আরও একজন নক্ষত্রের বিদায়
২১ জুন ২০২০ ১৭:৫৮
বাংলাদেশ নামক সৌরজগতে আমরা হারালাম আমাদের আরও এক মূল্যবান নক্ষত্রকে। চন্দ্র-সূর্য উঠবে কিন্তু আলো ছড়াবে না এই প্রাণ। কে পূরণ করবে এই অভাব, কীভাবে কাটবে এই আঁধার? চলে গেলেন ভাষাসৈনিক, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী। এভাবেই বাংলাদেশের আকাশ থেকে আরও একজন নক্ষত্রের বিদায়।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে শনিবার সকাল সোয়া ১০ টার দিকে মহাখালীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর।
জগতে একটি মন্দ কাজ করা খুবই সহজ। বির্তকিত হওয়া সময়ে ব্যাপার। কিন্তু ভাল দিকনির্দেশনা দেওয়া আর ভালোটা প্রতিষ্ঠা করা সময়বহুল ও কষ্টসাধ্য। এমনই কঠিন সময় পেরিয়ে নিজেকে আলোকিত করেছিলেন কামাল লোহানী।
কামাল লোহানীর প্রকৃত নাম আবু নাইম মোহা. মোস্তফা কামাল খান লোহানী। সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া গ্রামের খান মনতলা গ্রামে ১৯৩৪ সালের জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পাবনা জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেন ১৯৫২ সালে। পরে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ইতি ঘটে। পাবনা জিলা স্কুলে শেষ বর্ষের ছাত্র থাকা অবস্থায় ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে কামাল লোহানীর রাজনীতিতে হাতেখড়ি। ১৯৫৩ সালে নুরুল আমিনসহ মুসলিম লীগ নেতাদের পাবনা আগমন প্রতিরোধ করতে গিয়ে তাকে কারাগারে যেতে হয়। মুক্ত হতে না হতেই আবার ১৯৫৪ সালে গ্রেফতার হন কামাল লোহানী। সেই সময় তিনি কমিউনিস্ট মতাদর্শে দীক্ষিত হন। পরের বছর আবার গ্রেফতার হয়ে কারাগারে যাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে একই কারাকক্ষে তার বন্দিজীবন কাটে।
১৯৬১ সালে রবীন্দ্রশতবর্ষ পালনে পাকিস্তানি নিষেধাজ্ঞা জারি হলে ছায়ানটের নেতৃত্বে কামাল লোহানী ও হাজারো রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক কর্মী সাহসী প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পরের বছর কামাল লোহানী ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। ষাটের দশকের শেষ ভাগে ন্যাপের (ভাসানী) রাজনীতিতে জড়িয়ে কামাল লোহানী যোগ দেন আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান পূর্ব বাংলার শিল্পীরা যে ভূমিকা রেখেছেন, তার সঙ্গেও কামাল লোহানী সম্পৃক্ত ছিলেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে কামাল লোহানী একাধারে একজন শিল্পী, একজন সাংবাদিক ও একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে যুদ্ধে যোগ দেন। সে সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদ বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি বাংলাদেশ বেতারের পরিচালকের দায়িত্ব পান।
কামাল লোহানী পেশায় ছিলেন সাংবাদিক। তিনি দৈনিক মিল্লাত পত্রিকা দিয়ে সাংবাদিকতা শুরু করেন। তার কর্মস্থল ছিল দৈনিক আজাদ, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক পূর্বদেশ, দৈনিক বার্তা প্রভৃতি। তিনি সাংবাদিক ইউনিয়নে দু’দফা যুগ্ম-সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এমনকি ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হন।
কামাল লোহানী ১৯৮১ সালে দৈনিক বার্তার সম্পাদকের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে নতুন উদ্যমে সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে সংগঠিত করার কাজ শুরু করেন। পরে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। কামাল লোহানী দেখেছিলেন পরাধীনতার শৃঙ্খলে থাকার চিত্র ও তাঁর মধ্যে ছিল বেদনার তিক্ত অভিজ্ঞতা। দেশের ভাষা আন্দোলন, দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সকল কিছুতে ছিল তাঁর অগ্রনী ভূমিকা। অভিজ্ঞতা ও ত্যাগের মাধ্যমে তাঁর মুখের স্বাধীনতার বাণী আমরা ক’জন জানি। প্রবাদে আছে, “পুরাতন চাউল ভাতে বাড়ে”।
প্রকৃতই কামাল লোহানীর মত গুণীজন থাকায় আমরা স্বাধীনতা নামক সোনার হরিণ অর্জনের স্বাদের কিছুটা আস্বাদন করতে পারি। প্রেরণা পায় দেশপ্রেমের। তাদের চোখের দিকে তাকিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখি। আমাদের দেশপ্রেমের প্রেরণা যোগাতে এমন মানুষদের যুগে যুগে প্রয়োজন। তাছাড়া এক সময় ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দেশপ্রেম শেখানোর প্রবাদ পুরুষ থাকবে না। আমাদের তাদের কর্ম থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা প্রয়োজন। কারণ তাদের অভিজ্ঞতা আমাদের আলোর পথ দেখাবে।
একটি মানুষ চিরদিন বেঁচে থাকে না। বেঁচে থাকে তার কর্ম। কর্মের ছোঁয়ায় আলোকিত হয় নতুন প্রজন্ম। তারপরও কিছু গুণীজনের বিদায় যেন একটি হতাশার মুখে ফেলে দেয়। অনুভূত হয় নির্দেশনার অভাব। আমার কাছে মনে হয় একটি পরিবারের পিতা কিছু না করতে পারলেও তার সহঅবস্থানে থাকাটা আমাদের বটবৃক্ষ। তাঁর উপস্থিতি আমাদের সকল কাজের অস্তিত্ব। আমাদের বিপথ থেকে ফিরে আসার শেষ সম্বল। আমাদের বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা। তাই এমন গুণীজনকে হারানো অপূরণীয় ক্ষতি। হে মহান পুরুষ তোমার আত্মার শান্তি কামনা করি, তোমার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। এর বাইরে কিছুই করার নেই আমাদের ক্ষমতা। মহান হোক তোমার প্রস্থান।