বিশ্ব বাবা দিবস: বাবার জন্য শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা
২১ জুন ২০২০ ১১:৫৮
জুন মাসের তৃতীয় রবিবার বিশ্ব বাবা দিবস উদযাপিত হয়। সে হিসেবে আজ রবিবার (২১ জুন) বিশ্ব বাবা দিবস। পরিবারের প্রধানের ভূমিকায় বাবার অবদান অস্বীকার করা যায় না। যার হাত ধরে বাড়ির বাইরে প্রথম বের হওয়া তিনিই আমাদের বাবা। বাবার কাছে সন্তানের সব আবদার ও চাওয়া জমা হয়। দিন শেষে বাবা তার কর্মস্থল থেকে ফিরলেই সন্তান গলা ধরে আদর-সোহাগ পেতে চায়। বাবাও শত দুঃখ ও বেদনা ভুলে সন্তানকে কোলে নিয়ে চুমু খেয়ে আদর করেন। যার মন সর্বদা বিষন্ন থাকে পরিবারের খরচ যোগান দেয়ার জন্য। যিনি সন্তানের নতুন জামা-কাপড় কেনা, খাদ্য, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও লেখাপড়া নিয়ে বেশি চিন্তিত তিনিই আমাদের বাবা। তাই আজকের দিনে পৃথিবীর সকল বাবার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
মায়ের গুরুত্ব বেশি হলেও একটি পরিবারে বাবার গুরুত্বও কোন অংশে কম নয়। বাবা শব্দটি উচ্চারিত হলেই আবদার পূরণ বা সন্তানকে কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো এমন বিষয় চলে আসে। চট-জলদি সমাধানে বাবার সাথে পরিবারের অন্য কারও তুলনা করা যায় না। পিতার সাথে সন্তানের সম্পর্ক গড়ে উঠে ভয় আর আদরের মাধ্যমে। কোন অপরাধ করলে শাস্তি দেয়া আবার কিছুক্ষণ পরেই গায়ে হাত রেখে আদর করার মাধ্যমেই পরিবারে সন্তান ও পিতার মধ্যে একটি শক্তিশালী বন্ধন গড়ে উঠে। বাবার কঠোর শাসন অনেকের জীবনের গতিকে পরিবর্তন করে আলোর পথে এনেছে।
কর্মব্যস্ততা ও পরিবারের চিন্তায় বাবা দিনের অধিকাংশ সময়ই বাইরে থাকেন। আবার অনেক বাবা চাকরির সুবাদে পরিবার থেকে অনেক দূরে থাকেন দেশে কিংবা বিদেশে। বাবার দেহ বাইরে থাকলেও মন ছুটে যায় পরিবারে। সন্তানের কচি মুখ তাঁর চোখের সামনে ভেসে আসে। বাবা যখন বাড়ি ফিরেন তখন সন্তানের মুখ দেখে সকল দুঃখ ভুলে যান। বাবা বাড়ি ফেরার পথে চকলেট ও মিষ্টি নিতে ভুলেন না। বাড়ি ফিরবেন বলে অনেক সন্তান শুধু বাবার পথ চেয়ে থাকেন। এটা কেবল বাবার প্রতি শুধু আত্মার সম্পর্কের জন্যই নয় বরং আবেগ ও ভালোবাসার জন্য। বাড়ি ফিরেই বাবার ব্যাগ হাতড়িয়ে সন্তানের কাছে চকলেট কিংবা মিষ্টি বের করা এক আনন্দের বিষয়।
পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে বা যেকোন সমস্যায় বাবা সম্মুখ যোদ্ধা হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। তাঁর মধ্যে কোন ক্লান্তি বা অবসাদ দেখা যায় না। বাবার কাছে কোন কিছু চাইলে তিনি কখনো না করেন না। অর্থাভাবে বাবার কোন কিছু দেয়ার সামর্থ না থাকলেও তিনি ভবিষ্যতে দিবেন বলে আশ্বস্ত করেন। বড় কিছু চাওয়ার বায়না কেবল বাবার কাছে শোভা পায়। খেলনা বা সাইকেল শিশুদের অনেক প্রিয়। বাবার কাছে চাইলে সহজেই পাওয়া যায়। পরিবারে বাবার অসীম স্নেহ ও ভালোবাসায় সন্তান বেড়ে উঠে। তাঁর ধৈর্য ও পরিশ্রম দেখে মনে হয় তিনি এক জড়ো পদার্থ। সন্তানের কাছ থেকে কষ্ট পেলেও তিনি রাগ কিংবা অভিমান করেন না। আসলে সৃষ্টিকর্তা বাবা বলেই মনে হয় তাঁর মনকে এভাবে গঠন করেছেন।
সন্তান যখন উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণে, কাজে কিংবা চাকরির সুবাদে বাড়ির বাইরে যায় তখন বাবার মন বাধা দেয়। তারপরও বৃহৎ স্বার্থে মেনে নিতে বাধ্য হন। সন্তানের লেখাপড়ার খরচ যোগানে অনেক বাবা খুব কষ্ট করেন। সন্তান টাকা চাইলে কখনো বাবার মুখে না শোনা যায় না। প্রতিউত্তরে বাবা বলেন না এতো খরচ করো কেন? যার হাড় ভাঙা পরিশ্রম থেকে সন্তানের লেখাপড়া হয় সে বাবার প্রতি সন্তানের ভালোবাসা জমা হবে অবশ্যই। নতুন চাকরি বা কাজ পেলে সন্তানের কাছে বাবার অর্থ প্রাপ্তির চিন্তা থাকে না। ভালো কিছু করলে গর্বে বাবার বুক ভরে যায়। নতুন পরিবেশে কীভাবে চলতে হবে, কীভাবে কথা বলতে হবে সব কিছুই বাবার কাছ থেকে জানা যায়। তিনি যেন সন্তানের জন্য এক বটবৃক্ষ।
সন্তানের বাড়ি ফেরার কথা শুনলেই বাবা সকালে খাবার না খেয়েই অপেক্ষায় থাকেন। বাড়ির বাইরে বের হয়ে সন্তানের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন। সন্তানের জন্য দুপুরে কী রান্না হবে তা বাবা ঠিক করে দেন। সন্তান তাঁর জন্য কী এনেছেন সে অপেক্ষায় না থেকে বাবা মুখের দিকে তাকিয়ে আনন্দে কেঁদে ফেলেন। সন্তানের দিকে মুখ তুলে তাকালে তিনি যেন আপন পৃথিবী খুঁজে পান। তাঁর জন্য অল্প দামের কিছু আনলেও কোটি টাকার জিনিসের মতো বার বার বের করেন আর দেখেন। বাবার কাছে সন্তানের চেয়ে দামী পৃথিবীতে কিছুই নেই। তাইতো সন্তান হারালে অনেক বাবাকে পাগল হতে দেখা যায়।
পরিবারে যার সহায়তায় বড় হলাম সে বাবারা অনেকেই আজ ভালো নাই। অবসর গ্রহণ করে কেউ জটিল রোগে ভুগছেন, কেউ সন্তানের আচরণে ব্যথিত আবার কেউ প্রিয়জন হারিয়ে পাগলপ্রায়। তবে অনেক বাবা এখনও ভালো থেকে সন্তানদের নিয়ে সুখ ভোগ করছেন। বাবার জন্য সন্তানের অনেক কিছু করার আছে। কিন্তু বাবারা তেমন কিছু চান না। শুধু চান তাঁর সাথে ভালো ব্যবহার। নাতি-নাতনি নিয়ে শুধু খেলে আনন্দ পেতে চান আমাদের বাবা। অধিকাংশ বাবা জানেন না তাঁদের ভবিষ্যৎ। যিনি সন্তানকে কোলে-পিঠে মানুষ করলেন সে বাবা অবশ্যই ভালো ব্যবহার প্রত্যাশা করেন।
যারা বাবাকে হারিয়েছি তারা আজ বাবাকে স্মরণ করবো। আর যাদের বাবা বেঁচে আছেন তারা অবশ্যই তাঁর সেবা-যত্ন করবো। কাছে কিংবা দূরে যেখানেই থাকি কমপক্ষে তাঁর সাথে একবার হলেও কথা বলবো। তাঁর স্বাস্থ্যের খোঁজ নেব। যার কাঁধের উপর ভর করে আমাদের এতো সফলতা সে বাবার সাথে আমরা সর্বদা ভালো ব্যবহার করবো। বউ, সন্তান কিংবা বন্ধুদের মাঝে নিজেরা ব্যস্ত থাকি বলে বাবার খোঁজ নিতে যেন ভুল না হয়। যাদের বাড়িতে বাবা আছেন তাঁরা সর্বদা খোঁজ নেব। খাবার ও স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নেবো। প্রয়োজনীয় কোনো জিনিস তিনি যেন সহজেই নিতে পারেন সে ব্যবস্থাও করবো। বাড়ির ছোট্ট শিশুরা যেন বাবার সাথে সর্বদা সময় কাটায় তার ব্যবস্থা করবো।
আধুনিক ও ডিজিটাল সমাজে আজও পত্রিকা খুললেই দেখা যায় বৃদ্ধ বাবাকে ফেলে পালিয়েছেন নিজ সন্তান। সত্যি এমন খবর আমাদের জন্য দুঃখজনক। সন্তানের শত দুঃখ-কষ্টে বাবারা কিন্তু ফেলে যায় না। যার প্রমাণ পাওয়া যায় গোলাম মোস্তাফা’র ‘জীবন বিনিময়’ কবিতায়। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে পিতার সাথে আমাদের সম্পর্ক যেন নিন্মগতি। কিন্তু তাঁরা আমাদের জন্য জান্নাত, তারাই আমাদের জাহান্নাম। অর্থাৎ, তাদের সাথে ব্যবহারের উপরই মৃত্যু পরবর্তী আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।
যাদের বাবা নাই তাঁরা হয়তো আজ ফেসবুকে আবেগঘন স্ট্যাটাস দিবেন। যাদের বাবা আছে তারা হয়তো আজ বাবার জন্য দিনটাকে স্পেশালভাবে সাজাবেন। হ্যাঁ, তা অবশ্যই করা দরকার। কিন্তু বাবার জন্য প্রতিদিনই যেন সম্মান ও শ্রদ্ধার হয় সেটা খেয়াল রাখতে হবে। তাঁর জন্য সামান্য উপহার এবং তিনি যা খেতে বা পরতে ভালোবাসেন তা যেন সঠিক সময়ে পান তার ব্যবস্থা সন্তান হিসেবে আমাদেরকেই করতে হবে। বৃদ্ধ বয়সে বাবারা অসহায়। তাঁদের সঙ্গ দেয়ার কেউ থাকে না। তাই তাঁদের সাথে সময় দিতে হবে। একাকিত্ব তাদের যেন গ্রাস করতে না পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে।
আজ পৃথিবীর সকল বাবার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে বাবার প্রতি আমাদের সম্পর্ক আরো গাঢ় হোক। বাবার সাথে প্রতিদিনই যেন ভালোভাবে কাটে। তাঁদের মতামত যেন পরিবারে প্রাধান্য দিতে পারি। তাঁদের জন্য নিরাপদ হোক পরিবার ও দেশ। পরিবারে সবচেয়ে ভালোটা যেন হয় বাবার জন্য। সুখে-দুঃখে সর্বদা বাবার প্রতি আমাদের আচরণ যেন কোমল হয়। তাদের সুস্থতার জন্য সন্তান হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হবে সর্বদা খোঁজ রাখা। বাবার প্রতি সন্তানের ভালোবাসা আরো দৃঢ় হোক এবং এভাবে পৃথিবীতে বিরাজ করুক অনাবিল শান্তি।
লেখক: ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলাম লেখক