রোহিঙ্গাদের দায়িত্ব কি শুধুই বাংলাদেশের?
২ জুলাই ২০২০ ১৬:৫০
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠী। শতকেরও বেশী সময় ধরে আরকানে বসবাসরত এই জনগোষ্ঠীর সাথে স্থানীয় মগ জনগোষ্ঠী ও মায়ানমার সরকারের নানা বিরোধের শুরু থেকে বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা শরণার্থীর বোঝা বইতে হচ্ছে। ২০১৭ সালে মায়ানমারের সেনাবাহিনীর পরিকল্পিত জাতিগত নিধনযজ্ঞ শুরু হলে নতুন করে আরও নতুন ৭ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে হয় বাংলাদেশকে। এখনো রোহিঙ্গা শরণার্থীর ঢল এককভাবে বাংলাদেশকে নিতে হচ্ছে।
গত ২৪ এপ্রিল সাগরে ভাসমান ৫০০ রোহিঙ্গা শরণার্থীর একটি জাহাজকে মালয়েশিয়া উপকূল থেকে বাংলাদেশ অভিমুখে ফেরত পাঠিয়েছে মালয়েশিয়া। মালয়েশিয়া সরকার আর রোহিঙ্গা গ্রহণ করবে না বলে কোন ধরনের রসদ ছাড়া তাদের ফেরত পাঠায়।
সংবাদসংস্থা বিবিসির এক প্রতিবেদনে জানা যায়, মালয়েশিয়া থেকে ফিরতি পথে খাবারের অভাবে অনেক রোহিঙ্গা মাঝ-সমুদ্রে মারা যায়। মালয়েশিয়া থেকে ফিরতি এই জাহাজের রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করার জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশকে চাপ দেয়। অথচ ঠিক এর আগের সপ্তাহেও ৪০০ জনের রোহিঙ্গা জাহাজকে বাংলাদেশ উপকূলে ভিড়তে দেওয়া হয়েছিল। এখন প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দায়িত্ব কি শুধুই বাংলাদেশের?
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী গভীর সাগরে ভাসমান শরণার্থীদের দায়িত্ব নিকটবর্তী উপকূলীয় দেশসমূহের। কিন্তু থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া উপকূল ও আন্দামান সাগরে ভাসমান রোহিঙ্গাদের উপকূলীয় দেশ গ্রহণ না করে ঠেলে দিচ্ছে বাংলাদেশে। এভাবে আর কতদিন! বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশ। ছোট্ট ভূমি, অধিক জনসংখ্যা নিয়ে বাংলাদেশ নিজেই নানা সমস্যায় জর্জরিত। তবু ২০১৭ সালে হত্যা, ধর্ষণ আর আগুনের মুখে পালিয়ে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মতো ছোট অর্থনীতির দেশের পক্ষে কতদিন মিলিয়ন জনসংখ্যার শরণার্থীর দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব!
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে প্রতিমাসে আড়াই হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হয়। শুরুর দিকে অনুদান আসলেও বর্তমানে অনুদানের পরিমাণও কমে গেছে। ফলে রোহিঙ্গাদের ভরণ-পোষণের ভার বহন করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। ভাসানচরেও রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরিত করতে দিচ্ছে না আন্তর্জাতিক কিছু সংস্থা। ফলে বাংলাদেশের কক্সবাজারের স্থানীয় জনগোষ্ঠী, প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ও পর্যটন শিল্প ক্ষতির মুখে পড়েছে।
রোহিঙ্গা সমস্যাটি ভূ-রাজনৈতিকভাবে জটিল একটি সমস্যা। কিন্তু সমাধান অযোগ্য নয়। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের কমিশনের রিপোর্ট আসার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ২০১৭ সালের সহিংসতা শুরু হয়। বর্তমানে এই সংকট নিয়ে জাতিসংঘ, ইউএনএইচসিআর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মায়ানমার, যুক্তরাজ্য, জাপান, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও তুরস্কসহ গুরুত্বপূর্ণ দেশ ও সংস্থা অবগত আছে। কিন্তু তারা সমস্যা সমাধানে যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছে না। সংকটকে জিইয়ে রাখছে। তৃতীয় কোন দেশেও রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের জন্য উদ্যোগ নিচ্ছে না। যত চাপ দেওয়ার বাংলাদেশের উপরই দিচ্ছে। হেগের আন্তর্জাতিক আদালত রোহিঙ্গা গণহত্যার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন রায়ে মায়ানমারকে দায় করেছে। তা সত্ত্বেও জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ যারা রোহিঙ্গাদের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার আছে তারাও মায়ানমারের উপর যথেষ্ট চাপ প্রয়োগ করছে না।
রোহিঙ্গারা শতাব্দীর বেশী সময় ধরে আরকানের ভূমিপুত্র; এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। ১৭৮৪ সালের আগে ভারতবর্ষ ও মায়ানমারের মাঝে আরকান ছিল একটা স্বাধীন রাজ্য। বার্মার স্বাধীনতা আন্দোলন এমনকি সরকারেও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ ছিল। কিন্তু ১৯৮২ সালে সামরিক জান্তা সরকারের নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের মাধ্যমে অযৌক্তিক ঐতিহাসিক সত্যকে পাশ কাটিয়ে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়। পরবর্তীতে বিদেশী বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদে জাতিগত নিধন অভিযান চালানো হয়।
চলতি মাসে মালয়েশিয়া উপকূল থেকে আটক আরেকটি রোহিঙ্গা জাহাজের ৩০০ রোহিঙ্গাকে গ্রহণ করতে বাংলাদেশকে আহবান জানাচ্ছে। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে সমস্ত রোহিঙ্গার দায়িত্ব তো বাংলাদেশের নয়। রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের সমস্যা নয় এটা আন্তর্জাতিক সমস্যা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই দায়িত্ব নিতে হবে। ফলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ঐতিহাসিক সত্য মেনে নিয়ে রোহিঙ্গাদের আরকানে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিতে হবে। যতদিন পুনর্বাসন সম্ভব হবে না ততদিন তৃতীয় কিছু দেশকে রোহিঙ্গাদের দায়িত্ব নিতে হবে।
শতবছরের ভূমিপুত্র জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করে জাতিতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল অঞ্চল কখনো নিরাপদ বিনিয়োগস্থল হতে পারে না। এছাড়া বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের যৌথ বিনিয়োগ অংশীদার চীন-জাপানের প্রতি বাংলাদেশের বার্তা দেওয়া উচিত। জাতিতাত্ত্বিক এই সংকট দীর্ঘমেয়াদে জিইয়ে থাকলে পুরা অঞ্চল নিরাপত্তা শঙ্কায় পড়তে পারে। তাই পুরা বিশ্ব যেন শান্তিপূর্ণ বিশ্বের স্বার্থে রোহিঙ্গা সংকটের একটি যৌক্তিক সমাধানের উদ্যোগ নেয়।
লেখক: বিশ্লেষক