শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ- একজন রাজনীতিবিদের সমান্তরাল ধর্মচর্চা
২০ জুন ২০২০ ১৬:৩৫
ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে একদিন শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ ভাইয়ের রুমে বসে আছি। কোনো একটা বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছিল। বেশ কয়েকজন সাংবাদিক এলেন একটি ইস্যুতে তার বক্তব্য নিবেন। যতদূর মনে পরে একটু ঝামেলাযুক্ত ইস্যু। সাংবাদিকদের ‘আটঘাট’ দেখে মনে মনে কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেলাম- কোনো গোলমাল না বাঁধে আজ!
সাংবাদিকরা প্রশ্ন করার আগে আবদুল্লাহ ভাই বললেন, ‘আপনাদের প্রশ্ন শোনার আগে আমি একটু কথা বলতে চাই, যদি আপনারা অনুমতি দেন?’ তিনি বললেন, ‘দেখুন! মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে এমন একটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়েছেন; এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করে জান্নাত কামানো সম্ভব আবার জাহান্নামী হওয়াও সহজ। আমি ভাই এই শেষ বয়সে এসে নেত্রীর দেওয়া পবিত্র দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে জান্নাত অর্জন করতে চাই। এবার আপনাদের প্রশ্ন করেন…’
আমি লক্ষ্য করলাম তার এই বক্তব্যের পর রুমের ‘উষ্ণ’ পরিবেশটা কেমন যেন ‘শীতল’ হয়ে গেল। ভাবা যায়! বাংলাদেশের একজন মন্ত্রীর মুখের কথা এটা? কোনো লোক মারফত নয়; নিজ কানে শুনেছি আমার আবদুল্লাহ ভাইয়ের এই বক্তব্য।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে দেখিনি আমি; তবে তার আদর্শ সৈনিক শেখ আবদুল্লাহ দরাজ কণ্ঠ শুনেছি এবং তার কন্ঠের মাঝে বঙ্গবন্ধুকে খুঁজেছি। অত্যন্ত মিশুক স্বভাবের মানুষটার মাঝে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে কাছে টেনে নেওয়ার; এমনকি শত্রুকেও আপন করে নেয়ার এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল। কথার ফুলঝুড়িতে পটু ছিলেন তিনি। রেগে কথা বলছেন, ধমকাচ্ছেন- কিন্তু যাকে ধমকাচ্ছেন তিনি মনে কোনো কষ্ট পাচ্ছেন না; এ এক আশ্চর্য গুণ-ক্ষমতা। আল্লাহ মহান এমন গুণ-ক্ষমতা অতি কম সংখ্যক মানুষকেই দান করেন।
একজন মানুষের কিছু কাজ-কর্ম, আচার-ব্যবহার এবং আদান-প্রদান দেখলেই তার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। সাংবাদিকতায় যুক্ত থাকায় তিনি মন্ত্রী হওয়ার বহু আগ থেকেই তার সঙ্গে পরিচয়, এবং ভাই ডাকার অবারিত অধিকার। মন্ত্রীত্বলাভের কিছুদিন পরে আবদুল্লাহ ভাই আমাকে বলেছিলেন, ‘আমার এখানে নিয়মিত যাতায়ত করবি মিরাজ! নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎ না হলে ভাব জমে না। গভীর হয় না সম্পর্কও।’ শতভাগ তার কথা মেনে নয়; ভিন্ন এক ভালোলাগায় সপ্তাহে একবার মন্ত্রণালয়ে হাজিরা দেওয়ার চেষ্টা করতাম। আর এই সুযোগে কাছ থেকে একজন প্রগাঢ় রাজনীতিবিদের ধার্মিকতা, আলেম-উলামাদের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা, হজ ব্যবস্থাপনার অস্বচ্ছতায় তার উদ্বিগ্নতাসহ নানান আচার-আচরণ ও আদান-প্রদানের সাক্ষী হতাম। সর্বপরি তার সমান্তরাল ধর্মচর্চার অবয়ব-কাঠামো দেখতাম।
তার এসব আচার-ব্যবহার ও আদান-প্রদানকে অনেকে উপরের চেহারা বলে চালিয়ে দিতে পারেন; তবে আমার চোখে তার এসব ‘সাদা আয়োজনে’র ভিন্নরকম এক ছায়া গেঁথে আছে। আমার চোখের সাদা সে ছায়াকে আমি সাদাই রাখতে চাই।
বাংলাদেশের ইতিহাসে দেশের শীর্ষস্থানীয় ৫৮ জন আলেম-উলামা ও পীর-মাশায়েখকে হজে নেওয়ার আয়োজনকে বাইরে থেকে বহু মানুষ বহু রঙে দেখেন। কিন্তু আমি? মন্ত্রণালয়ের চারটি দেয়াল ঘেরা শেখ আবদুল্লাহর ঘরে বসে গোটা আয়োজনে সব মত ও পথের আলেম-উলামাদের প্রতি তার শ্রদ্ধাবোধ অবলোকন করেছি। সবকিছু ফাইনাল হওয়ার পর যখন আমি বললাম, ‘ভাই আপনার এই খেদমত নিয়ে আমি একটি প্রতিবেদন করতে চাই। প্রতিবেদনের শিরোনাম হবে- ‘সব মত ও পথ এসে মিশে গেছে কাবার পথে।’ আমার শিরোনামটি শোনার পর তার চোখে যে উচ্ছ্বাস আমি দেখেছি এবং তার চেহারায় যে তৃপ্তি আমি অবলোকন করেছি; কোনোভাবেই সে তা ঠুনকো কোনো কালিমা বা অপবাদ দিয়ে ঢাকা যাবে না।
আজ তিনি নেই; তাই বলতে বাঁধাও নেই- দুটি কাজের আইডিয়া নিয়ে একদিন কথা বলছিলাম তার রুমে। একদম একান্তে। শুধু আমি আর তিনি। এমন মুহূর্ত খুব একটা পাইনি। সুতরাং সেই মুহূর্তটির একমাত্র সাক্ষী এখন আমার আল্লাহ মহান। একটি আইডিয়া তার সম্পর্কিত আর অন্যটি বঙ্গবন্ধু সম্পর্কিত। সাতপাঁচ না ভেবেই একবাক্যে তিনি সেদিন বলেছিলেন, ‘মিরাজ সর্বাগ্রে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কাজটা হওয়া উচিত। আমি তো চুনোপুটিরে আমার আবার কিসের…।’
এ ঘটনা থেকে আমি আবদুল্লাহ ভাইয়ের দুটি আদর্শ খুঁজে পেয়েছি। ১. বঙ্গবন্ধুকে তিনি অগ্রাধিকার দিয়েছেন; বঙ্গবন্ধুর একজন আদর্শ সৈনিকের পরিচয় যা। ২. নিজেকে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভাবেননি; নিসন্দেহে এটা একজন প্রকৃত বড় মানুষের পরিচয়। কারণ, যারা প্রকৃত বড় মানুষ; নিজেকে কখনো তারা বড় হিসেবে জাহির করেন না। ছোটভাবে পরিচয় করান নিজেকে…।
প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর গুরুত্ব দিয়ে হস্তক্ষেপ করেন হজ ব্যবস্থাপনায়। ২০১৯ সালের হজ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের উদ্বোধনী সংবাদ সম্মেলনে শেখ মোহাম্মাদ আবদুল্লাহ বলেছিলেন, ‘কোনো হাজির চোখ থেকে এবার বেদনার পানি ঝরতে দিব না এবং কোনো হাজিকে বাংলাদেশে রেখে আমি আবদুল্লাহ হজ পালনের উদ্দেশ্যে বিমানে উঠবো না।’
তার এই বক্তব্যের পর খাবার টেবিলে বসে সাংবাদিকরা আলোচনা করছিলেন; বলাবলি চলছিল এবং আমিও সে বলাবলি-আলোচনায় সামিল ছিলাম; আমাদের বক্তব্য ছিল এমন- ‘এসব কথা সব মন্ত্রীরাই বলেন; বাস্তবায়ন করাটা প্রায় অসম্ভব। এটা উনার প্রথম হজ ব্যবস্থাপনা তো; তাই আবেগ একটু বেশি।’
আশ্চর্যজনক কথা হলো- ২০১৯ সালের হজ পালন শেষে সমাপনী সংবাদ সম্মেলনে ধর্ম প্রতিন্ত্রীর বক্তব্য শেষে প্রায় সব মিডিয়াতে সংবাদ হয়েছে এভাবে- ‘ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ হজ ব্যবস্থাপনা দেখল বাংলাদেশী হাজিরা।’ আমি অধম তখন আমার প্রতিবেদনের শিরোনাম করেছিলাম- ‘কোনো হাজির চোখ থেকে এবার বেদনার পানি ঝরেনি।’ আবদুল্লাহ ভাই আমার প্রতিবেদনটি দেখে বলেছিলেন, ‘মিরাজ তুই আমার ওয়াদাটা মনে রেখেছিস; এ জন্য তোকে ধন্যবাদ ভাই।’
আরও সুখের কথা হলো- তিনি সে বছর সব হাজিদের হজযাত্রা নিশ্চিত করেছেন; এমনকি এজেন্সিওয়ালাদের অসাধুতায় বিমানবন্দরে আটকে পরা ৪/৫ জন হাজিকে খুঁজে বের করে তাদের সৌদি পৌঁছানোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করে নিজে হজের ফ্লাইটে বসেছিলেন।
তাবলীগ জামাতের বিরাজমান বিবাদ নিরসনে সমান্তরাল ভূমিকা পালন করেছেন অ্যাডভোকেট শেখ মোহাম্মাদ আবদুল্লাহ। তার এ অবদানকে কারও চোখে ‘সাদা’ লেগেছে, কারও চোখে লেগেছে ‘কালো’। কারণ, সবার চোখে সমান রঙের চশমা না থাকাই স্বাভাবিক।
আপনারা যে যাই বলুন ভাই; আমি আমার গানটা গাই। সময় থাকলে একটু শুনুন প্লিজ- আবদুল্লাহ ভাইয়ের রুমে তাবলীগ জামাতের এক পক্ষের বেশ কয়েকজন সাথী প্রবেশ করলেন। তাবলীগী সাথীরা আসার পর রুমে থাকা সবাইকে বের হওয়ার আবেদন জানালেন ধর্ম প্রতিমন্ত্রী। বললেন, ‘উনাদের সঙ্গে আমার একটু আলাদা মিটিং আছে। আপনারা আবার পরে আইসেন।’ এ কথা শোনার পর বুদ্ধি খাটিয়ে আমিও বের হওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালাম। আমাকে দাঁড়াতে দেখে তিনি বললেন, ‘না, তুই বস। তোর যেতে হবে না।’
বের হলাম না। বসলাম, থাকলাম। বসে বসে একটি ইতিহাসের সাক্ষী হলাম- তাবলীগের এই গ্রুপের একজন সাথী আবদুল্লাহ ভাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আপনি ওদের ইজতিমাতে যাবেন না ভাই। আপনি তো আমাদের মন্ত্রী।’
তাবলীগী সেই সাথী ভাইকে থামিয়ে দিয়ে শেখ মোহাম্মাদ আবদুল্লাহ বলে উঠলেন, ‘দেখুন আমি শুধু আপনাদের (তাবলীগ জামাতের) দুই গ্রুপের মন্ত্রী না। বাংলাদেশের মুসলিম সম্প্রদায়সহ হিন্দু, খ্রীষ্টান ও বৌদ্ধদেরও মন্ত্রী আমি। সুতরাং কোনো একটি গ্রুপের সাথে চলা আমার আদর্শ না।’
বহুকাল ধরে বহু আলেম-উলামাসহ অনেক ইসলামী ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশের সব মত ও পথের আলেম-উলামা ও পীর-মাশায়েখদের ঐক্যবদ্ধ একটি প্লাটফর্মে সমবেত করতে সভা-সেমিনার, মিছিল-মিটিংসহ বহু কাজ করেছেন। আলেম-উলামা ও পীর-মাশায়েখদের ঐক্যবদ্ধ করার সেসব মহতি প্রচেষ্টা অল্পবিস্তর সফল হলেও বৃহৎ আকারের সাফল্যমন্ডিত কোনো সূর্য এ দিগন্তের আকাশে উদিত হয়নি। কোনো ‘এজেন্ডা’ ছিল কিনা জানি; মন্ত্রনালয়ে অবস্থিত শেখ আবদুল্লাহর রূমে বাংলাদেশের সব মত ও পথের আলেম-উলামা এবং পীর-মাশায়েখদের আনাগোনার সাক্ষী আমার এ ক্ষুদ্র চোখদ্বয়। শুধুমাত্র বিশেষ একটি তথাকথিত ইসলামপন্থী গ্রুপের কোনো সদস্য ছাড়া প্রায় সব ঘরানার; সব মত ও পথের ইসলামপন্থীদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে মোসাফাহা এবং বুকে বুক মিলিয়ে মোলাকাত করতে দেখেছি তাকে। সকাল ১০ টায় চরমোনাইর হুজুরের প্রতিনিধি, ১২ টায় ছারছীনা হুজুরের খলিফাগণ, দুপুরে তাবলীগী সাথীরা, বিকেল কওমী আলেম-উলামা, সন্ধ্যায় আলিয়ার হুজুর এবং রাতে পীর-মাসায়েখ- দিনের পর দিন ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহ কাছে এভাবে সবাইকে মিলিত হতে দেখেছি। অকপটে বলতে চাই- আমার আবদুল্লাহ ভাই ছিলেন বাংলাদেশের সব মত ও পথের এবং সব আকিদা-মতাদর্শের আলেম-উলামা ও পীর-মাশায়েখদের আস্থার সম্মিলনস্থল।
রাজনীতিতে শেখ আবদুল্লাহ যেমন ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহ্যধন্য আদর্শ সৈনিক; ধর্ম পালন ও আধ্যাত্মবাদের সাধনায় তেমন ছিলেন অলিকুল শিরোমনী সদর সাহেব হুজুর আল্লামা শামসুল হক ফরিদপুরি (রহ.)-এর সংস্পর্শ শুভ্রতায় আলোকিত শিষ্য। বহু বক্তৃতায় তিনি বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমার রাজনৈতিক নেতা। আর আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরি (রহ.) আমার ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক নেতা।’
শুধু কথায় না, চলায়-বলায় জীবনের পরতে পরতে অনুসরণ করতেন সদর সাহেব হুজুরকে। আধ্যাত্মিক গুরু মানতেন তাকে। ইহলৌকিক-পরলৌকিক বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ ও দিক-নির্দেশনা নেওয়ার জন্য ছুটে যেতেন হুজুরের দরবারে। মাদরাসা ছেড়ে পড়াশুনা শুরু করেছেন স্কুল-কলেজে কিন্তু সব সময় আন্তরিক যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন আল্লামা শামসুল হক ফরিদপুরির সঙ্গে। রাজনীতির ময়দানে কাজ করেছেন বলে ভুলে যাননি তার শিকড়। প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার সাথে সাথে ছুটে গিয়েছেন হুজুরের কবর জিয়ারতে। মৃত্যু পর্যন্ত নিষ্ঠা ও আন্তরিকাতর সঙ্গে আলোকিত রাখেন সদর সাহের হুজরের শিষ্যত্বের মশাল।
আবদুল্লাহ ভাই এমন একটি চেয়ারে সমাসীন ছিলেন; যে চেয়ারের চারটি পায়া ধরে চারদিক থেকে সব সময় টানাটানি চলতো। মন্ত্রীত্ব গ্রহণের দিন থেকে শুরু করে ইন্তেকাল করার দিন পর্যন্ত- আসলে এই পদ ও পদবিগুলো মনে হয় এমনই।
জীবনে আরও যে কয়জন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মিশেছি; প্রায় সবার অবস্থা এমনটাই দেখেছি। বিরোধী দলের লোকের কথা তো বাদই দিলাম, একই দলের একই চেতনার লোকজনও ছুতো খুঁজতে থাকে হরহামেশা। কায়দাকে বেকায়দা বানিয়ে টেনে নামানোর ধান্দায় থাকে পদ ও পদবি প্রার্থীরা।
জাতীয় ইমাম সমাজের আয়োজনে শেখ আবদুল্লাহ প্রদত্ত বক্তব্য নিয়ে প্রোপাগান্ডামূলক একটি লীলাখেলা শুরু হলো। বক্তব্য প্রদানের এক মাস পর শুরু হলো তার বক্তব্য নিয়ে তর্ক-বির্তক। এটা কেন বললেন তিনি, কেনই বা এভাবে বললেন কথাটা। আরও নানারকম কাদা ছোড়াছুঁড়ি। সংবাদটা যখন পেলেন তিনি; তখন তিনি লন্ডনে। খবর পৌঁছানোমাত্র ভিডিও বার্তায় ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। বললেন, ‘কি হয়েছে না হয়েছে সেটা পরে দেখা যাবে- আলেম-উলামাদের শানের খেলাফ কথা বলার আপত্তি যেহেতু উঠেছে; নিঃশর্তভাবে আমি ক্ষমা চাচ্ছি। আমি এখন দেশের বাইরে আছি; দেশে এসে এ সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করবো এবং আমি দোষী হলে আলেম-উলামাগণ আমাকে যে শাস্তি দিবেন মাথা পেতে বরণ করে নেবো।’
একজন রানিং প্রতিমন্ত্রী তিনি, চাইলেই এসব তর্ক-বির্তকে ভ্রুক্ষেপ না করে চলতে পারতেন নিজের মতো করে। কারণ তিনি জানতেন তার খুঁটির জোর কতটুকু। কিন্তু সেটা তিনি করলেন না। দেশে এলেন এবং দেশের শীর্ষস্থানীয়সহ বিভিন্ন শ্রেণীর আলেম-উলামার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। সভায় গেলেন। এমনকি ফোনে কথাও বললেন কারো কারো সঙ্গে।
তার ব্যাপারে আলেম-উলামা ও পীর-মাশায়েখদের ভুল ভাঙানোর জন্য যতকিছুই তখন করেছেন তিনি; সবটুকুজুড়ে একটি বার্তাই বিরাজমান ছিল- আলেম-উলামা ও পীর-মাশায়েখদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসা। যতজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, যতগুলো সভা-সেমিনারে অংশ গ্রহণ করেছেন এবং যতজনের সঙ্গে টেলিফোনের কথা বলেছেন- সর্বাগ্রে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছেন, এরপর বিস্তারিত কথা বলেছেন। একজন মানুষ ক্ষমা চাইলে অন্য মানুষ ক্ষমা করুক আর না করুন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী মহান প্রভু ক্ষমা করেন। এবারও সেটাই হলো। দরবারে এলাহীতে কবুল হলেন তিনি। কেটে গেল প্রোপাগান্ডার মেঘ। আবার উদিত হলো সত্য-সুন্দরে বার্তাবাহী সূর্য। সব বির্তকের অবসান হলো এবং স্বস্তির নিশ্বাস নিলেন শেখ আবদুল্লাহ।
সর্বশেষ, শেখ আবদুল্লাহ ভাইয়ের মৃত্যুর কিছুদিন আগের ঘটনা। লাল সবুজের বাংলাদেশে মাত্র আঘাত হেনেছে করোনাভাইরাস। বিদেশফেরত দু-একজনের শরীরে এই মহামারির বীজ সনাক্তও হয়েছে সবে। মসজিদে জামাতে নামাজ আদায় নিয়ে কথা হচ্ছে নানা দিকে। শুরু হয়েছে অল্পবিস্তর সমালোচনাও। ইসলামিক ফাউন্ডেশনে আলেম-উলামাদের মতবিনিময় সভা আয়োজিত হলো। নেপথ্য কারিগর ধর্ম প্রতিমন্ত্রী। তার নির্দেশনায় দুই দফায় সব ঘরানার বিশেষজ্ঞ আলেম-উলামাগণ উপস্থিত হলেন সে সভায়। হলফ করে বলতে পারবো- ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক আয়োজিত অতীত ইতিহাসের কোনো মতবিনিময় সভায় সেবারের মতো সব মত ও পথের আলেম-উলামাগণ আর কখনো আমন্ত্রিত হননি এভাবে। প্রতিবেদন করার স্বার্থে বিষয়টি নিয়ে ফোনে কথা হচ্ছিল আবদুল্লাহ ভাইয়ের সঙ্গে। নিজে থেকে জানতে চাইলেন, ‘মিরাজ! করোনা বিষয়ক সভায় সব ঘরানার আলেম-উলামাগণকে আমন্ত্রণ জানানোটা ভালো হয়েছে না রে?’
আমার মতো ক্ষুদ্র একজন সাংবাদিকের কাছে মতামত জানতে চাওয়া তার উদারতা বৈ অন্য কিছু নয়। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘এমনটা করার কি দরকার ছিল ভাই?’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘এদেশটা শুধু কওমীপন্থী অথবা শুধু আলিয়াপন্থী আলেমদের কারো একার নয়। সবারই কমবেশি অনুসারী রয়েছে এদেশে। সুতরাং সঠিক মতামত গ্রহণ করার স্বার্থে সব মত ও মতাদর্শের আলেম-উলামা ও পীর-মাশায়েখদের সঙ্গে নিয়ে চলাই অধিক প্রাসঙ্গিক।’
তার রাজনৈতিক জীবন, রাজনীতির সঙ্গে তার বসবাস, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীময় তার সংসারের কোনো খবর আমি নেইনি কারণ রাজনীতি আমার বিষয় না। তাকে আমি প্রথম পেয়েছি আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে; পরে পেয়েছি ধর্ম প্রতিমন্ত্রী হিসেবে; সুতরাং তার সঙ্গে আমার যত আদান-প্রদান সবই ছিল ধর্মকেন্দ্রিক। আর এ জন্যই তার রজনৈতিক জীবনকে বাদ দিয়ে আমি তার ধর্মচর্চায় মনোনিবেশ করেছি এবং আজও তার সমান্তরাল ধর্মচর্চা নিয়েই লিখছি।
অবশেষে চলে গেলেন তিনি। বিদায় নিলেন পৃথিবী নামের এ গ্রহ থেকে। এপার ছেড়ে পাড়ি জমালেন ওপারে। এমন জগতে গেলেন চলে; সেখানে গেলে আর ফেরা যায় না। ফিরে আসার নামও নেওয়া যায় না। ওটাই আওবার আসল ঠিকানা। ওখানেই যেতে হবে সবাইকে একদিন- কেউ আগে; কেউবা পরে। ‘কুল্লু নাফছিন জাঈকাতুল মাউত- প্রত্যেক প্রাণি মরণশীল।’
যতদিন বেঁচে আছি আর কোনো দিন চর্মচোখে দেখবো না তাকে। হবে না কোনো কথা আর। কখনো আর ‘বড় ভাই’ বলে ডাকা হবে না তাকে। তিনিও কোনোদিনই আর বলবেন না ডেকে, ‘আয় মিরাজ! একসঙ্গে আজ ভাত খাই।’
কোনো সান্ত্বনা নেই; নেই কোনো সমবেদনাও। সুখ ও শান্তির কথা শুধু একটাই- আমার বিশ্বাস একজন ‘জান্নাতি ধর্ম প্রতিমন্ত্রী’র সঙ্গে কিছু সময় কেটেছে আমার। ‘এ অর্জন অথবা এ প্রাপ্তি বাহুবলে অর্জিত কোনো সৌভাগ্য নয়। মহান প্রভুর ভালোবাসায় সিক্ত এক অঞ্জলিদান মাত্র।’
লেখক: সম্পাদক, ইসলাম প্রতিদিন
অ্যাডভোকেট শেখ মো. আব্দুল্লাহ ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ