সবার প্রিয় একজন সত্য প্রসাদ স্যার
২৫ জুন ২০২০ ২৩:১৬
দেশের সবচেয়ে মেধাবীরা পড়ে, এমন এক প্রতিষ্ঠান। ধরুন, সেখানে আপনি একটা প্রতিযোগিতায় জিতলেন, এরপর দেশের বাইরে গিয়ে দেশের প্রতিনিধিত্বের ডাক। কিন্তু বিমান ভাড়া, থাকা, খাওয়া; অনেক খরচের ধাক্কা। স্পন্সর পেলে ভালো হয় কিন্তু কে করবে স্পন্সর? ছাত্রকল্যাণ পরিচালকের কাছে আবেদন করা হলো। উনি কয়েক জায়গায় ফোন করলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে বিমান ভাড়ার ব্যবস্থা হয়ে গেলো।
ক্যাম্পাস বা ডিপার্টমেন্টে কোনো একটা অনুষ্ঠান হবে। যেরকম পরিকল্পনা, তাতে কমপক্ষে ১৫ লাখ টাকার দরকার। হাতে সময় আছে দেড় মাস, একটা স্পন্সরেরও কনফার্মেশন পাওয়া যায়নি। ছাত্ররা দল বেধে উপস্থিত বিভাগীয় প্রধানের রুমে। সবকিছু খুলে বলা হলো, প্রস্তাবনা দেখানো হলো। স্যার জিজ্ঞেস করলেন, “কত টাকা লাগবে তোমাদের এইসব করতে?”
-১০ লাখের মতো স্যার। (স্যারকে ১৫ লাখ টাকার কথা বলতে সাহস হয়নি কারো)
স্যার একটু ভ্রু কুচকে মোবাইল ফোনটা বের করলেন। এরপর একটার পর একটা লিংক বের করে ফোন নাম্বার বলতে লাগলেন। কোন জায়গায় গিয়ে কী বলতে হবে, কার কাছে দাওয়াত কার্ডসহ যেতে হবে, যেয়ে কী কী দেখাতে হবে সবই বলে দিলেন। ওই ১০ মিনিটের মধ্যে ৮ লাখ টাকার মতো স্পন্সরের বন্দোবস্ত হয়ে গেলো। রুম থেকে বের হয়ে সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করে বোকা বনে গেলো।
কোনো ছাত্র পাস করতে পারেনি, কিছু পরামর্শ দরকার। স্যারের দরজা খোলা। কেউ হয়তো পাশ করে গেছে, ক্যারিয়ার নিয়ে কিভাবে আগাবে বুঝতে পারছে না। কেউ অসুস্থ, কারো সাহায্য লাগবে। কিংবা ডিপার্টমেন্টে অত্যাধুনিক ল্যাব ফ্যাসিলিটিজ প্রয়োজন। সকল কাজে সবার আগে সবাই স্যারের কাছে ছুটবে। আর তার কাছে গেলেই নিমিষেই ‘মুশকিল আসান’।
প্রশ্ন হচ্ছে কে এই স্যার? আর কেউ নন, শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক ড. সত্য প্রসাদ মজুমদার। আজই মহামান্য রাষ্ট্রপতি এবং চ্যান্সেলর কর্তৃক বুয়েটের নতুন উপাচার্য হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন তিনি। এই নিয়োগের মাধ্যমে আগামী চার বছরের জন্য সদ্য সাবেক উপাচার্য সাইফুল ইসলামের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন সবার প্রিয় সত্য প্রসাদ স্যার।
অধ্যাপক ড. সত্য প্রসাদ মজুমদার বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগ থেকে ১৯৮১ সালে স্নাতক ও ১৯৮৫ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৮১ সালে তিনি একই বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন। ১৯৯১ সালে ইন্ডিয়ান ইনস্টিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে লাভ করেন পিএইচডি ডিগ্রী। এর আগে তিনি বুয়েটের ছাত্রকল্যাণ পরিচালক, ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের বিভাগীয় প্রধান, আহসানউল্লাহ হলের প্রভোস্টসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়াও তিনি বিটিসিএল এবং ডিপিডিসির বোর্ড অফ ডিরেক্টরস এর মেম্বার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। অধ্যাপক সত্য প্রসাদ মজুমদার হলের প্রভোস্ট এবং ছাত্রকল্যাণ পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় ছাত্রদের সাথে হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
শিক্ষক ও গবেষক হিসেবে কেমন সত্য প্রসাদ স্যার? মূলত স্যারের রিসার্চ টপিক ছিল টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং এবং অপটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। রিসার্চ গেট হচ্ছে দুনিয়ার রিসার্চারদের সোশ্যাল নেটওয়ার্ক। রিসার্চ গেটের হিসাব অনুযায়ী, স্যারের মোট পাবলিকেশন সংখ্যা ২০৬টি এবং মোট সাইটেশন সংখ্যা ৬২৯। এই সাইটেশন সংখ্যাটা হচ্ছে কতজন রিসার্চার স্যারের এই রিসার্চ তাদের কাজে প্রয়োগ করেছে এবং দেখেছে। এছাড়াও একজন রিসার্চারের কাজগুলো কতটা ইম্প্যাক্ট ফেলছে সেইটা হিসাব করার জন্য রিসার্চ গেটের একটি পরিসংখ্যান পদ্ধতি আছে। এই ম্যাট্রিকে সংক্ষেপে আর.জি স্কোর বলা হয়। স্যারের আর.জি স্কোর ২৯.৯২। যেটা নিঃসন্দেহে বিশ্বমানের। এ বিষয়ে তার নিজ ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থীদের স্মৃতিচারণ খুবই প্রণিধানযোগ্য। এতো বছরের কর্মজীবনে স্যারকে কখনো কোন স্লাইড বা নোট নিয়ে ক্লাসে আসতে দেখা যায়নি। বোর্ডে পর পর ইকুয়েশন লিখতে থাকতেন। ম্যাথগুলোও স্যারের মাথায়ই থাকতো, কখনো বই দেখতে হতো না। হয়তো দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার ফসল কিন্তু এরকম স্কিল অনেক সিনিয়র প্রফেসরদের মধ্যেও দেখা যায় না। আর প্র্যাকটিকাল এক্সাম্পল ক্লাসে উনার চেয়ে ভালো কেউ দিতো বলে জানা নেই।
ব্যক্তিগত গাড়ি থাকার পরেও স্যারকে ক্যাম্পাসে খুব কমই গাড়ি নিয়ে আসতে দেখা যেতো। রিকশাই তার সবচেয়ে প্রিয় বাহন। কর্মজীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। কিন্তু সাদামাটা চালচলনে এসব পদের ভারিক্কি বুঝা খুব কঠিন ছিল আসলে। তার সরলতার সুযোগ অনেকে নিয়েছে সময়ে সময়ে কিন্তু বাস্তবে তার মতো এতোটা ছাত্রবান্ধব সিনিয়র প্রফেসর বুয়েটে বিরল।
স্যারের একজন ছাত্র একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার স্মৃতিচারণ করেছে স্যারকে নিয়ে। সবশেষে সেটি সংযুক্ত করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। “ড. সত্য প্রসাদ মজুমদার স্যারের কাছে গিয়েছিলাম একটি ব্যক্তিগত কাজে। স্যার আমাদের জন্য চা দিতে বলেছেন এটেন্ডেন্টকে। এটেন্ডেন্ট ভুলে গেছেন, শুধু স্যারকে চা দিয়েছেন। স্যার চা খাচ্ছেন না। বারবার এটেন্ডেন্টকে ফোন দিচ্ছেন। ফোন ধরছে না। চায়ের কাপ আমাদের দিকে এগিয়ে বললেন, তোমরা খাও। আমরা না করলাম। একটু পরে এটেন্ডেন্ট ফোন ধরলো। আমাদের জন্য চা এলো। ততক্ষণে স্যারের চা ঠাণ্ডা। স্যারকে আবার দেয়া হল।”
একজন শিক্ষক যদি এমন হন তার ছাত্রের প্রতি, সম্মান শ্রদ্ধা ব্যাপারটা মন থেকেই আসে। নতুন দায়িত্বেও অতীতের মতই সফল হবেন বলে আশা করি। পরম করুণাময়ের কাছে নতুন দায়িত্বে স্যারের সফলতা ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।
লেখক: উদ্যোক্তা ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক শিক্ষার্থী