আশার না আষাঢ়ের গল্প?
৫ জুলাই ২০২০ ২১:০৩
আষাঢ় মাসের শেষ দিক এখন। বৃষ্টি নেই। ভ্যাঁপসা গরম পড়ছে। ঠিক এমনি এক সময়ে বাংলাদেশের গ্লোব বায়োটেক দাবি করেছে তারা করোনা ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পথে সাফল্য পেয়েছি। তবে তারা এখনও ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করেনি। খবরটা অনেকের দুরু দুরু মনে প্রশান্তি জাগছে। চারিদিকে যখন অশান্ত ও অনিশ্চিতের খেলা চলছে, তখন এ আশা জাগাটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু আমার মনে কোনো প্রশান্তি জাগছে না।
কেনো জাগছে না? এই দেশ আমাদের, যে দেশে মহাদুর্যোগময় মুহূর্তেও একটা অসাধু চক্র ভেজাল কারবার করে যাচ্ছে, বাজারে স্যানিটাইজার ভেজাল পাওয়া যায়, ভেজাল এন-৯৫ মাস্ক পাওয়া যায়, কৃত্রিম অক্সিজেন সংকট সৃষ্টি করে রেখেছে, অনেক জায়গায় কিটে স্বল্পতা, নিন্মমানের ওষুধ সরবরাহ; সর্বত্র ভেজাল কারবার চলে। সেই দেশে এরকম একটা খবর কেমন যেনো অবিশ্বাস্য লাগছে আমার কাছে। ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। এক্ষেত্রে আমার কি দোষ বলুন? এমনকি কোনো ধরনের মেশিনপত্র ছাড়া করোনা পরীক্ষার কিটও আবিষ্কারের দাবি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরও জানে না গ্লোব বায়োটেকের এ ভ্যাকসিন সম্পর্কে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও আমরা এমন খবর প্রায়শই শুনে আসছি, দুই-একদিনের খবর এগুলো, অক্সফোর্ডের আবিষ্কৃত ভ্যাকসিন তৃতীয় ধাপে সফল। চীন আগামী সপ্তাহে বাংলাদেশে করোনা ভ্যাকসিন ট্রায়াল দিবে। অবশ্য চীনের বিষয়টা রাজনৈতিক একটা ব্যাপার।
প্রথম দিকে এসব খবরে দারুণভাবে অন্য সবার মতো আমিও আশাবাদী হয়ে উঠেছিলাম। এখন আর উঠতে পারছি না। কয়েক দিনের ব্যবধানে এতো কাছের মানুষ হারিয়েছি, কাছের মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, তাতে কোনো কিছুর ওপর আস্থা রাখতে পারছি না। আস্থা রাখার মতো পরিস্থিতিও দেশে নেই। মনের ভিতরে কেবল দুঃস্বপ্নের দিন-রাত্রি। যখন ভ্যাকসিন আমার হাতের নাগালে না আসবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আশায় বুক বাঁধতে পারছি না।
গ্লোব সম্পর্কে একটা পুরাতন তথ্য আছে, এর আগে গ্লোবের ‘ভিটামিন এ’ ওষুধের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। সুতরাং এক্ষেত্রে আমাদের ভাববার বিষয় আছে। ২৩ মার্চ তারা কোভিড-১৯ শনাক্ত কিট ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরে জমা দেওয়ার পরও সেই বিষয়ে কোনো ফলাফল এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। দীর্ঘ একটা সময় কিন্তু চলে গেছে। গ্লোব বায়োটেক আবিষ্কৃত করোনা টিকা যেনো আমাদের জন্য আশার না আষাঢ়ের গল্প! অবশ্যই আমরা চাই এ খবরটি বিশ্ব মানচিত্রে আমাদের জয়ী হওয়ার স্বপ্নটাকে এগিয়ে নিয়ে যাক। প্রত্যাশা করি গ্লোব বায়োটেকের ভ্যাক্সিন সফল হবে। মানব জাতির জন্য তাদের আবিষ্কারের সফলতা খুব গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি।
দুই
একটা খবর পড়ছিলাম, নিউজিল্যান্ডের স্বাস্থ্যমন্ত্রী তার ব্যর্থতা স্বীকার করে পদত্যাগ করেছেন। আর আমাদের দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী এখনও বড় গলায় কথা বলেই যাচ্ছেন। যেভাবে সরকারের মন্ত্রীরা লাগামছাড়া কথা বলছে, এটা তো জলের মতো পরিষ্কার স্বাস্থ্যখাতে দিন দিন অব্যবস্থাপনা চরম আকার ধারণ করছে। আর দেশের অর্থমন্ত্রী চিকিৎসা করাতে লন্ডনে গেছেন। কোনো ব্যবসায়ী, ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা বিদেশে চলে গেছেন। এটা আমাদের জন্য বড় দুর্ভাগ্যের ব্যাপার। সন্দেহ নেই, কাণ্ডজ্ঞানহীন বক্তব্য আর দেশের ‘ভিআইপি’ খ্যাত তথাকথিত দেশ ছেড়ে যাওয়ায় জনগণের মধ্যে আতঙ্ক, দ্বিধা ও অবিশ্বাস তৈরি করছে।
আমাদের দেশে সবচেয়ে মূল্যবান হচ্ছে ভিআইপিদের জীবন। করোনাকালে সেটা আবারও প্রকটভাবে প্রকাশিত হয়েছে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সাধারণ মানুষ তেমনিভাবে চিকিৎসাসেবা না পেলেও ভিআইপিদের চিকিৎসা পেতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। তাদের জন্য দ্রুততার সঙ্গে সিএমএইচ, এয়ার অ্যাম্বুলেন্স, হেলিকপ্টার, আইসিইউ, ভেন্টিলেটরসহ সব সুবিধা নিশ্চিত করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে আরেকটু বলি, দেশের মার্কসবাদী তাত্ত্বিক, বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ কমরেড হায়দার আকবর খান রনো বেসরকারিখাতে কোনো চিকিৎসা না নিয়ে তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এটা হলো দেশের প্রতি মমত্ববোধ আর মানসিক শক্তি।
আঙুল দিয়ে দেখানোর পরও ব্যর্থতার দায় নিতে চান না, খোদ সংসদে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছাঁটাই প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেককে সরিয়ে অন্য কাউকে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যরা। সেই স্বাস্থ্যমন্ত্রী আবার স্বাস্থ্যখাতের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির সপক্ষে সাফাই গাইছেন!
কোভিড-১৯ মহামারী দেশের ভঙ্গুর স্বাস্থ্যব্যবস্থা আমাদের সামনে তুলে এনেছে। সরকারি স্বাস্থ্যখাতে বিরাজ করছে অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি এবং বিভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্টের সততার অভাব। দুর্নীতি দমন কমিশন এক প্রতিবেদনে বড় ধরনের দুর্নীতির কথা তুলে ধরেছে। এসব দুর্নীতির মধ্যে রয়েছে অপ্রয়োজনীয় ব্যয়বহুল চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনা, ফার্মেসি কোম্পানিগুলোর আগ্রাসী বিপণন নীতি ও সরকারি স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া। দুর্বল স্বাস্থ্যব্যবস্থার নেপথ্যে এগুলোই বড় কারণ। স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির বিষয়টি পুরো ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে।
কেউ কি দেখেছেন, এই যে স্বাস্থ্যখাতে এতো এতো দুর্নীতি হচ্ছে, এসব ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ তিনি নিয়েছেন বা নিতে পেরেছেন? একজন ডাক্তারকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে, স্বাস্থ্যমন্ত্রী কিংবা স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়েছে?
তিন
কেন ডাক্তাররা নিজেদের পেশা পরিবর্তন করে বিসিএসে অন্য ক্যাডারে যাচ্ছে? কেন প্রকৌশলীরা নিজেদের পেশা পরিবর্তন করে অন্য ক্যাডারে যাচ্ছে? এগুলো কি আমাদের ভাববার বিষয় নয়? রীতিমত ভয়েরই ব্যাপার। মেধার অবমূল্যায়ন ঘটছে দেশে। যে যেভাবে পারছে ডাক্তারি ছেড়ে দিতে চাচ্ছে দেশে। কিংবা বিদেশে চলে যাচ্ছে। শুধু ডাক্তার নয়, প্রকৌশলীদের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটছে। প্রাণরসায়ন থেকে পাস করা একজন মেহেরপুর জেলা প্রশাসক নিযুক্ত হয়েছেন।
এবার ৩৮তম বিসিএস এ প্রথম ২৫ জনের মধ্যে ৯ জনই ডাক্তার। এই খবরে খুশি হতে তো পারছি না, বরং শঙ্কাবোধ করছি। তরুণ ডাক্তাররা দেশে চিকিৎসা করতে চাচ্ছে না যেন। দেশে থাকলে অন্য ক্যাডারে চলে যাওয়া আর না হলে বিদেশে চলে যাওয়া- এই ট্রেন্ডটা চলছে বেশ।
৫-৭ বছর পর কি হবে তা নিয়ে একটু ভাবেন প্লিজ। সামনে অন্ধকার ঘনীভূত হচ্ছে।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, ঢাকা মহানগর