অকৃতজ্ঞদের ভিড়ে মানুষের মত কিছু মানুষের গল্প!
২৩ জুন ২০২০ ০০:১৬
খুলনার ডাক্তার রাকিব হত্যার পর পেরিয়ে গেছে বেশ কদিন। চারদিন আগে প্রধান আসামীসহ ৫ জন গ্রেফতার হয়েছে এই মামলায়। যদিও নিজের এলাকায় ‘গরীবের ডাক্তার’ হিসেবে পরিচিত ডা. রাকিব হত্যার দ্রুত বিচার পাওয়ার আশাবাদ রাখতে চাওয়া মানুষগুলো এর আগে নানা সময়ে ঘটা ডাক্তার হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনার বিচার পাননি। একটা সভ্য সমাজে সাধারণ জনগণকে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া এবং জীবন বাঁচাবার জন্য সর্বক্ষণ চেষ্টা করে যাওয়া চিকিৎসকদের কসাই হিসেবে ডাকা হয় এবং ঠাণ্ডা মাথায় রোগী মেরে ফেলার অভিযোগ এনে চড়াও হওয়া, নির্যাতন চালানো এবং পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনা নিয়মিত ঘটতে থাকে এবং সেটা জনগণের গা সওয়া হয়ে যায়, এটি একটি অত্যাশ্চর্য ঘটনা। পৃথিবীর যেকোন দেশেই এমন কিছু অচিন্তনীয় হওয়ার কথা, কিন্তু আমাদের দেশে কি অবলীলায় দিনের পর দিন কসাই পেটানো উৎসব চলছেই!
ডা. রাকিবের কথা মনে পড়লো পরিচিত দুজন ডাক্তারের হার না মানা যুদ্ধ দেখে। ডা. অনীক চন্দ এবং মনিকা চন্দ। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের চিকিৎসক দম্পতি। পাপাই আর টিনটিন নামে দুটো ফুটফুটে সন্তান নিয়ে হাসিমুখ ভালোবাসায় তাদের চমৎকার সংসার। প্রায়ই আদরে শাসনে আর খুনসুটিতে বাচ্চাদের সাথে প্রাণবন্ত সব ছবি দেখি, কখন যে পুরো পরিবারটাই প্রিয় হয়ে উঠেছেন টেরই পাইনি। করোনা সংকটের শুরু থেকেই দুজনই সরাসরি ফ্রন্টলাইনে ডিউটি করে যাচ্ছেন হাসপাতালে, গত ৩ মাস নিরলস শ্রম দিয়ে গেছেন, এরমধ্যেই পারিবারিক বিপর্যয় ঘটেছে বেশ কয়েকবার, কিন্তু এই দুইজন ফাইটার কর্তব্যের জায়গা থেকে একচুল সরেননি। ফলে এইমুহুর্তে করোনার ছোবলে তাদের পরিবারের অবস্থা এলোমেলো।
এদের মধ্যে অনীক চন্দের অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে ৬ দিন আগে। আগে থেকেই অ্যাজমা সমস্যা ছিল অনীকের, তবুও করোনাকালের পুরো সময়টাই সপ্তাহে দুই থেকে তিনদিন চমেক ফ্লু কর্ণার এবং করোনা ইউনিটে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং সপ্তাহের বাকি দিনগুলি মেডিসিনের বহির্বিভাগে রোগী দেখেছেন। এর মধ্যেই একদিন চমেক হাসপাতালের চিকিৎসক মুহিদুল হাসান করোনায় আক্রান্ত হলে তাকে ওয়ার্ডে রিসিভ করেছিলেন অনীক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুহিদুলকে বাঁচানো যায়নি।
সেদিন বাসায় ফিরেই অসুস্থ হয়ে পড়েন অনীক, করোনা পজিটিভ হওয়ার পর শ্বাসকষ্ট গুরুতর অবস্থায় চলে যায়। আইসিইউতে নেওয়া হয় তাকে। অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে যাওয়া অনীককে হাই ফ্লো নজেল ক্যানুলা দিয়ে অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে। এরমধ্যেই প্লাজমা থেরাপিও দেওয়া হয়েছে তাকে। যে চমেকে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিয়ে গেছেন অনিক, সেখানেই আইসিউতে চিকিৎসাধীন এখন তিনি।
সর্বক্ষণ অনীকের পাশে থাকা স্ত্রী মনিকাও আক্রান্ত হয়েছেন করোনায়, তবুও হাল ছাড়েননি তারা। বাচ্চাদুটোও অসুস্থ, বাবা-মা যখন হাসপাতালে করোনার সাথে লড়ছেন, তখন বাসাতেই রয়েছে তারা। এই দুঃসময়েই বাবা-মা দুজনকে হারিয়েছেন অনীক। মার্চের প্রথম সপ্তাহে বাবা এবং জুনের এক তারিখে মা তাকে ছেড়ে চলে যান। কিন্তু কর্তব্যকে প্রাধান্য দিয়ে বাবা-মার শোক বুকে চেপে দুবারই মাত্র ২-৩ দিনের মধ্যেই আবার ডিউটিতে যোগ দেন। সন্তানদের সাথে প্রায় এক সপ্তাহ পর ভিডিও কলে কথা হল অনীকের আইসিইউ বেডে শুয়ে। কিন্তু বাচ্চাদের জড়িয়ে ধরবার উপায় নেই, অনীক-মনিকা দম্পতি কিভাবে স্বাভাবিক ছিলেন তারা জানেন না। বাচ্চারা তো অত কিছু বুঝতে পারে না, বাবা-মাকে দেখে অবোধ মনে প্রশ্ন করে গেছে:
“পাপাই: বাবা আসবে কখন? বাবা কি হাঁটতে পারে? বাবার নাকে নল লাগানো কেন? তুমি কোথায় শোও? ভাত খাও কোথায়? বাথরুমে যাও? বাবা কিভাবে বাথরুমে যায়? বাবা কিভাবে খায়?
টিনটিন: বাবা, তুমি কি চিবোতে পার? দেখি হা কর। তোমার দাঁত দেখাও।
পাপাই: বাবার নাকের মেশিনটার নাম কি? মেশিনটা দেখাও। তোমার খাবার টেবিল কই? তুমি ভাত খাও কই? ঘুমাও কোথায়? দুষ্টু (পিকু) কোথায় ঘুমায়? তোমার পাশে কে আছে?”
অনীক আর মনিকা দাঁতে দাঁত চেপে যুদ্ধটা চালিয়ে যাচ্ছেন। বেঁচে থাকবার যুদ্ধ, যেন কদিন পর সুস্থ হয়ে আবার তারা ‘জনগণের সেবা’ নামের গালভরা থ্যাংকসলেস জবে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন। অথচ মজার ব্যাপারটি দেখুন, থ্যাংকস তো দূরের কথা, এমন এক জনপদে বিচিত্র বিকারগ্রস্ত সব শ্বাপদের ভিড়ে এই ডাক্তারেরা ২৪/৭ নিরলস সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। যারা সামান্য পান থেকে চুন খসলেই ডাক্তারদের দোষ দিয়ে ডাক্তারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর যদি খোদা না করুন কোন রোগী মারা যান, তবে রীতিমত খুনের দায় নিয়ে বদলা খুন হয়ে যান ডাক্তারেরা।
ঠিক কতটা পাষন্ড হলে এই করোনাকালের প্রচন্ড দুঃসময়ে যেখানে ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মী-টেকনিশিয়ান এবং স্বাস্থ্যসেবা ও ফ্রন্টলাইন ফাইটিংয়ের সাথে যুক্ত প্রত্যেক ফাইটারকে প্রতিনিয়ত স্যালুট জানানো উচিত, শ্রদ্ধা ও সম্মানে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা যুগিয়ে যাওয়া উচিত আমাদের নিরাপদ রাখবার জন্য তাদের অহর্নিশ প্রচেষ্টায়, সেখানে আমরা এই ফ্রন্টলাইন ফাইটারদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছি। পিটিয়ে মেরে ফেলতেও হাত কাঁপছে না আমাদের।
অনীক-মনিকা দম্পতির মত সারা বাংলাদেশে এমন অজস্র ডাক্তারের পরিবার আজ ভোগান্তি পোহাচ্ছে। পরিচিত সার্কেলের অসংখ্য ডাক্তার করোনায় আক্রান্ত, করোনার বিরুদ্ধে এই অসমযুদ্ধে ইতোমধ্যেই মৃত্যু হয়েছে প্রায় অর্ধশতাধিক ডাক্তার ও চিকিৎসাকর্মীর। নিজেদের জীবনের পরোয়া না করে জনগণকে নিরাপদ ও সুস্থ রাখবার প্রতিজ্ঞায় সেবা দিয়ে যাচ্ছেন করোনার বিরুদ্ধে, যার মাশুল গুনতে হচ্ছে নিজে এবং নিজের পরিবারের মানুষগুলো করোনায় আক্রান্ত হয়ে। তবুও তারা একবিন্দু দমেননি। সুস্থ হয়েই আবারও যুদ্ধক্ষেত্রের দায়িত্বে ফেরার অপেক্ষায় থাকা এই সাহসী বীরযোদ্ধাদের জন্য সামান্য ধন্যবাদ যথেষ্ট না। এই মানুষগুলোর আন্তরিকতার প্রতি কৃতজ্ঞতায় নত হোন। অন্তর থেকে শুভকামনা আর ভালোবাসায় তাদের দীর্ঘায়ু কামনা করুন। এরাই মানুষ, মানুষের মত মানুষ।