Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বাজেট বোঝার বাজেট কোথায়


১ জুলাই ২০২০ ১৯:৪২

২০২০-২০২১ অর্থবছরের বাজেট জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হয়েছে বেশ কয়েকদিন হলো। অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে আলোচনা শেষে তা পাশও হয়ে গেছে। বরাবরের মতোই প্রস্তাবিত এবং চূড়ান্ত বাজেটে তেমন কোন পার্থক্য ছিল না। প্রতিবারের মত এবারো বাজেট প্রস্তাবনার পর কেউ যুগান্তকারী, কেউবা গণবিরোধী, কেউ সাহসী, কেউ উচ্চাভিলাষী বলে অভিহিত করছেন।

ছাত্ররাজনীতি করার সময়ে মে-জুন মাসে আমাদের দু’টি কর্মসূচি অবশ্য পালনীয় ছিল। শিক্ষায় বিভিন্ন প্রয়োজন তুলে ধরে কাঙ্ক্ষিত বরাদ্দের দাবিতে মে মাসে আর প্রয়োজনীয় বরাদ্দ না দেয়ায় জুন মাসে বাজেট প্রত্যাখ্যান করে কর্মসূচি। প্ল্যাকার্ড-ফেস্টুন থাকত আগেই প্রস্তুত। প্রেস বিজ্ঞপ্তিও চাইলে আগেই তৈরি করা যেত।

বিজ্ঞাপন

দেশের প্রগতিশীল রাজনীতির এক পুরোধা নেতৃত্ব কয়েকদিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাজেট প্রতিক্রিয়ার এহেন গতানুগতিকতার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন যে, সংকটটা প্রতিক্রিয়া প্রকাশকারীর নয়, শাসক দল বদলালেও বিভিন্ন শাসকের বাজেটের মৌলিক চরিত্রে কোন পার্থক্য নেই। তিন দশক আগের বাজেটও যেমন গণবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল ও ধনিক তোষণের হতো, আজও তাই। এ কারণে বাজেট বিশ্লেষণেও একই কথা বারবার বলতে হয়। যাক, বাজেট ভালো না মন্দ, বাস্তবায়নযোগ্য না অযোগ্য সে আলোচনা এ লেখার উদ্দিষ্ট না। বাজেট বিষয়ে অন্য একটি দিক আলোচনায় আসা প্রয়োজন মনে করি।

রাষ্ট্রের বাজেট মানে আগামী এক বছরে রাষ্ট্রের আয়-ব্যয় সংক্রান্ত পরিকল্পনা, যার মধ্য দিয়ে মূর্ত হয়ে ওঠে রাষ্ট্রের বিবেচনায় গুরুত্ব-অগুরুত্বের ধারণা, সম্পদের বণ্টন ও ব্যবহার, উৎপাদন ও বৈষম্য সংক্রান্ত রাষ্ট্রের ভাবনা ও দর্শন এবং পরবর্তী বছরগুলোর জন্যও নির্দেশনা। বাজেটের প্রয়োজনীয় অর্থের যোগানদাতা জনগণ, খরচ করার কথাও জনগণের কল্যাণে। অথচ বাজেট আলোচনায় জনগণের অংশগ্রহণ কোথায়? শুধু আজ নয়, এ যাবতকালের সামরিক, বেসামরিক, বেসামরিক মোড়কের সামরিক শাসন অথবা গণতান্ত্রিক আমলের নির্বাচিত, অনির্বাচিত বা আংশিক নির্বাচিত প্রতিনিধিরা বাজেটসহ রাষ্ট্রপরিচালনায় যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কথা থাকে, জনগণের প্রতিনিধিরাই তো বাজেট প্রণয়ন করেন। তাহলে তো বলতে হয় পাঁচ বছর পর পর ভোট প্রদান করা ছাড়া রাষ্ট্রশাসনে জনগণের অংশগ্রহণের কোন সুযোগ নেই। তবু গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণে জনগণকে আড়ালে রেখে জনপ্রতিনিধিদের মতকেই জনগণের মত হিসেবে ধরে নেয়া কতটা নৈতিক? সাথে রয়েছে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ, যা সংসদ সদস্যদের নিজ দলের বিরুদ্ধে ভোট দেয়া কার্যত নিষিদ্ধ করেছে। ফলে সংসদের কণ্ঠভোট বাস্তবে আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত হয়েছে। জনগণের বদলে ‘সার্বভৌম’ করা হয়েছিল সংসদকে, সে সার্বভৌমত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এ বিধান।

বিজ্ঞাপন

পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনের প্রায় পুরোটা সময় জুড়ে চলেছিল সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন। বাংলাদেশ আমলেও সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বারবার লড়াই এবং একবারের গণঅভ্যুত্থান জনগণের শাসনের অর্থে গণতান্ত্রিক শাসনের আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলেছিল। বাজেটের মত গুরুত্বপূর্ণ শাসনতান্ত্রিক ব্যাপারে যদি জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা না যায়, তবে জনগণের রক্তমাখা দীর্ঘ আন্দোলনের প্রতি সুবিচার করা হল কি? আধুনিক রাষ্ট্রের বিশাল কলেবর ও আনুষঙ্গিক আয়োজনে সব ব্যাপারে জনগণের প্রত্যক্ষ মত নেয়া সম্ভব না। কিন্তু প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময়ে বাজেট প্রণয়ন করা লাগে, এমন ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা ও বয়সের মানুষের মতামত সংগ্রহ করে সে আলোকে সংসদে উত্থাপন করা নিশ্চয় অসম্ভব বা দুরূহ ছিল না।

এখন আসি আরেকটু জটিল সমস্যায়। ধরুন, জনগণের মতামত সংগ্রহের সুযোগ থাকল। এতেও খুব সুবিধে হবে কি? নিরক্ষর বা স্বল্প শিক্ষিত দূরে থাক, বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকদের সামনে যদি অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতার কপি দিয়ে বলা হয়, এ বাজেট বাস্তবায়নে দেশের শিল্প-কৃষি বা কর্মসংস্থানে কেমন প্রভাব পড়বে? আমার ধারণা শতকরা পাঁচ ভাগেরও কম স্নাতক মতামত দিতে পারবেন। অপ্রিয় এক সত্য এভাবে বেরিয়ে আসে যে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সর্বোচ্চ ধাপও রাষ্ট্র পরিচালনায় ভূমিকা রাখা বা অংশগ্রহণ করার মত মানুষ তৈরিতে ব্যর্থ। অথচ আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছি, যে স্বাধীনতার জন্য আমাদের ত্রিশ লাখ পূর্বসূরি জীবন দিয়েছিলেন। বাংলাদেশে শিক্ষার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ছিল মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের আকাঙ্ক্ষাকে রূপদানের লক্ষ্যে জনগণকে গড়ে তোলা। যার অংশ হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনার অত্যাবশ্যকীয় বিষয়গুলোতে শতভাগ জনতাকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলা। তেমন শিক্ষা দেয়ার বাজেট প্রণীত হবে কবে?

লেখক: প্রাবন্ধিক

বাজেট

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর