লকডাউনের শিক্ষা
১৮ জুন ২০২০ ২০:৫০
করোনা যে সহসা ছেড়ে যাচ্ছে না, এ কথা আমাদের জানা হয়ে গেছে। যেসব দেশ প্রায় করোনা মুক্তির দাবি করে বসেছিল তারাও পুনর্বার আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে উদ্বিগ্ন। আমাদের আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা দিনদিন বেড়ে চলেছে। কতদূর গিয়ে এই মহামারির পরিসংখ্যান রেখা নিম্নমুখী হবে আমাদের জিজ্ঞাসার দৃষ্টি সেদিকে।
যৌক্তিকভাবেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি বাড়ানো হয়েছে। মানুষের জীবনের গুরুত্ব সবার আগে- এই বিবেচনায় সরকারের এই সিদ্ধান্ত সময়োপযোগী এবং যথার্থ। আগস্টে যদি শেষও হয় তবে পাঁচ মাস ছুটিতে থাকবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পড়ালেখার ক্ষতি হচ্ছে বলে কেউ কেউ এ বিষয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা এই ক্ষতি পূরণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন অনলাইনে পাঠদান করে। কিন্তু এ চেষ্টা যে কাঙ্ক্ষিত ফল দিচ্ছে না, এ সত্য অনেকেই উপলব্ধি করছেন।
বাংলাদেশে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই উন্নত বিশ্বের মতো হবে না। এর প্রধান কারণ দারিদ্র্য। আক্রান্তের হার দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ মানুষের চলাচল বেড়ে যাওয়া। কিন্তু ঘর থেকে বের হওয়া ছাড়া বিকল্পও খুব বেশি নেই। ফলে উন্নত বিশ্ব যে সময়ে করোনা নিয়ন্ত্রণে সফল হচ্ছে আমাদের এখানে তা হচ্ছে না। করোনা পরিস্থিতিতে আমাদের শিক্ষাও সেই আগের মতোই আছে।
স্মার্টফোন ব্যবহার করা নিম্ন আয়ের একটি পরিবারের শিক্ষার্থীর জন্য সহজ নয়। ইন্টারনেটে টাকা খরচ করে ক্লাস করা শিক্ষার্থী বড় শহরের বাইরে খুব বেশি নেই। আমাদের প্রচুর শিক্ষার্থী আছে যারা মাত্র গুটিকয় বই পড়ে শিক্ষাজীবন কাটিয়ে দেয়। তাদের সবাই যে পড়তে চায় না, এমন নয়। মূল সমস্যা দারিদ্র্য। বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী এখনো অনলাইনের আওতার বাইরে। বঞ্চিত হচ্ছে নিম্ন আয়ের শিক্ষার্থীরা, যারা টাকার অভাবে বই কিনতে সমস্যায় পড়ে, এখন অনলাইনের সেবা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে।
কিন্তু পড়াশোনা করতে হয়, শিক্ষা থেমে থাকে না, থাকতে পারে না। আমরা বলি, শিক্ষা একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। তবে সবসময় কেবল বই থেকেই পড়তে হয়, এমন তো নয়। কখনো কখনো বই বন্ধ করেও পড়তে হয়। এ হচ্ছে সেই সময় যখন পাঠ করতে হয় জীবন থেকে। বইয়ের বিকল্প আছে, কিন্তু জীবনের শিক্ষার বিকল্প হয় না। যখন মৃত্যুর জীবাণু বাতাসে ঘুরে বেড়ায়, নিঃশ্বাসের বায়ুর স্বচ্ছতা নিয়ে সন্দেহ জাগে, যখন মহামারির তাণ্ডবে পুরো পৃথিবী শোকগ্রস্ত এবং শোক করার অনুভূতিও হারাতে বসেছে মানুষ, তখন যদি কেউ বই খুলতে অনীহ হয়, তাকে খুব বেশি দোষ দেওয়া যাবে না। ছোট্ট শিশু, শিক্ষার্থী থেকে বয়ষ্করা জীবনের যে অভিজ্ঞতা বা শিক্ষার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি তা বইয়ের পাতায় নেই। যদিওবা থাকে ছাপার অক্ষরে, তা তো মৃত। ওখান থেকে বেশি কিছু শেখার নেই।
ছুটির পরে যে শিক্ষার্থী শ্রেণিকক্ষে ফিরে আসবে তার অভিজ্ঞতার গুরুত্ব অনেক। গল্প, কবিতা, নাটক বা সিনেমা নয়, সে দেখে আসবে জীবনের বাস্তবতা। বইয়ের বানানো বাস্তব আমাদের হাসায়, কাঁদায় সত্য, কিন্তু কখনও কখনও এর বিশ্বাসযোগ্যতায় আমাদের আস্থা থাকে না। ফলে আমাদের বোধে তা আলোড়নও তোলে না। কিন্তু জীবনের বাস্তবতায় কোন ফাঁক নেই। সার্টিফিকেটের পরীক্ষায় এই অভিজ্ঞতার কতটুকু মূল্য আছে তা হয়তো তর্কসাপেক্ষ, তবে জাতীয় জীবনে এই অভিজ্ঞতার গুরুত্ব অপরিসীম।
করোনা মোকাবিলায় আমরা যেসব অবৈজ্ঞানিক যুক্তি দাঁড় করিয়ে নিজেরা সুরক্ষিত বলে আত্মপ্রসাদ লাভ করেছিলাম, তার ষোলো আনাই যে মিছে এ সত্য আর গোপন নেই। টিকে থাকার লড়াইয়ে মানুষের জয়-পরাজয়ের ব্যক্তিগত বা সামষ্টিক অভিজ্ঞতার মূল্য অনেক। জীবন বাঁচাতে সংকটাপন্ন মানুষের পাশে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যারা রাত-দিন সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তাদের সাহস, ত্যাগ, মানবতাবোধ আমাদের স্বত্বায় আলো জ্বেলে যায়। যারা চিকিৎসা সুবিধা না পেয়ে করুণভাবে পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছেন, জীবাণুর কারণে যারা প্রিয়জন থেকে পরিত্যক্ত হয়েছেন, শেষ বেলায় যারা নিকটজনের একমুঠো মাটি বা আগুন পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, তাদের জীবন বাস্তবতা আমাদের মনে দুঃখের নীল রঙ মাখিয়ে দেয়।
আবার যখন দেখি জীবাণুর ভয়ঙ্কর রূপ জানা সত্ত্বেও নিজের নিঃশ্বাস বায়ু দিয়ে ভরিয়ে দিতে চায় প্রিয়জনের ফুসফুস, তখন বেঁচে থাকার এবং বাঁচিয়ে রাখার উন্মাদনা টের পাই রক্তের ভিতর। এই অভিজ্ঞতাকে মূল্যহীন মনে করে দূরে ঠেলে দেওয়া ঠিক হবে না। জীবন বাস্তবতার গভীর জ্ঞান নিয়ে ফিরে আসবে যে শিক্ষার্থী তার আগামী নতুন ধরনের হবে- এ আশাবাদ বাড়িয়ে করা নয়।
সুতরাং কিছুদিন প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা বন্ধ থাকল বলে সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তায় হতাশ হওয়ার কোন মানে নেই। আগে তো কিছুদিন বাঁচি, তারপর না হয় অন্যসব। কী এমন সুখের আছে সুখে-দুঃখে বেঁচে থাকা ছাড়া!
লেখক: শিক্ষা-ক্যাডার কর্মকর্তা