Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সোশ্যাল মিডিয়ায় সাইবার বুলিইং আর কতদিন?


১২ জুলাই ২০২০ ১৫:২৯

ব্যাপারটা কল্পনা করুন। আপনার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুদের একজন আপনাকে ছেড়ে চিরতরে চলে গেছে, তার বিষাদমাখা শেষ কথাগুলো আপনার মাথার মধ্যে বাজছে, বন্ধুকে স্মরণ করে এক দীর্ঘশ্বাস ভরা শোকগাঁথা লিখেছেন আপনি. সেখানে এসে ধর্মের ইজারা নেওয়া কিছু ভন্ড ধর্মান্ধ আপনাকে ভর্তসনা করছে কেন আপনি আপনার বন্ধুকে ধর্মান্তরিত করে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মে কনভার্ট করে বেহেশত নিশ্চিত করতে পারলেন না। এখন কেন আপনি তার আত্মার শান্তি কামনা করছেন। যেহেতু সে একজন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী, তাই তার আত্মার শান্তি কামনা করা জায়েজ না। তারা প্রচার করছে তাদের শান্তির ধর্ম এতোটাই কুপমন্ডুক আর অসভ্য যে স্রেফ তাদের ধর্মের অনুসারী না হলে কারো আত্মার শান্তি কামনা করা যাবে না। একইসাথে তারা আপনাকে ঠান্ডা হুমকির মাধ্যমে সতর্ক করছে যে আপনি যদি তার আত্মার শান্তি কামনা করেন, তাহলে আপনার গুনাহ হবে, স্রেফ বন্ধুর আত্মার শান্তি কামনা করবার কারণেও আপনি দোজখে যেতে পারেন।

বিজ্ঞাপন

জীবদ্দশায় হয়তো আপনি আপনার বন্ধুর ধর্ম কি সেটা নিয়ে কখনো ভেবেও দেখার প্রয়োজনবোধ করেননি, আপনাদের বন্ধুত্বের মধ্যে ধর্ম কখনোই গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, অথচ প্রিয় বন্ধুকে হারাবার শোকের মাঝখানে আপনাকে এই ধর্মের ইজারা নেওয়া সহীহ মুসলমান দাবিদার ধর্মান্ধদের কাছ থেকে শিখতে হচ্ছে যে আপনি যদি আপনার বন্ধুকে ইসলামে কনভার্ট করতে পারতেন, তাহলেই আপনাকে সত্যিকারের বন্ধু বলা যেত, বন্ধুত্বের আসল পরিচয় পাওয়া যেত…

বিজ্ঞাপন

শুনতে যতই অবিশ্বাস্য শোনাক, ঠিক ঘটনাটাই ঘটেছে কিছুদিন আগে জনপ্রিয় শিল্পী এন্ড্রূ কিশোর মারা যাবার পর। তার দীর্ঘদিনের বন্ধু হানিফ সংকেত প্রয়াত এন্ড্রু কিশোরের জন্য একটা শোকগাঁথা লিখেছিলেন তার ফেসবুক পেইজে। ব্যস, সেখানে ধর্মের ইজারা নেওয়া সৈনিকেরা হা রে রে রে করে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং এন্ড্রু কিশোরের আত্মার শান্তি কামনা করবার জন্য হানিফ সংকেতকে কটূক্তি করতে লাগলো। মানে এদের আচরণ দেখলে অনেকটা এমন মনে হয় যে আপনার ধর্মের বাইরের কোন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের মৃত্যুর পরে তার আত্মার শান্তি কামনা করলে বা সে স্বর্গ/বেহেশতের মত শান্তিময় জায়গায় যাক এই প্রার্থনা করলে বেহেশতে আপনার জায়গা দখল হয়ে যাবে বা ভাগ কমে যাবে!

অথবা ব্যাপারটা এমন যে এই মানুষটা যেহেতু সারাজীবন ভিন্ন ধর্মের অনুসারী ছিল, তাকে আমার ধর্মে কনভার্ট করতে পারিনি, তাই মৃত্যুর পরে তাকে ও তার পরিবারকে কোনভাবেই স্বস্তি পেতে দেওয়া চলবে না! তার ধর্ম অনুযায়ী তার স্বর্গে যাবার কথা থাকলেও আমার ধর্ম অনুযায়ী তাকে দোজখে পাঠাতে হবে যেভাবেই হোক!

এতোটাই ভয়াবহ এই ধর্মান্ধদের ঘৃণার বিষ যে তারা নিজেরা তো ভিন ধর্মের কারো আত্মার শান্তির জন্য দোয়া করবেই না, উল্টো কেউ যদি দোয়া করতে চায়, তাকে গুনাহ হবার এবং দোজখে যাবার ভয় দেখিয়ে নিবৃত করতে ছুটে আসবে।

শুধুমাত্র এই ইস্যুতে না, বিখ্যাত জনপ্রিয় সজ্জন কেউ মারা গেলে, অসুস্থ হলে, অবস্থা সংকটাপন্ন হবার খবর প্রকাশিত হলেই সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে এই উগ্র ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক পার্ভাটের দলকে দেখতে পাওয়া যায় যারা ধর্মীয় ইস্যুতে, মিডিয়ায় কাজ করার অপরাধে, অভিনেতা-অভিনেত্রী হবার অপরাধে মেইনস্ট্রিম প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার ফেসবুক পেইজ থেকে শুরু করে সকল প্ল্যাটফর্মে নোংরামি ও কটূক্তি শুরু করে। কে বেহেশতে যাবে আর কে দোযখে যাবে তার ইজারাদার হিসেবে সিদ্ধান্ত দেওয়া থেকে শুরু করে ব্যাক্তিজীবন এবং কর্মক্ষেত্র নিয়ে এই কূপমণ্ডূকের দল অশ্রাব্য ভাষায় নোংরা সাইবার বুলিইং-এর মাধ্যমে পুরো সোশ্যাল মিডিয়া নেটওয়ার্কই নোংরা করে তোলে। দুঃখজনক হলেও সত্য, মিডিয়া হাউজগুলো এদের পেইজ থেকে ব্যান করা, নোংরা কমেন্ট মুছে দেওয়া কিংবা এদের সংঘবদ্ধ চক্রের বিরুদ্ধে কোন দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে এমন উদাহরণ নেই বললেই চলে।

কদিন আগে এদের বিরুদ্ধে স্ট্রিক্ট মডারেশন ও ব্যবস্থা নেওয়ার সরাসরি সিদ্ধান্তের ঘোষণা দেয় Sarabangla.net। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে পেইজের পোস্টের কমেন্ট কমে যেতে পারে, এনগেজমেন্ট কমে যেতে পারে, কিন্তু সেটার পরোয়া না করে এই উন্মত্ত অমানুষদের নোংরামি এবং সাইবার বুলিইং-এর বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে মেইনস্ট্রিম এই মিডিয়া হার্ড লাইনে গেছে। দুঃখজনকভাবে প্রথমসারির পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলগুলো থেকে শুরু করে অন্যান্য মেইনস্ট্রিম মিডিয়া এখনো তাদের পেইজের পোস্টে সাম্প্রদায়িক ও সেক্সিস্ট নোংরামিসহ সাইবার বুলিইং-এর বিরুদ্ধে কোন ধরনের ব্যবস্থা নিতে এগিয়ে আসেনি।

ফলে শুধুমাত্র বিখ্যাতদের মৃত্যুর ঘটনাই নয়, মেনস্ট্রুয়েস্ন বা মাসিক, বৈবাহিক ধর্ষণ, কনসেন্ট বা মতামত, সমকামিতা, নারী নির্যাতনসহ নারীদের নিয়ে যে কোন সাধারণ ইস্যুতেও কমেন্টবক্সে এদের নোংরা দৌরাত্ম্য ভয়ংকর পর্যায়ে চলে গেছে। ফেসবুকে পত্রিকা বা চ্যানেলগুলোর কমেন্ট বক্স, জনপ্রিয় কোন সংগঠনের পেইজ, অনলাইন পোর্টাল কিংবা ওয়েব ম্যাগাজিনের পেইজে এবং ওয়েবসাইটের কন্টেন্টের নীচে, জনপ্রিয় সেলেব্রেটিদের পেইজের পোস্টের নীচে, যে কোন জনপ্রিয় পেইজের কমেন্টবক্স, অনলাইনে পত্রিকার সংবাদের নীচের কমেন্ট বক্স সর্বত্র স্রেফ চোখ বোলালেই গা ঘিনঘিন করে ওঠে এদের আক্রমণ আর নোংরামি দেখে। নারীদের হ্যারাস করা, গালাগালি করা, অশ্রাব্য ভাষায় নোংরামি করা শত শত কমেন্টে এমনভাবে কমেন্টবক্স ভরে থাকে যে ন্যুনতম সভ্য ভদ্র শিক্ষিত কেউ সেখানে গিয়ে দুটো ভালো কথা, খবর বা ফিচারটা নিয়ে একটা ভালো আলোচনা করবার রুচি পাবেন না।

অথচ অনলাইনে মননশীল মেধাবী সৃজনশীল মানুষদের তুলনায়, ভালো মানসিকতার অসংখ্য মানুষের তুলনায় এই নোংরা চিন্তাভাবনার বর্বরেরা সংখ্যায় বেশি না, কিন্তু যখন সংশ্লিষ্ট অনলাইন পোর্টাল কিংবা টিভি চ্যানেল কিংবা ফেসবুক পেইজ কিংবা পত্রিকার পক্ষ থেকে যখন ন্যুনতম কোন মডারেশনের ব্যবস্থা থাকে না, রীতিমত ‘যত কমেন্ট, তত রিচ’ এই নীতিতে কমেন্টবক্সে আসা বাজে কমেন্টকারীদের ব্যান দেওয়া অথবা নিদেনপক্ষে কমেন্টগুলো ডিলিট করে আলোচনার জায়গাটা পরিষ্কার রাখা হয় না, তখন আসলে সত্যিকারের মননশীল পাঠকেরা ধরে নেন যে কটুক্তিকারী অমানুষেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। অনলাইন বা সোশ্যাল মিডিয়ায় যেকোন বিষয়ে আলোচনার একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হচ্ছে পেইজ বা প্রোফাইলের পোস্টের কমেন্টবক্স। পোস্টের রিচ বাড়াবার জন্য, এঙ্গেইজমেন্ট বাড়াবার জন্য সেই আলোচনার জায়গাটা দিনের পর দিন এভাবে নষ্ট হতে দেখাটা, নোংরা ভাগাড়ে পরিণত হতে দেখাটা ভয়ংকর হতাশার।

প্রতিষ্ঠিত প্রথম সারির পত্রিকা, টেলিভিশন ও ডিজিটাল মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়ার জনপ্রিয় পেইজ এবং জনপ্রিয় সেলেব্রেটিদের পেইজগুলো কি অনলাইনে সাইবার বুলিইং-এর বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেবে না? অন্যায়-নোংরামি বিরুদ্ধে আমাদের সকলের মোরাল আর এথিক্যাল গ্রাউন্ডের যাবতীয় নীতি-নৈতিকতাভিত্তিক স্লোগানগুলো যদি ধর্তব্যে নাও আনি, তারপরেও নিজেদের ফেসবুক পেইজের আলোচনার জায়গাটা, গঠনমূলক আইডিয়া শেয়ারিং-এর জায়গাটা কিছু নোংরা মানসিকতার অমানুষের দখলে চলে যেতে দেখতে কি একবারও বিবমিষা জাগে না সংশ্লিষ্ট প্রিন্ট ইলেক্ট্রনিক সোশ্যাল মিডিয়ার জনপ্রিয় পেইজগুলো দায়িত্বশীলদের?

অথচ সবাই মিলে চাইলেই খুব সহজে সাইবার স্পেসকে পরিষ্কার রাখা সম্ভব। উগ্র ধর্মান্ধ পার্ভার্ট আর অমানুষের দলকে সুযোগ না দিলে, পেইজে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিলে, তাদের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করলে, দরকার হলে আইনী পথে হাঁটলে তাদের নোংরামির পরিমাণ রাতারাতি কমে আসবে। কিন্তু সেজন্য আগে আমাদের সচেতন হতে হবে। শত শত নোংরা কমেন্টের মাধ্যমে না, কোন একটা টপিকে সুস্থ, সুন্দর আলোচনা এবং গঠনমূলক আলাপের মাধ্যমেই পেইজের এঙ্গেইজমেন্ট বা পোস্টের রিচ বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে সবাই মিলে। আমাদের সামস্টিক প্রতিজ্ঞা এবং সর্বাত্মক চেষ্টাই পারে সোশ্যাল মিডিয়া এবং অনলাইন স্পেসকে সাইবার বুলিইং থেকে মুক্ত রাখতে।

এখনই সময় সিদ্ধান্ত নেওয়ার।

এন্ড্রু কিশোর এন্ড্রু কিশোরের মৃত্যু সাইবার বুলিং সাইবার বুলিইং হানিফ সংকেত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর