বাংলাদেশের `প্রকৃত বন্ধু’ ভারত নাকি চীন?
২৭ জুন ২০২০ ১৪:৪৭
শিরোনামের প্রশ্নটা কারও কারও কাছে অবান্তর মনে হতে পারে। ভারত আর চীনের মধ্যে বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু কে? তারা বলতে পারেন, ভারত বাংলাদেশের নিকট প্রতিবেশী দেশ। একাত্তরে তারা আমাদের পক্ষে ছিল। দুই লাখ মানুষকে তারা আশ্রয় দিয়েছে। এমনকি অস্ত্র দিয়ে, সৈন্য দিয়ে পর্যন্ত সাহায্য করেছে। অন্যদিকে চীন বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেয় এবং পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়ায়। অতএব এই দুই দেশের মধ্যে ভারত আমাদের প্রকৃত বন্ধু এতে সংশয়ের কী আছে!
যারা এমনটা বলবেন, আমি তাদের বিরোধিতা করার জন্য এই লেখা লিখছি না। লিখছি এই কারণে যে ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এমন একটা প্রশ্ন কেউ কেউ তুলে ফেলেছেন। আর এই প্রশ্ন ওঠার কারণও আছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর প্রায় পাঁচটি দশক অতিক্রান্ত হচ্ছে। এই পাঁচ দশকে গঙ্গার পানি অনেক গড়িয়েছে এবং আরও যত গড়াচ্ছে সংশয় ততই বাড়ছে। আমার মতে, এই সংশয়ের ক্ষেত্র তৈরিতে বাংলাদেশের প্রতি চীনের সহায়তার হাত বাড়ানো যতটা ভূমিকা রেখেছে, তার চেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সর্বদাই বন্ধুভাবাপন্ন দেশ ভারতের প্রতিবেশী এই ক্ষুদ্র দেশটির প্রতি উদাসীনতা।
ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, ভারতের অবশ্যই সুযোগ ছিল যেকোনো আঞ্চলিক সঙ্কটে দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দেশগুলোর নেতৃত্ব দেওয়ার। বৃহৎ রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশসহ তার প্রতিবেশী ছোট ছোট রাষ্ট্রগুলোর যে বড়ভাইসুলভ ব্যবহার পাওয়ার কথা ছিল তারা সেগুলো পায়নি বলেই আজ ভারতের প্রতিবেশী প্রায় প্রতিটি দেশ তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার আজ পর্যন্ত তাদের কোনো বিরোধী মনোভাব প্রকাশ না করলেও সাধারণ মানুষের মনে যে ভারত আমাদের কতটা বন্ধু এ প্রশ্নটা উঠতে শুরু করেছে সেটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। এবং চীনকে তারা বিকল্প দাঁড় করাচ্ছে।
এ কথা সবারই জানা যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সর্বতোভাবে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায়। একাত্তরের পঁচিশে মার্চ গণহত্যা শুরু হলে তারা বাংলাদেশের সঙ্গে সমস্ত সীমান্ত খুলে দেয়, যাতে নির্যাতিত বাঙালিরা তাদের দেশে আশ্রয় নিতে পারে। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের গণহত্যার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। এ ব্যাপারে তিনি বিশ্ব জনমত গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন এবং তার প্রচেষ্টাতেই তৎকালীন বৃহৎ শক্তিধর দেশ রাশিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নেয়। এই ভূমিকার কারণে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা-ভালোবাসার জায়গাটি দখল করে নেয় ভারত ও ভারতের জনগণ। কিন্তু পরবর্তীতে ভারতের বেশ কিছু কর্মকাণ্ড বাংলাদেশি জনগণের বিশ্বাস ও ভালোবাসার সেই অবস্থাটির প্রতি চিড় ধরাতে থাকে।
প্রথমত, ১৯৭৫ সালে ভারত কর্তৃক নির্মিত ফারাক্কা বাঁধ চালু হলে তারা বাংলাদেশ-ভারতের অভিন্ন নদী গঙ্গা থেকে শুকনো মৌসুমে পানি প্রত্যাহার করে নিতে থাকায় বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বেশ কিছু এলাকায় মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। পদ্মায় পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় নাব্য সঙ্কট দেখা দেয় এবং এর ফলে বর্ষা মৌসুমে বন্যার সম্মুখীন হতে হয়। অন্যদিকে কৃষি উৎপাদনেও মারাত্মক প্রভাব পড়তে থাকে। এ ব্যাপারে দুই দেশের উচ্চপর্যায়ে বারবার আলোচনা ও চুক্তি সই হলেও বাংলাদেশ কোনো সময়েই তাদের কাঙ্ক্ষিত পানি পায়নি। স্বাভাবিকভাবেই এ নিয়ে বাংলাদেশে ভারত বিরোধী মনোভাব গড়ে ওঠে। অন্যদিকে তিস্তা নদীর ভারতের অংশে বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশে পানি প্রবাহে বাধার সৃষ্টি করা এবং এ নিয়ে এখন পর্যন্ত বহুবার হচ্ছে হচ্ছে করেও কোনো চুক্তি সই না হওয়াও সাধারণ মানুষের ভারতের প্রতি বিদ্বেষ তৈরি হওয়ার আরেকটি কারণ।
ভারতের বিরুদ্ধে সাধারণ বাংলাদেশিদের মনে বিদ্বেষী মনোভাব গড়ে ওঠার আরেক কারণ সীমান্ত হত্যা। বিশ্বের অনেক স্থানেই বন্ধুত্বপূর্ণ দুই দেশের মধ্যে সীমান্তে কিছুটা ঢিলেঢালা ভাব থাকে। বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যেও তেমনটা রয়েছে। আর সে কারণে দুই দেশের মধ্যে অবৈধ চলাচল যেমন কিছুটা রয়েছে, তেমনি চোরাচালানও যে হচ্ছে না, এ কথা কেউ বলবে না। কিন্তু সেই চোরাচালানের সূত্র ধরে এমন বন্ধুভাবাপন্ন দুই দেশের সীমান্তে বছরের পর বছর ধরে গুলি করে মানুষ হত্যা চলতেই থাকবে এটা সাধারণ মানুষ মেনে নিতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে ভারত আর বাংলাদেশকে বন্ধুভাবাপন্ন দুই দেশ বললেও পুরোটা বলা হয় না। কারণ এ দুটি দেশ একসময় একই রাষ্ট্র ছিল। সেই একরাষ্ট্রের আমলের অনেক মানুষ এখনও দুই দেশেই বেঁচে আছেন। এ কারণে এবং বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতের প্রায় প্রতিটি অংশের সংস্কৃতি ও ভাষার মিলের কারণে তারা এখনও এই দুটি অংশকে আলাদা বলে মেনে নিতে পারে না। তাই এই ভ্রাতৃসুলভ মনোভাবের মধ্যেও প্রতিনিয়ত কারণে-অকারণে সীমান্ত হত্যা তাদেরকে ভারত বিদ্বেষী করে তুলছে স্বাভাবিকভাবেই। সীমান্তে কিশোরী ফেলানীকে হত্যা ও তারকাঁটায় তার ঝুলন্ত লাশের ছবি বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে কাঁটার মতো বিঁধে আছে এবং আরও বহুকাল থাকবে বলেই মনে হয়।
এদিকে সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রায় ৯৭ শতাংশ পণ্যে চীন শুল্ক ছাড় দেওয়ায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রভাবশালী দৈনিক আনন্দবাজারসহ আরও দুয়েকটি গণমাধ্যম একে ‘খয়রাতি’ হিসেবে উল্লেখ করে খবর প্রকাশ করে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের এ ধরনের মনোভাব প্রকাশ এই প্রথম নয়। যদিও এটা ভারত সরকারের বক্তব্য নয় কিন্তু সেদেশের গণমাধ্যমে এ ধরনের বক্তব্য কোনো বন্ধুরাষ্ট্রের গণমাধ্যমের বলে মেনে নিতে পারে না বাংলাদেশের জনগণ।
আবার ভারতের জাতীয় নাগরিক পঞ্জি বা এনআরসি নিয়েও পানি কম ঘোলা হয়নি। বিভিন্ন সময় কোনো কোনো বিজেপি নেতা যেসব মন্তব্য করেছেন তা বাংলাদেশের জন্য শুধু উদ্বেগেরই ছিল না, ছিল অপমানজনকও। ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’দের ‘উইপোকা’ সম্বোধন করে বলেছিলেন, এদেরকে রাজ্যের বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হবে। পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু মন্তব্য করেছিলেন, এনআরসি করে বাংলাদেশি মুসলিমদের দেশছাড়া করা হবে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য শুরু থেকেই বিজেপির এ বক্তব্যের বিপক্ষে কড়া অবস্থান নিয়েছিলেন। এ সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে উদ্বেগ প্রকাশ করেন, ভারতের তালিকা থেকে বাদ পড়াদের বাংলাদেশি তকমা লাগিয়ে বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হতে পারে। ভারত যদিও তখন বলে, এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার এবং বাংলাদেশের জন্য কোনো সমস্যা হবে না; কিন্তু এ বক্তব্য বাংলাদেশের সাধারণ জনগণকে আশ্বস্ত করতে পারেনি; বরং এমন বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য তাদেরকে ভারতের প্রতি বিদ্বেষী করে তোলে।
অন্যদিকে চীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে শুধু যে সমর্থন দেয়নি তা নয়, তারা সে সময় প্রকাশ্যে পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়ায়। এমনকি বাংলাদেশের স্বাধীনতার রূপকার এবং বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের আগে তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি পর্যন্ত দেয়নি। তবে পঁচাত্তরের পরে তারা বিভিন্ন সময় নানান সহযোগিতা নিয়ে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি সেতু চীনের সাহায্যে গড়ে উঠতে দেখেছে বাংলাদেশে জনগণ। বুড়িগঙ্গার ওপর প্রথম চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী সেতু থেকে শুরু করে কচা নদীতে অষ্টম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হওয়া তাদের কাছে চীনকে বাংলাদেশের ‘বড় বন্ধু’ হিসেবে ভাবতে সহায়তা করে।
সাম্প্রতিক শুল্ক ছাড়ের বিষয়টিতে অনেকেই তাদেরকে বড় বন্ধু বলে ভাবতে শেখায়। বিভিন্ন মহল থেকে যদিও বলা হয়, সুদূরপ্রসারী চিন্তা থেকে ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে চীন। আর সেই সূত্রেই ভারতের আশপাশের রাজ্যগুলোর প্রতি তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব প্রদর্শন। অন্যদিকে সাধারণ মানুষ দেখছে, বর্তমানে বাংলাদেশের উন্নয়নের অন্যতম অংশীদার চীন। বাংলাদেশের গার্মেন্টসহ বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিয়াল কাঁচামাল থেকে শুরু করে বহু পণ্য চীন থেকে এসে থাকে। তাই সামগ্রিক বিবেচনায় চীনকেও সাধারণ জনগণ বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্র মনে করে।
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের পররাষ্ট্রনীতি ঠিক করেছিলেন, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়। সেই সূত্র ধরেই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিদেশনীতিও এগিয়ে চলছে বলেই মনে হয়।
অতএব, উপসংহারে বলা যায়, ভারত এবং চীন দুই দেশই বর্তমানে বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্র। ভারতকে উপেক্ষা করে চীনকে বন্ধু বলে মেনে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আবার ভারতকে বন্ধু মেনে চীনকে দূরে ঠেলে দেওয়ার সুযোগও নেই। এটা অবশ্য সরকারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু সাধারণ জনগণ সরকারের আইন হয়তো মেনে নেয়, কিন্তু তাদের মানসিকতা তো আর সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে না। এ জন্য একটি বন্ধু রাষ্ট্রের শুধু সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখলেই হয় না। সেদেশের সাধারণ মানুষের মনও জয় করে চলতে হয়। ভারতের সে সুযোগ থাকার পরও সে জায়গাটা থেকে কিছুটা সরে গেছে বলেই কে প্রকৃত বন্ধু এই প্রশ্নটা সামনে চলে এসেছে বলে মনে করি।
লেখক: সংবাদকর্মী