করোনায় বদলে যাওয়া রাষ্ট্র, বদলে যাওয়া মন
২০ জুন ২০২০ ১৬:৫২
করোনা- একটি ভাইরাসেরই নাম। নিজস্ব পন্থায় শরীরে প্রবেশ করে ভেতরটায় তৈরি করছে অস্বাভাবিক কিছু! ঘায়েল হয়ে স্বাভাবিকতা হারিয়ে কাতরাচ্ছে মানুষ। উল্লেখযোগ্য হারে প্রাণও হারাতে হচ্ছে মানুষকে। করোনা কি, কীভাবে, কেন আক্রান্ত করছে মানুষকে এ নিয়ে আলোচনা ঢের হয়েছে, হচ্ছে, হবে।
কিন্তু করোনার অন্য রুপ নিয়েও তো আলোচনার প্রয়োজন বিশদ পরিসরে। যে রুপে করোনা প্রথম বাংলাদেশে হানা দিয়েছে তার সে রুপ বদলেছে। সে তার রুপে আরও কিছু বৈশিষ্ট্য সংযোজন করেছে। যেগুলোর প্রভাব আমরা সরাসরিই পেয়েছি। যে প্রভাব বিস্তৃত হয়ে আক্রান্ত করেছে আমাদের সমাজ ব্যবস্থাকেও। রাষ্ট্রকেও করেছে নানাভাবে আক্রান্ত, প্রশ্নবিদ্ধ। করোনা যেমন নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত মানুষকে সহজেই মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাচ্ছে, তেমনি সে ঘুণে ধরা কিছু রাষ্ট্রীয় খাতকেও তুলে ধরেছে মুমূর্ষু অবস্থায়। পাশাপাশি করোনা আমাদের সত্তা, আচরণকেও করেছে তুলোধুনো।
করোনা সবচেয়ে বেশি প্রশ্নবিদ্ধ করেছে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে উল্লিখিত মৌলিক অধিকারের গুরুত্বপূর্ণ একটি ধারাকে৷ যে ধারায় মানুষের বেঁচে থাকার নিয়ামক হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলেই ‘চিকিৎসা’কে স্থান দেওয়া হয়েছে। বলতে পারে কেউ, করোনারতো চিকিৎসা নেই। কিন্তু একটু শান্তিতে মরতে দেওয়ার আয়োজনতো রাষ্ট্র করতে পারে। সংবিধান এতটুকু অধিকারতো দিয়েছে নাগরিককে। ৫০ বছরেও যে নিরাপদ মৃত্যু রাষ্ট্র নিশ্চিত করতে পারলো না তা করোনা-ই প্রমাণ দিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু কীভাবে? উত্তর হল— দুয়ার থেকেই শ্বাসকষ্ট রোগী তাড়াচ্ছে হাসপাতালগুলো। রোগীকে আগে ভর্তি করিয়ে টেস্ট করানো হতো কি কি রোগ আছে তা জানতে। এখন রোগীকে হাসপাতালের বাইরে রাস্তায় রেখে আগে টেস্ট করে দেখা হচ্ছে ভর্তি করানো যায় কিনা! হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মনমতো রোগী হলে ভর্তি করাবে, না হলে করাবে না।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জোবায়ের চৌধুরীর বাবার কথাই বলি। ঘরে যখন অসুস্থবোধ করলো তার বাবা, তখনই চট্টগ্রাম ন্যাশনাল হাসপাতালের নাম্বারে কল দিল জোবায়ের। জানালো, তার বাবার মাথায় তীব্র ব্যথা, হাত অবশ হয়ে আসছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বললো, নিয়ে যেতে। তারা এও বললো, ভর্তি করাবে।
কিন্তু তার বাবাকে যখন আনা হল, দুয়ারেই অক্সিজেন সেচ্যুরেশন দেখে তাড়ালো ন্যাশনাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পত্র-পত্রিকায় আমরা সেটাই দেখলাম। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এ সময় দুইটা অপরাধ করলো। ১. চিকিৎসা না দেওয়া ২. রোগীর স্বজনকে কথা দিয়েও ভর্তি না করা। যদিও এসব ঘটনায় কোনো মামলা, অভিযোগ হবে না। কারণ তার পরিণতিও জানা আছে নাগরিকের।
চট্টগ্রামে ঘটে যাওয়া এমন কিছু অভিযোগ জেনেই প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে অভিযান চালানোর নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু এই অভিযান চালানোর আগেই ঘটা করে প্রচার করে দিল কেউ। ঘটা করে ঘোষণা দিয়ে অভিযান চালিয়ে কি এই হাসপাতালগুলোর কুকীর্তি ধরা সম্ভব? এ যেন ‘চোর ধরতে যাওয়ার আগে চোরকে জানিয়ে দেয়ার’ গল্পের মতন কিছু একটা! যথারীতি রাষ্ট্রের প্রশাসন অভিযান চালিয়েও হাসপাতালগুলোর অনিয়ম দেখলো না।
ফলাফল, মরতে থাকবে মানুষ। একটু অক্সিজেন না পেয়ে নিদারুণ কষ্টেই মরতে থাকবে। একজন প্রধানমন্ত্রী ছাড়া রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের স্বাস্থ্যসেবা খাত দেখার দায়িত্বে থাকা আর কারও যেন এই রাষ্ট্রের মানুষের জীবন বাঁচানোর তৎপরতা মুখ্য নয়। তবে আমি চাই এ আমার কথাগুলো মিথ্যে হয়ে যাক।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে রাতে কোনো চিকিৎসক থাকে না। এই হাসপাতালে করোনা রোগী ভেবে অসুস্থ চিকিৎসকেরই চিকিৎসা দিতে কোনো চিকিৎসক পাওয়া গেল না চার ঘণ্টায়ও! এমন খবরও আসছে গণমাধ্যমগুলোতে! কি ভয়ংকর চিত্র!
আরও কষ্টের বিষয় আছে। জীবনবাজি রেখে যে হাসপাতালে স্বাস্থ্যকর্মী কাজ করছে, প্রশাসনিক জটিলতার কারণে তিন মাস বেতন-ভাতা পাননি তারা। করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের ৩৬ জন চতুর্থ শ্রেণীর অস্থায়ী স্বাস্থ্যকর্মীর ভাগ্যের পরিণতি এমনই। শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল তাদের বেতন দিতে অনুদান দিলেন বলেই এ বিষয়টি জানাজানি হল। চিকিৎসকের বেতনও নাকি মিলেনি কোথাও কোথাও!
কোভিড আর নন-কোভিড হাসপাতাল ভাগ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন সরকারকে অনেক বিশেষজ্ঞ। তাও অনেক আগেই। যদি এই পরামর্শ শোনা হতো তখন, তাহলে কিছু প্রাণ অন্তত বাঁচানো যেত। এখন লাশের সারি লম্বা হচ্ছে।
এদিকে রাষ্ট্রের মন্ত্রনালয় একের পর এক প্রজ্ঞাপন জারি করেই যাচ্ছে। চিকিৎসা দিতে হবে। না দিলে আইন অমান্য হবে। আইন অমান্য হলে কি হবে, বা আইন অমান্য হওয়ার ফলে কোনো হাসপাতালের লাইসেন্স বাতিল হল কিনা তা আমরা জানিনা।
হাসপাতাল কিংবা চিকিৎসা-বাণিজ্য করে ফুলেফেঁপে ওঠা লোকজন তাই এসব প্রজ্ঞাপনে চোখ বুলিয়ে রেখে দিচ্ছে লাল ফিতার ফাইলে! রাজনীতিকরা হুমকি দিচ্ছেন, ‘হাসপাতালে রোগী ভর্তি না করা করালে হ্যান করবেন, ত্যান করবেন’।
খবর নিলে মিলবে হয়তো রাজনীতিবিদদেরই নানা হিসেবনিকেশের বেড়াজালে ‘বন্দি’ এই হাসপাতালগুলোর আয়োজন! হাসপাতাল নিয়ে চিকিৎসক নেতাদের রাজনীতিও পরিলক্ষিত হয়েছে চরমভাবে। কোনো রাজনীতিক এই হাসপাতালের সাফাই গাচ্ছে, কোনো রাজনীতিবিদ ওই হাসপাতালের সাফাই গাচ্ছে। অথচ নানা অজুহাতে এরাই রোগী ভর্তি করাচ্ছে না।
আবার মানুষই বা কেমন হয়ে গেল করোনাকে দেখে কিংবা না দেখে। লাশটাও দাফন করতে দিচ্ছে না কোথাও কোথাও। নিজ গ্রামে লাশ দাফন করতে না পেরে পাশের উপজেলায় নিয়ে গিয়ে দাফন করতে হল। চট্টগ্রামের রাউজানের বাসিন্দা কলেজ শিক্ষকের মরদেহ নিয়েই রচিত হল করোনায় এই অঞ্চলের মানুষের নির্মম, নির্দয় আচরণের বাস্তব গল্পটি।
নানা ছাঁচে ঢেলে করোনার এ সময়ের চরম এসব বাস্তবতাকে মাত্র দুটি বাক্যের ভেতর দিয়ে প্রতিফলন ঘটাতে দেখলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক ও গবেষক প্রফেসর ড. রহমান নাসির উদ্দিনকে।
তিনি করোনাকে দেখছেন যেভাবে, আসলে করোনা সেটাই! করোনা কি শুধুই কোনো ভাইরাস, যা শুধু রোগ হিসেবে কেবল আক্রান্ত করছে মানুষকে? করোনা কি কোনো রোগের নাম, যা মানুষকে আক্রান্ত করে মৃত্যুর দিকে ঠেলছে শুধু? আসলে কিন্তু করোনা তা নয়। করোনাকে এখন সামাজিক ব্যাধি হিসেবে দেখানো সম্ভব উপরে বর্ণিত এত কথার স্রোতে। আবার সমাজে জেঁকে বসা নানা ‘রোগ’ও কিন্তু করোনার সময়ে স্পষ্ট হয়েছে। উতলে উঠেছে রাষ্ট্রীয় নানা ‘ব্যাধি’ও। করোনা যে বিশ্বভ্রমান্ডের প্রতি ইঞ্চি জুড়ে নানা রুপে প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে তা কিন্তু সে-ই প্রমাণ করেছে! আরেকটু স্পষ্ট করে বললে, শতভাগ মরণব্যাধি না হলেও, আগ্রাসী রোগ হিসেবে মানুষের স্বভাবজাত আচরণ কিংবা মানবিক/অমানবিক সত্তার অবধারিত পরিচায়ক হিসেবে নিজের স্থান গড়ে নিয়েছে করোনা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক, নৃ-বিজ্ঞানী হিসেবে খ্যাত প্রফেসর ড. রহমান নাসির উদ্দিনের দুই বাক্যের একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসেই সুচারুভাবে এ বিষয়টিই উপস্থাপিত হয়েছে বলে আমার ধারণা। তিনি লিখেছেন, ‘করোনা ভাইরাস হচ্ছে একটা স্বচ্ছ লেন্স যার ভেতর দিয়ে অনেক কিছু দেখা যায়! রাষ্ট্র, সমাজ, মানুষ, মানবতা, সম্পর্ক এবং স্বাস্থ্যসেবা… সবকিছু!’
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথিতযশা এই শিক্ষকের এ স্ট্যাটাস দেখেই করোনা নিয়ে নানা স্তরের ভাবনাগুলোকে মুঠো করে উপস্থাপন করতে আমার আজকের এই প্রয়াস। তাঁর এই দু’বাক্যের আয়োজনই নির্দেশ করে করোনায় বদলে যাওয়া গোটা রাষ্ট্রকে, বদলে যাওয়া কোটি কোটি মনকে!
আজকে অনেকটা হতাশ আমরা। বিশ্বাসও হারিয়ে ফেলছি। কোথায় যাব, কার কাছে যাব- একটু সাহস, ভরসা কার কাছে পাব?
লেখক: প্রাবন্ধিক ও সাবেক সহ সভাপতি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি