শরণার্থীরা তাদের অধিকার ফিরে পাক
২০ জুন ২০২০ ১৬:৪৪
শরণার্থী বলতে বোঝানো হয় বাস্তুহারা, অধিকার হারা, অত্যাচারিত ও নিপীড়িত এক শ্রেণীর গোষ্ঠীকে। আর তাই প্রতিবছর জুন মাসের ২০ তারিখ বিশ্বজুড়ে শরণার্থীদের অমানবিক অত্যাচার বন্ধ ও তাদের অধিকার ফিরে পাবার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক নেতৃবৃন্দের সচেতনতা সৃষ্টির জন্য বিশ্ব শরণার্থী দিবস পালন করা হয়ে থাকে। বিশ্ব শরণার্থী দিবসটি অনেক শোষিত শ্রেণীর মানুষদের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং এর তাৎপর্যও অনেক গভীর।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ২০০০ সালের ডিসেম্বরের ৪ তারিখ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের (General Assembly) অধিবেশনের ৫৫/৭৬ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০০১ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী জুন মাসের ২০ তারিখ ‘বিশ্ব শরণার্থী দিবস’ (World Refugee Day) পালিত হয়।
উল্লেখ্য, ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত সংঘটিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নানা রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংকটের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শরণার্থীর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়তে থাকে। কিন্তু তখন পর্যন্ত শরণার্থী বলতে কী বোঝায়, শরণার্থী কারা, তাদের অধিকার কী এবং তাদের প্রতি আশ্রয় প্রদানকারী রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য কী এবং নিজ দেশ থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে অন্য দেশে শরণার্থী হিসাবে আশ্রয় নেওয়া মানুষদের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব-কর্তব্য কী হবে, তা নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে লিখিত আন্তর্জাতিক কোনও আইনি বাধ্যবাধকতা বা সর্বজন গ্রহণযোগ্য কোনও সনদ ছিল না।
১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে (The Universal Declaration of Human Right) শরণার্থীদের ক্ষেত্রেও মানুষ হিসাবে বিভিন্ন ধরনের মানবাধিকার প্রাপ্য বলে স্বীকার করা হলেও সুনির্দিষ্টভাবে শরণার্থীদের জন্য কোনও অধিকার সনদ তখনও ছিল না। এ রকম একটি প্রেক্ষাপটে ১৯৫০ সালের ডিসেম্বরের ১৪ তারিখ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে জাতিসংঘের একটি স্বতন্ত্র অঙ্গ হিসাবে Office of the United Nations High Commissioner for Refugees (UNHCR) প্রতিষ্ঠা করা হয়, যা বিশ্বব্যাপী the UN Refugee Agency হিসাবে পরিচিত। এ UNHCR এর কার্যক্রমকে একটি আন্তর্জাতিক বিধিবিধানের আওতায় আনার জন্য ১৯৫১ সালে একটি আন্তর্জাতিক শরণার্থী কনভেনশন (১৯৫১ Convention relating to the Status of Refugees) জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে স্বাক্ষরিত হয়, যা আন্তর্জাতিকভাবে ‘জাতিসংঘের শরণার্থী সনদ’ হিসাবে পরিচিত।
এ সনদের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০০০ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের আরেক অধিবেশনে পরের বছর থেকে অর্থাৎ ২০০১ সাল থেকে জুন মাসের ২০ তারিখ ‘বিশ্ব শরণার্থী দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কেন জুন মাসের ২০ তারিখকে ‘বিশ্ব শরণার্থী দিবস’ ঘোষণা করা হয়, তারও একটা তাৎপর্যপূর্ণ ইতিহাস ও ব্যাখ্যা আছে। ১৯৬৩ সালের ২৫ মে ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবায় আফ্রিকার ৩২টি দেশ স্বাক্ষর করে সম্মিলিতভাবে গঠন করে Organization of African Unity (OAU), যা ২০০২ সালের জুলাইয়ের ৯ তারিখ দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি থাবু এমবেকির নের্তৃত্বে African Union (AU) নাম ধারণ করে।
আফ্রিকার ৩২টা দেশের এই Organization of African Unity (OAU) প্রতিবছর জুন মাসের ২০ তারিখ আন্তর্জাতিক শরণার্থী দিবস (International Refugee Day) পালন করতো। কারণ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি শরণার্থীর বাস ছিল আফ্রিকা। পরবর্তীতে একই দিনে এ দিবস পালন করা হবে এই আশ্বাসে জাতিসংঘের সঙ্গে একত্রিত হয়ে প্রতিবছর জুনের ২০ তারিখ ‘বিশ্ব শরণার্থী’ দিবস পালন করা হয়। ফলে বিশ্ব শরণার্থী দিবসের ইতিহাসের সঙ্গে আফ্রিকার ইতিহাসের এ সম্পৃক্ততা অনস্বীকার্য।
সাম্প্রতিক বিশ্বব্যবস্থায় ভিন্ন ভিন্ন ভাষা, জাতিসত্তা, সংস্কৃতি, ধর্ম, এবং মতাদর্শের মানুষের প্রতি পৃথিবীর দেশে দেশে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা এবং ক্রমবর্ধমান হারে অপশ্চিমা দেশগুলোতে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় হাজার হাজার-লক্ষ লক্ষ মানুষকে নিজে দেশ ছেড়ে অন্য দেশে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য করছে। ফলে শরণার্থী সমস্যা একটি অন্যতম আন্তর্জাতিক সমস্যা হিসাবে সৃষ্টি হয়েছে।
জাতিসংঘের এক হিসাব অনুযায়ী, প্রতি মিনিটে পৃথিবীতে ২০ জন লোক নিজের দেশ ত্যাগ করছে প্রধানত যুদ্ধ, অত্যাচার এবং নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য। দেশত্যাগী এসব মানুষ বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন নামে পরিচিত, যেমন: শরণার্থী, আশ্রয়প্রার্থী, রাষ্ট্রবিহীন মানুষ, অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত মানুষ কিংবা জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষ।
বিশ্ব শরণার্থী দিবস উপলক্ষে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) প্রকাশিত বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে শরণার্থীর সংখ্যা এখন সবচেয়ে বেশি। বর্তমানে শরণার্থী সংখ্যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক শতাংশ। ২০১৯ সালের শেষে শরণার্থীর মোট সংখ্যা ৭ কোটি ৯৫ লাখ। ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশ্বে শরণার্থী সংখ্যা ছিল ৭ কোটি ৮ লাখ। এ হিসেবে এক বছরে শরণার্থীর সংখ্যা বেড়েছে ৮৭ লাখ।
বার্ষিক ‘গ্লোবাল ট্রেন্ডস রিপোর্ট’ শিরোনামে ইউএনএইচসিআর এর এই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ সালের শেষে সারাবিশ্বে ৭ কোটি ৯৫ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত অবস্থায় আছেন। ইতিহাসে এর আগে এত মানুষ কখনও গৃহহারা ছিলেন না। একই সঙ্গে বিশ্বে শরণার্থী সংকটের বর্তমান চিত্র বলে দিচ্ছে। শরণার্থীদের দুর্দশার দ্রুত সমাপ্তির আশাও দিন দিন কমে যাচ্ছে। ৯০-এর দশকে প্রতি বছর গড়ে ১৫ লাখ মানুষ প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে নিজ দেশে ফিরতে পারতেন। চলতি দশকে এ সংখ্যা কমে ৩ লাখ ৯০ হাজারে পৌঁছেছে। এটা প্রমাণ করছে শরণার্থী সংকটের স্থায়ী সমাধান ক্রমশ জটিলতর হচ্ছে।
প্রতিবেদনে ক্রমান্বয়ে শরণার্থীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার জন্য দু’টি প্রধান কারণের কথা তুলে ধরা হয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে, নতুন বাস্তুচ্যুতির বিভিন্ন ঘটনা- বিশেষত গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গো, পশ্চিম আফ্রিকার সাহেল অঞ্চল, ইয়েমেন ও সিরিয়ার সংঘাত। সংঘাতপূর্ণ আফ্রিকায় গত নয় বছরে ১ কোটি ৩২ লাখ হয় শরণার্থী, আশ্রয়প্রার্থী বা আভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। এ সংখ্যা বৈশ্বিক বাস্তুচ্যুতির ছয় ভাগের এক ভাগ।
দ্বিতীয় কারণ হিসেবে আছে- নিজ দেশের বাইরে অবস্থানরত ভেনেজুয়েলার মানুষের পরিস্থিতি সম্পর্কে গত এক বছরে পাওয়া বিশদ তথ্য। তাদের অনেকেই আইনত শরণার্থী বা আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে নিবন্ধিত নন, কিন্তু সুরক্ষা ও সহায়তা তাদেরও প্রয়োজন।
২০১৭ সালে ২৭ লাখেরও বেশি শরণার্থী নিজ দেশ থেকে অন্য দেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। এদের ৮৮ শতাংশই মাত্র তিনটি দেশ দক্ষিণ সুদান, সিরিয়া, মিয়ানমারের। তবে শরণার্থীদের আশ্রয়দানকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে যা মানবিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। দেশে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ফলে স্থানীয় বাসিন্দা ও সম্পদের ওপর তীব্র চাপ সৃষ্টি হয়েছে যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছেই। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের একটি বৃহৎ অংশ ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। তাদের অর্ধেকের বেশির বয়স ১৮ বছরের নিচে, অর্ধেকের বেশি নারী ও মেয়ে শিশু এবং এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত পরিবারের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে বলে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের অনেকেই নিজ দেশে যৌন নির্যাতন এবং মানসিক আঘাতসহ চরম সহিংসতার মুখোমুখি হয়েছেন। অত্যাচার-নিপীড়ন বন্ধের ও তাদের শরণার্থীদের অধিকার ফিরে পাবার জন্যই পালিত হয় বিশ্ব শরণার্থী দিবস। বিশ্ব শরণার্থী দিবসকে কেন্দ্র করে সকল শরণার্থী ফিরে পাক তাদের নিজ অধিকার।
লেখক: শিক্ষার্থী ও সংবাদকর্মী, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়