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়। দুর্নীতিবাজ জনপ্রতিনিধিরা গরিব পরিবারগুলোর জন্য বরাদ্দকৃত অনুদানের অর্থ নিজেরা এবং নিজেদের আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেওয়ার জন্য বিভিন্ন কায়দা-কৌশল অবলম্বন করতে থাকে। অঢেল টাকা-পয়সার মালিক অনেক জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালীকেও রাষ্ট্র্রপ্রদত্ত গরিবের বাঁচার অবলম্বন মেরে খাওয়ার চেষ্টায় ন্যূনতম দ্বিধাগ্রস্ত মনে হয়নি। তারা একবারও ভাবেনি, আজ অথবা কাল তারাও আক্রান্ত হতে পারে প্রাণঘাতী করোনায়। মানুষের মুখের গ্রাস তাদের খাওয়ার সুযোগ নাও হতে পারে।

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস নিয়ে ব্যবসা করতেও দ্বিধা করেনি আরেক ধরনের বিবেকহীন দুর্নীতিবাজ। তারা টাকার বিনিময়ে করোনাভাইরাস নেগেটিভ বা পজিটিভ রিপোর্ট বা সনদ দেওয়ার ব্যবসা খুলে বসে। হাসপাতালের ভুয়া প্যাডে তারা বিক্রি করে করোনার ভুয়া সনদ। এ অপরাধে রাজধানীর মুগদায় তিনজনকে গ্রেফতারও করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। একই অপরাধে সাভার থেকেও দুজনকে গ্রেফতার করা হয়।

আমাদের এ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সীমাবদ্ধ থাকেনি শুধু দেশের মধ্যে। সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, করোনার জাল সনদ বিক্রির অভিযোগে মালয়েশিয়ায়ও গ্রেফতার হয় কয়েক বাংলাদেশি। এসব অপকর্ম আমাদের জাতিগত চারিত্রিক সুনামকে যে কতটা নিচে নামিয়ে আনে তা একবারও ভাবেনি এসব বিবেকহীনের দল।

অন্যদিকে করোনা যুদ্ধে একদম সামনের সারির যোদ্ধারা যখন সুরক্ষা সামগ্রীর অভাবে আক্রান্তদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন, নিজেরা আক্রান্ত হচ্ছেন, মারা যাচ্ছেন, তখনও একদল অর্থলোভী তাদের জন্য এসব সরঞ্জাম কেনাকাটায় ব্যাপক দুর্নীতির আশ্রয় নিতে থাকে বলে অভিযোগ ওঠে। ১০ গুণ পর্যন্ত বাড়তি মূল্যে মানহীন সুরক্ষা সামগ্রী কেনা হয় বলে শোনা যায়।

সব ক্ষেত্রেই যখন করোনাকে পুঁজি করে আখের গোছানো হচ্ছে তখন ওষুধের দোকানদাররা কি বসে থাকতে পারে? তারাও করোনা মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ, স্যানিটাইজার ও মাস্কসহ বিভিন্ন চিকিৎসা সামগ্রীর কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে বাড়িয়ে দেয় দাম। ২০ টাকার মাস্ক বিক্রি হতে থাকে ১০০ টাকায়। ১৩০ টাকার স্যানিটাইজার ৩০০ বা তারও বেশি দামে। ৬ থেকে ৮ টাকা দামের ট্যাবলেট বিক্রি করা হয় ২০ থেকে ২৫ টাকায়।

এতো কিছু যখন হচ্ছে তখন হোমিওপ্যাথির দোকানদাররা নিজেদের বঞ্চিত কেন করবেন? আর্সেনিক আলবাম নামের একটি ওষুধ করোনা প্রতিরোধে সক্ষম বলে শোনা গেলে সেটিও দশগুণ বেশি দামে বিক্রি করতে থাকে কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী।

সিরিয়াস করোনা রোগীদের প্রয়োজন বিধায় পয়সাওয়ালারা অক্সিজেনের সিলিন্ডার কিনে ঘরেই মজুদ করতে থাকে। বাজারে অক্সিজেন সিলিন্ডার হয়ে ওঠে সোনার হরিণ। এই সুযোগে সিলিন্ডারের দাম বাড়ানো হয় কয়েকগুণ। এতে হাসপাতালগুলোও হয়ে ওঠে দিশেহারা। চিকিৎসা সরঞ্জামাদির মূল্য ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে অভিযানে নামতে হয় ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরকে।

এত অনিয়ম-অনৈতিকতার পরেও বলা যায়, আমরা অনেক ভাগ্যবান। এ কথা ঠিক যে, এ পর্যন্ত করোনায় আমাদের দেশে আক্রান্ত শনাক্তের সংখ্যা লাখ ছুঁই ছুঁই করছে। মৃত্যু হয়েছে এক হাজার তিনশর বেশি মানুষের। এরপরও স্বস্তি এ জন্য যে, তবু সে সংখ্যা অনেক দেশের এক দিনে মৃতের তুলনায় কম। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ ধারণা করছেন, আক্রান্তের দিক দিয়ে আমরা চূড়ার কাছাকাছি এসে পৌঁছেছি। যদি তাই হয় তাহলে শিগগিরই আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা কমতে শুরু করবে। আমরা সবাই কামনা করি, তাই যেন হয়। যত কম মৃত্যুর বিনিময়ে এই মহাদুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায় ততই মঙ্গল।

পরিশেষে এই মহাসঙ্কটে সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো পুরোপুরি সফলভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব না হলেও পরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষেত্রে সরকারের প্রশংসা করতেই হয়। করোনার কারণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠান স্থগিত করা ছিল এমন একটি সুচিন্তাপ্রসূত উদ্যোগ।

এ ছাড়া ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি, গণপরিবহন বন্ধ ঘোষণা, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অন্নসংস্থানের অসুবিধা নিরসনের জন্য জেলা প্রশাসকদের খাদ্য ও আর্থিক সহায়তা প্রদানের নির্দেশ, সারা দেশে নিম্নআয়ের মানুষদের ১০ টাকা কেজি দরে চাল প্রদান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সারা দেশে অতিরিক্ত চাল বরাদ্দ, দুর্নীতির ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া, গার্মেন্টসহ বিভিন্ন সেক্টরের জন্য বিশাল অঙ্কের প্রণোদনার ঘোষণা, স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য বীমা, অতিদরিদ্র ৫০ লাখ পরিবারকে নগদ সহায়তা প্রদান, দ্রব্যমূল্য অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল রাখা এবং জনবল সঙ্কট নিরসনে চিকিৎসক, নার্স ও টেকনোলজিস্ট নিয়োগ; এগুলো সবই সরকারের ভালো উদ্যোগ।

কিন্তু এসব ভালো উদ্যোগও পুরোপুরি সফল হয়নি মূলত সমাজের বিবেকবর্জিত কিছু মানুষের জন্য। এসব মানুষের কর্মকান্ডের কারণে আজ এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, দিনে দিনে আমরা কি এক বিবেকহীন জাতিতে পরিণত হচ্ছি? এ আশঙ্কা যেন সত্য না হয় সেই কামনা করছি।

লেখক: সাংবাদিক ও শিশুসাহিত্যিক

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর