অন্তত প্রশ্ন তুলতে দিন!
১২ জুলাই ২০২০ ১৪:২৮
বাংলাদেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণের পাগলা ঘোড়া দড়ি ছিড়েছে বহু আগে। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও নানা সমন্বয়হীনতায় আমরা সংক্রমণের লাগাম টেনে ধরতে পারিনি। সাধারণ ছুটি নামক ‘লকডাউন’ আর ‘সীমিত পরিসরে’র লুকোচুরিতে তিনমাস শেষ। এখন সংক্রমণ, অভুক্ত পেটের ক্ষুধা, বেকারত্ব, চিকিৎসা না পেয়ে মানুষের অসহায়ত্ব একযোগে বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বাংলাদেশ অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার মতো কাজ করছে।
আমাদের সমসাময়িক সময়ে লকডাউন করা অন্যতম কসমোপলিটন সৌদি আরব। সম্প্রতি তারা লকডাউন খুলে দিয়েছে। অথচ এই সময়ে ঢাকার মেয়র আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এসে বলছেন, ‘তিনি লকডাউনের জন্য প্রস্তুত আছেন। অপেক্ষা শুধু এলাকা ভিত্তিক সিদ্ধান্তের।’
দেশে আক্রান্ত রোগীদের অর্ধেকের বেশি ঢাকা শহরের। তিনমাস পর এসে সে শহরের মেয়র লকডাউনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন! তবে আমরা কবে সে কাঙ্খিত লকডাউন পাবো আর কবে দেশ কোভিডমুক্ত হবে!
আমরা আসলে কেউই ভালো নেই। ইতোমধ্যে অনেকের স্বজন, পরিচিতজন আক্রান্ত ও মারা গেছেন। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে সুস্থ আছি এটা ভেবেই নিজেকে সবচেয়ে ভাগ্যবান বলে মনে হয়।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের জরিপ বলছে, করোনার কারণে দেশের ৯৫ শতাংশ মানুষের আয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে মানুষ প্রয়োজনীয় মৌলিক চাহিদা পূরণ করতেও হিমশিম খাচ্ছে।
বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট প্রত্যাশী বালকের মতো উৎকন্ঠা আর উদ্বেগ নিয়ে প্রতিদিন দুপুর আড়াইটায় দেশের মানুষ টিভি সেটের সামনে বসে দেশের সর্বশেষ করোনা পরিস্থিতি জানার জন্য।
একদিন হঠাৎ করেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলে বসলেন, ‘বাংলাদেশে সংক্রমণ ২-৩ বছর ধরে চলতে পারে।’ ২-৩ বছর কেন, কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে আরও কয়েকবছর ধরে চলবে সংক্রমণ। আর কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করলে ২-৩ মাসেই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব তা দেখিয়ে দিয়েছে বিশ্বের অনেক দেশ।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ছবি ভাইরাল হয়েছে। নোয়াখালির হাতিয়া উপজেলায় রোগীকে বাঁচাতে না পেরে এক ডাক্তার হতাশ হয়ে বসে আছেন। সেই ডাক্তার নিজাম গণমাধ্যমে বলেন, তার উপজেলায় ভেন্টিলর তো নেই-ই, সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহ পর্যন্ত নেই। তারা শুধু কোভিড রোগী নয়, অন্যান্য শ্বাসকষ্টের রোগীদের সঠিক চিকিৎসা দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। এটা আসলে দেশের সব উপজেলার চিত্র। ঢাকার বাইরের চিত্র গণমাধ্যমে সেভাবে উঠে আসছে না।
বিশ্বব্যাপি করোনা সংক্রমণ শুরুর সময় দেশে সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকারের প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন উঠলে বলা হয়, সরকার সম্পূর্ণ প্রস্তুত। দেশের জেলা-উপজেলায় করোনাভাইরাস প্রতিরোধে টিম গঠন করা হয়েছে। অথচ জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) আঞ্চলিক কার্যালয় বলছে, করোনাকালে নাগরিকদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুরক্ষায় এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ১৮ টি গুরুত্বপূর্ণ দেশের মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ।
বর্তমানে দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৪৩ টিতে করোনা পরীক্ষাকেন্দ্র নেই। যেসব স্থানে নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে সেখানেও দীর্ঘ লাইন। লাইনে নেই স্বাস্থ্যবিধি মানার নূন্যতম ব্যবস্থা। নমুনা পরীক্ষার ফলাফল এক সপ্তাহেও পাওয়া যাচ্ছে না অনেক ক্ষেত্রে। নমুনা প্রদানকারীদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে তিন চতুর্থাংশ নন-কোভিড। কিন্তু নমুনা প্রদানের সময় স্বাস্থ্যবিধি না মানায় যারা নন-কোভিড তাদেরো সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি থাকছে।
সংক্রমণ অব্যাহত থাকার পরও ‘সীমিত পরিসরে’ সব খুলে দেওয়ার ১৫ দিন পর সংক্রমণ অনুসারে লাল, হলুদ ও সবুজ জোনে ভাগ করে লকডাউনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু সে ঘোষণা নিয়ে নানা সমন্বয়হীনতা চলেছে। গণমাধ্যমে জোন ভিত্তিক লকডাউনের খবর প্রকাশ হলেও কোন জোনে জনগণকে কি নিয়ম মেনে চলতে হবে তার স্পষ্ট ব্যাখ্যা সরকারের পক্ষ থেকে ছিল না। এখন বলা হচ্ছে করোনা পরীক্ষা করার জন্য রোগীকে অর্থ দিতে হবে।
জনগণ আর কত দেবে! মোবাইলে ৩৩ শতাংশ কর দিতে হচ্ছে, ‘ভূতুড়ে’ বিদ্যুৎ বিল দিতে হচ্ছে, ওয়াসার পানির বিল বাড়ানো হচ্ছে। গত ১০ বছরে ৮ বার বিদ্যুৎ বিল বাড়ানো হয়েছে। ব্যর্থ কুইক রেন্টালে ৬ বছরে ৬২ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে সরকার। অথচ জনগণ আজ করোনা টেস্ট করাতে পারছে না, হাসপাতালে বেড পাচ্ছে না, অক্সিজেন পাচ্ছে না, অন্যান্য রোগেরও চিকিৎসা পাচ্ছে না! প্রশ্নও তুলতে পারছেন না।
করোনার উৎকন্ঠার মধ্যে শুরু হয়েছে আরেক আতঙ্ক, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা আর গ্রেফতার। ডয়েচে ভেলের বাংলা বিভাগ বলছে, করোনা সংক্রমণের মধ্যে এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা ও গ্রেফতার বেড়ে গেছে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে যখন কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রির বিরুদ্ধে ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার’ দায়ে একজন কিশোর গ্রেফতারের খবর প্রকাশ হয়; একটি অসহিষ্ণু বাংলাদেশের ছবি ভাসে।
শুরু থেকেই জগাখিচুড়ি মার্কা পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে হচ্ছে। ইতালি ফেরত প্রবাসীদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা যায়নি। কঠোর লকডাউন না দিয়ে সাধারণ ছুটি দিয়ে গণপরিবহন চালু রাখা হলো। মানুষ ছুটল শহর থেকে গ্রামে, সাথে ছুটলো সংক্রমণও। কোনো ধরনের পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি ছাড়াই পায়ে হাঁটিয়ে গার্মেন্টস শ্রমিকদের আবার শহরে এনে ফের ফেরত পাঠানো হলো।
ডাক্তাররা পর্যাপ্ত মাস্ক ও পিপিই পায়নি বলে এনজিও সংস্থা ব্র্যাকের জরিপে উঠে এসেছে। ফলে ‘করোনা যুদ্ধে’ গত আড়াই মাসে প্রাণ দিয়েছে ৫৩ জন ডাক্তার। শুরুতে বেসরকারি হাসপাতালে নমুনা পরীক্ষা করা যায়নি। এখন পরীক্ষা করার অনুমতি দিলেও অন্যান্য রোগের চিকিৎসা পাওয়া যাচ্ছে না। আবার এই মুহুর্তে সরকারি হাসপাতালে যদি কোভিড টেস্টের জন্য রোগীকে ফি দিতে হয় তবে বেসরকারি হাসপাতালে শুরু হবে রমরমা বানিজ্য! ফলে আর্থিক কষ্টে থাকা বোবা কান্নারত জনগণ দিনে দিনে আরও অসহায় ও জিম্মি হয়ে পড়বে। অথচ জনগণকে প্রশ্ন করতে দিলে, সমালোচনাকে গ্রহণ করলে অনেক অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি এড়ানো যেত!
প্রশ্নের উত্তর নেই বলে প্রশ্ন উত্থাপন আটকে দিবেন না। অন্তত প্রশ্ন তুলতে দিন।