মার খাওয়ার জন্য ডাক্তার হবে!
২০ জুন ২০২০ ১৭:৩৯
আমার দাদা একজন ডাক্তার ছিলেন। নেয়াজুর রহমান তাঁর নাম। তিনি নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বামনীর পেশকারহাটের বাসিন্দা ছিলেন। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তিনি। শুনেছি ওই অঞ্চলে তিনিই প্রথম মুসলমান চিকিৎসক। দাদা সরকারি মেডিক্যাল অফিসার থাকার সুবাদে বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে দায়িত্ব পালন করেছেন। দূর-দূরান্তে তিনি চিকিৎসা দিতে ছুটে যেতেন। সেই সময় এখনকার মতো উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। থাকার কোনো সুবিধা ছিল না। তবুও দায়িত্ব পালনে কখনো কোন অবহেলা করেননি তিনি। বহুপথ, যে পথগুলো ছিল কর্দমাক্ত, এসব পথে কখনো সাইকেলে কিংবা পায়ে হেঁটে গিয়ে চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন। অনেক রোগী ও তার পরিবার দাদার চিকিৎসায় ভীষণ খুশি হয়েছেন। শ্রদ্ধা করতেন তাকে। শ্রদ্ধা এমন ছিল যে কেউ কেউ তাদের পরিবারে নতুন কেউ ভূমিষ্ঠ হলে দাদার নামে নাম রেখে দিতেন, এইরকম বহু গল্প-বহু মিথ চালু আছে। দাদা সরকারি চাকরি শেষে পেশকারহাটে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় খোলেন। সেখানে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মানুষকে নিস্বার্থভাবে চিকিৎসা দিয়ে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও নিরবে-নিভৃতে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিয়েছেন।
ছোটবেলায় আমি যে পাড়ায় বড় হয়েছি, সেই মাস্টারপাড়ায় একজন ডাক্তার ছিলেন। ডা. জাকারিয়া সাহেব। সবাই তাকে এভাবে চেনে। তখন দেখেছি, অনেক মানুষ তার কাছে চিকিৎসা নিতে এসেছেন। আমি ও আমার পরিবার তার কাছ থেকে বহু চিকিৎসা নিয়েছি। তিনি শুধু চিকিৎসা করতেনই না, নিজ হাতে রক্ত পরীক্ষা, ইউরিনের পরীক্ষা করতেন। সেই সময়ে এখনকার মতো ডায়াগনস্টিকের ব্যবস্থা ছিল না। তিনিও আমার দাদার মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলে সাইকেলে করে চিকিৎসা দিয়ে আসতেন।
তাদের মননে ছিল মানবসেবা, তাদের দেশপ্রেম-মানবপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে একসময় ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখেছি। একদিন আমিও মানুষের সেবা করব। মানুষের চিকিৎসা করব- এই স্বপ্ন মনের মধ্যে ছাপা হয়। কিন্তু নিজের অসুস্থতার কারণে আমার আর বিজ্ঞান বিভাগে পড়া হয়নি। আর চিকিৎসা বিদ্যা নেওয়ার আশাটুকু শেষ হয়ে যায়। এখন ভাবছি, আমি ডাক্তার হইনি, ভালো হয়েছে। নাহলে রোগীর স্বজনদের হাতে মার খেতে হতো। তবে কৃতজ্ঞতাটুকু জানানো ভালো, আমি এখন যতটুকু সুস্থ আছি, তা ডা. রশিদ উদ্দিন, ডা. এম আর খান, ডা. গোলাম হায়দার, ডা. শামীম আহসান, ডা. আবদুল্লাহ আল মাসুদদের মতো ডাক্তারদের কল্যাণে।
এই মুহূর্তে শ্রদ্ধাভাজন অধ্যাপক ডা. আবু সাঈদ স্যারের কথা বলতে ইচ্ছে করছে, তিনি স্বেচ্ছাসেবকের মতো তার টিম নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মেহনতি-শ্রমিক গরীব মানুষদের চিকিৎসা দিয়ে আসছেন। এইরকম আরো অনেক চিকিৎসক বাংলাদেশে আছে। আমার রাজনৈতিক সহযোদ্ধা ডা. সাজেদুল হক রুবেল বিভিন্নজনকে বিনা ফি-তে দাঁতের চিকিৎসা দিচ্ছেন। অথচ তিনি নিজেই করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন।
আমার পরিবারের অনেকে চিকিৎসা পেশার সাথে জড়িত। বন্ধু-স্বজনরা কেউ কেউ এখন চিকিৎসক। যখন থেকে চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়ালেখা শুরু করেছে তারা, তখন থেকে একধরনের শপথ নিয়েছে, মানুষের সেবা করবে তারা। খুব কাছ থেকে আমি দেখেছি, তারা কতটুকু আন্তরিকভাবে চেষ্টা করে বিভিন্ন সময়ে রোগীকে চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছে। দূরে থেকে হোক, কাছে থেকে হোক মানুষকে যতটুকু সম্ভব সহযোগিতা করে। যখন কিছু করতে পারে না তখন তাদের মনে চরম একটা অস্বস্তিভাব আসে। রোগীকে ভালো করার জন্য মোটা মোটা বই তাদের গিলতে হয়। চেষ্টা করে রোগীকে সর্বোচ্চ ও সর্বশেষ আধুনিক চিকিৎসা দিতে।
অনেক সময়ে রোগীর কাছে টাকা থাকে না টেস্ট করার জন্য, রোগীর মুখ দেখেই নিজের পকেট থেকে টেস্ট করার জন্য টাকা দিয়ে দিচ্ছে। করোনা ভাইরাসের এই সময়টায় সম্মুখযোদ্ধা হয়ে লড়ছেন চিকিৎসকরা। সিলেটের ডা. মঈন থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ৪৭ জন ডাক্তার মারা গেছেন দেশে। আর কত আত্মত্যাগ করলে আমরা বলবো ‘তোমরা আমাদের হিরো’?
দেশের কোথাও কোনো ডাক্তারের ছোট কোনো ভুল হলে সকল ডাক্তারকে ‘কসাই’ বলতে আমরা এক মুহুর্তও কি দেরি করি? শিক্ষকের মাঝেও এমন আছেন যারা টাকা দিয়ে পাশ করিয়ে দেন কিংবা প্রশ্ন আউটে সাহায্য করেন, পুলিশে এমন অনেকে আছেন যারা অন্যায় করেন, ঘুষ নেন- তাই বলে পুরো শিক্ষক সমাজকে আমরা খারাপ বলি না, সব পুলিশ অফিসারই অসৎ নয়। অথচ ডাক্তারের বেলায় ‘কসাই’ গালি সব ডাক্তারের গায়েই লাগে। ডাক্তারদের প্রতি কিছু মানুষের এক ধরনের অ্যালার্জি আছে-বিদ্বেষপূর্ণ অ্যালার্জি।
আমার এক খালা ও খালু সরাসরি হাসপাতালে করোনা টেস্টের সাথে জড়িত। একজন ঢাকায়, আরেকজন রংপুর। আমরা সবাই গত ৩ মাস ধরে যখন বাড়িতে নিজের অবসর কাটাতে কাটাতে ক্লান্ত, খালা-খালু সেই পুরো ৩ মাসই মানুষের সেবা নিয়ে ব্যস্ত। স্বাভাবিক সময়ে তাদের সপ্তাহে ১ দিন ছুটি থাকে। গত ৩ মাসে সাপ্তাহিক ছুটি নেই বললেই চলে। এর বাইরে আবার তারা টেলিফোনে বিভিন্নজনকে চিকিৎসা পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। খালা যখন সকালে বের হন, তার ছোট ছোট ছেলেমেয়ে অনেকদূর থেকে গাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে। সন্ধ্যা পর্যন্ত মায়ের পথ চেয়ে বসে থাকে, মা ছাড়া কারো হাতেই ভাত খাবে না তারা। সন্ধ্যায় মা আসে। ছোট্ট বাচ্চারা তখন দুপুরের খাবার খায়!
আমার নিজের ছোট ভাই সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করেছে ৭ কী ৮ বছর হবে। এরপর বিসিএসের মাধ্যমে সরকারি চাকুরিতে সে যোগদান করে। প্রথম নিয়োগ হয় মৌলভীবাজারের এক প্রত্যন্ত ইউনিয়নে। সেখানে অবসরে বিনামূল্যে রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিয়েছে। কখনো তাকে কোথাও প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে দেখিনি। আমরা অনেকবার তাকে এ ব্যাপারে প্ররোচিত করেছি। তার আগ্রহ নেই। অনেক সময় হয়তো সিনিয়র ডাক্তারের আহ্বানে অপারেশনে সহযোগী হিসেবে ছিল। কিংবা অনুরোধে নিজেও বিভিন্ন ক্লিনিকে অপারেশন করেছে, নিজের প্রাপ্য সম্মানীটুকু নেয়নি। যাতে করে রোগীর জন্য কোনো অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি না হয়। এমনও দেখেছি সাত দিন পর রোগী সুস্থ হলে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরেছে। আমার ভাইকে একবার এক উপজেলায় স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে বদলি করা হয়। মাত্র কয়েক মাস সেখানে ছিল, সেই কয়েক মাসে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কিছু গুণগত পরিবর্তন আনার চেষ্টা করে। আমি আমার পরিবারের কথা বলছি। এইরকম অসংখ্য ডাক্তার আছে, যারা সত্যি মানবসেবায় নীরবে-নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু মাঝে মাঝে চুন থেকে নুন খসতেই আত্মীয়-অনাত্মীয়দের কথাও শুনতে হয় তাদের।
কেউ কি ভেবে দেখেছেন যে অনেক ডাক্তারেরই পারিবারিক জীবন থাকে না প্রায়, সামাজিক জীবনও নেই বললেই চলে। দীর্ঘ দিনরাত চেম্বারের পর পরিচিতজন, বন্ধু, স্বজনদের ফোনে পরামর্শ দিতে দিতে তাদেরও তো ক্লান্তি লাগে। সাত সকালেই আবার তাকে হসপিটাল বা মেডিক্যাল কলেজে দৌড়াতে হয়। এই ফোনে পরামর্শ যদিও আমরা ফ্রি-ই নেই, তবে একবার যদি ডাক্তার ফোনটা ধরতে পারে না, অনেক সময় ডাক্তার ওটিতে থাকে কিংবা রোগীর চিকিৎসা দিচ্ছে, সেই মুহূর্তে ডাক্তারের পক্ষে ফোন ধরাটা সম্ভব হয় না। তখন কিন্তু আমরা ‘শালা কসাই’ বলে চিৎকার করে গালি দেই। গালি দিয়ে এখন আর মন ভরছে না। তাই ভুল চিকিৎসার অভিযোগ এনে আমরা ডাক্তারকে পিটিয়ে মেরে ফেলি। কি লজ্জা! আমরা মানুষ হবো কবে?
আমার ভাগিনা, ভাগনি, ভাতিজারা কেউ ধরেন যে বড় হয়ে একদিন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হলো। তারপর ডাক্তারি করতে থাকলো। একদিন একটা খিঁচুনির রোগী এলো। ছয় বছরের নিচে অনেক বাচ্চারই জ্বর হলেই খিঁচুনি হয়। বয়স ছয় বছরের বেশি হয়ে গেলে আর হয় না। সারা পৃথিবীতে এই রোগের চিকিৎসা হলো সিডিল নামে একটা ইঞ্জেকশন পুশ করা। আমার উত্তরাধিকাররা এই চিকিৎসাই সারাজীবন শিখে এসেছে এবং হাজার হাজার রোগী সুস্থও হয়েছে। এখন এই চিকিৎসা সম্পর্কে চিকিৎসা শাস্ত্রেই বলা আছে এর কার্যকরীতা ৯৭ শতাংশের ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ, বাকি ৩ শতাংশ সার্ভাইভ নাও করতে পারে। সেই ৩ শতাংশের জন্য অন্য কোনো চিকিৎসাও নাই। তো একজনের সন্তান এই ইঞ্জেকশন দেবার পরেও বাঁচতে পারলো না। ডাক্তারের অবহেলায় রোগীর মৃত্যু বলে আমার এসব উত্তরাধিকারকে পিটিয়ে মেরে ফেলবেন। তাই না?
আমি একটা জিনিস বুঝি না, যে জায়গায় আপনাদের ভরসা নেই, বিশ্বাস নেই সে জায়গায় আপনারা কেন যান? ডাক্তার ইচ্ছে করে রোগীকে মেরে ফেলে খুনের রক্তে হাত রাঙালে তার ব্যক্তিগতভাবে লাভ কী? আপনার সম্পত্তি কি সব ডাক্তারের নামে উইল করা, যে আপনি মরলে সে সব পাবে বলে মেরে ফেলছে আপনাকে? বরং একজন রোগী বাঁচলে সবচেয়ে বেশি খুশি যে হয়, সে ওই ডাক্তার।
বিশ্বাস হয় না? ওকে। তাহলে আপনার জন্য ঝাড়ফুঁক, কবিরাজ আছে। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা আছে। আপনার যেতে হবে কেন ডাক্তারদের কাছে? ডাক্তার কি সকল ক্ষমতার অধিকারী? হুমায়ূন আহমেদ তো আমেরিকার ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করালেন, বাঁচলেন না তো? হুমায়ূনভক্ত হিসেবে সেই ডাক্তারদের পিটায়া আসলেন না? ডাক্তার যদি এতো ক্ষমতার অধিকারী হতো তবে কোনো ডাক্তার এবং তার পরিবারের কেউ কি মরে যেত? তারা তো অমর হয়ে বেঁচে থাকতো। তারা মরে কেন?
চিকিৎসকদের নিয়ে কেউ ঢালাও সমালোচনা করার আগে পিপিই, গ্লাভস, সু কাভার, এন-৯৫ মাস্ক, গগলস, ফেইসশিল্ড পরে অন্তত টানা সাড়ে ৬ ঘন্টা না খেয়ে, না পায়খানা-প্রস্রাব করে সাধারণ সিলিং ফ্যান সম্বলিত একটি রুমে আগে থাকেন। আমাদের দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা দিন দিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। করোনা পরিস্থিতি না আসলে হয়তো এ ভঙ্গুর স্বাস্থ্যব্যবস্থা অনেকেই দেখতে পেতেন না। বিভিন্ন পর্যায়ে দুর্নীতি হচ্ছে। কারা এ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত?
মাস্ক এন-৯৫ নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে। হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেনের অভাব। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজারে ভেজাল পণ্য, মোটা অংকে অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু এর কোনো বিচার আমরা দেখি না। দেখবো বলে মনে হয় না। যে সরকারি হাসপাতালগুলো হওয়া উচিত ছিল দেশের মানুষের কাছে নির্ভরযোগ্য এবং আস্থার জায়গা। হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে মেডিক্যাল সাপ্লাই এবং হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা। আমরা কি সেই দিকে মনোযোগ দিয়েছি?
চিকিৎসকরা অক্সিজেন সিলিন্ডার সাপ্লাই না থাকলে রোগীকে অক্সিজেন দেবেন কীভাবে? ৩০০ বেডের হাসপাতালে ৬০০ জনকে বেড দেবেন কিভাবে? বছরের পর বছর হাসপাতালগুলো অবহেলা আর বঞ্চনার মধ্যে থেকে গেল। সবচেয়ে বড় কথা সরকারি হাসপাতালে ডাক্তারদের নিরাপত্তা একদমই নেই। রোগীর স্বজনরা যে পরিমাণ বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ করেন, চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। আর এ সুযোগে যততত্রভাবে বেসরকারিভাবে হাসপাতাল গড়ে উঠেছে, রমরমা ব্যবসা চালাচ্ছে। এটা মানতে হবে কিছু ডাক্তার তার সঙ্গে জড়িত। ঢালাওভাবে সব ডাক্তারই ভালো বলার সুযোগ নেই। সব পেশাতেই ভালো-মন্দ দুটোই আছে। মন্দ সংখ্যা বেশি নয়, ভালোরা নীরবে থাকে বলে, মন্দদের আওয়াজটা বেশি শোনা যায়। কিছু কিছু ডাক্তারের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আছে। অভিযোগগুলো ভিত্তিহীন নয়। সব চিকিৎসক ডিউটি টাইমে উপস্থিত থাকেন না এটি যেমন সত্যি আবার একজন ডাক্তারের পক্ষে একই সময়ে এতো রোগীকে এটেন্ড করা বাস্তবে সম্ভব হয় না। এ অবস্থায় অনেক রোগী প্রয়োজনীয় মনযোগ পাচ্ছেন না বলে মনে করেন। আমাদের দেশে ডাক্তার-রোগীর অনুপাত প্রায় ১:৩৫০০।
যারা খারাপ ডাক্তার, ব্যবসায়ী ডাক্তার, তাদের কথা বলছি, আপনাকে ভাবতে হবে এরা কখনোই ডাক্তারি পেশাটাকে সৎ এবং স্বচ্ছ মানসিকতায় গ্রহণ করেনি। তারা এটাকে বাণিজ্যিকভাবে দেখে আসছে। কীভাবে বাণিজ্য করবে একধরনের ট্রেন্ড তাদের আগে তৈরি হয়ে থাকে। তাদের ব্যাপারে শাস্তি গ্রহণের দাবি তোলার সাহস আমাদের আছে? মনে পড়ে, কোন একটা মেডিকেল কলেজে ৩৩ লাখ টাকার পর্দা, ২ লাখ টাকার চেয়ার এবং অন্যান্য মহাসাগর চুরির কথা? সেগুলো না করে যদি মেডিক্যালগুলো সত্যি সত্যি আধুনিকায়ন করা হতো তবে রোগী মৃত্যুর হার কমে যেত, আপনাদের স্বজন হয়তো বেঁচে যেত।
আপনি কি জানেন, সরকারি হাসপাতালে নিম্নমানের সেবা কেন? দালালদের দৌরাত্ম্য কেন? আপনি কি জানেন, সরকারি হাসপাতালে ডাক্তাররা পর্যন্ত তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের কাছে কেন জিম্মি হয়ে থাকে?
তার জন্য দায়ী প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা খাতকে ধ্বংস করে ব্যক্তিগত মুনাফার কেন্দ্রে পরিণত করার জন্য জিয়াউর রহমান একটা নিয়ম করে দিয়েছিল যে সরকারি মেডিক্যালে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আজীবন চাকরি এবং তারা মারা গেলে তাদের সন্তানরা সেই চাকরিতে বহাল থাকবে। অর্থাৎ সরকারি হাসপাতালগুলো তাদের সেবা প্রদানের জায়গা না হয়ে বাপের সম্পত্তিতে পরিণত করে দিয়েছিল জিয়াউর রহমান। আফসোস আওয়ামী লীগও ক্ষমতায় এসে সেই কালো নিয়ম পরিবর্তন করেনি।
কোন এক ওয়াজে এক হুজুর বলেছিল যে মুসলমানদের নাকি করোনা হয় না, হলে কোরআন নাকি মিথ্যা! আর কি কি জানি ফর্মুলা আছে! মুসলমানের কি এখন করোনা হয়নি! হচ্ছে না! তাই বলে ওয়াজের মোল্লাদের ধরে ধরে পিটিয়ে মারবেন আপনি! না, সেটা আপনারা করবেন না। রাগ, ক্ষোভ ঝাড়বেন নিরাপরাধ ডাক্তারের উপর, ঘরের বউয়ের উপর, রিকশাচালক, হোটেল বয়, কুকুর-বিড়ালের উপর। রাগ ক্ষোভটা আসল জায়গায় ঝাড়েন না বলে অবস্থার পরিবর্তন হয় না, শোষণ থেকে মুক্তি পান না। রাগ-ক্ষোভটা নিরাপরাধীদের উপর ঝাড়েন কারণ আপনারা মানুষ হননি, অসভ্য বর্বর রয়ে গেছেন।
কোনো চিকিৎসাই শতভাগ কাজ করবে এমন নয়। সারাজীবন নিজের যত্ন না নিয়ে অসুখ বাঁধিয়ে তারপর চিকিৎসাতেও সুস্থ না হলে সেই ডাক্তারকে পিটিয়ে মারবেন। বাহ! আপনাদের আচরণ দেখে মনে হয় এ দুর্ভাগা দেশে ডাক্তারের প্রয়োজন নেই। শুধু শুধু স্ট্যাটাস বাড়ানোর জন্য ডাক্তার হওয়ার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন দেশের ব্যবস্থা বদলাতে হবে। যারা সেবার নামে লুটপাট করে যাচ্ছে, দুর্নীতি করে চলছে, তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা উচিত।
আমি ডাক্তারদের পক্ষে ঢালাওভাবে বলতে চাইছি না। প্রসঙ্গক্রমে ডাক্তারদের কথা বললাম, কিন্তু বাংলাদেশে সৎভাবে বেঁচে থাকার জন্য কোন পেশার নিরাপত্তা আছে? মানুষের ভেতর পৈশাচিক মনোভাব বেড়ে গেছে। কেন বেড়ে গেছে? শুধু ডাক্তাররাই রোষানলে পড়ছে? কিছুদিন আগে ঘুষ না নেওয়াতে গাজীপুরে একজন প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন নিহত হলেন। নকল করতে না দিলে ছাত্রের দ্বারা শিক্ষকরা লাঞ্চিত হতে হয়। সৎ সাংবাদিকতার কারণে অনেককে প্রাণ দিতে হয়েছে। এমনটা কেন হবে এদেশে?
শেষ করার আগে কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক অ্যাঙ্গেলসের একটি উদ্বৃত্তি দিতে চাই- মানুষের যেসব বৃত্তিকে লোকে এতদিন সম্মান করে এসেছে, সশ্রদ্ধ বিস্ময়ের চোখে দেখেছে, বুর্জোয়া শ্রেণি তাদের মাহাত্ম্য ঘুচিয়ে দিয়েছে। চিকিৎসাবিদ, আইনবিশারদ, পুরোহিত, কবি, বিজ্ঞানী- সকলকেই এরা পরিণত করেছে তাদের মজুরি-ভোগী শ্রমজীবীরূপে।
লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, ঢাকা মহানগর