Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দক্ষিণ এশিয়ার যুদ্ধের ঝনঝনানি, থামবে কবে


১৪ জুলাই ২০২০ ১৬:৪৮

শাহাদাত হোসাইন স্বাধীন

বিশ্বের অন্যতম সম্পদশালী অঞ্চল দক্ষিণ এশিয়া। শিল্প বিপ্লবের শুরু থেকে কাঁচামাল ও সস্তা শ্রমিকের জন্য উপনিবেশ দেশগুলোর নজর পড়ে দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারতীয় উপমহাদেশের উপর। মুঘল আমল, উপনিবেশিক শাসন এমনকি স্বাধীনতার পরও দক্ষিণ এশিয়ায় চলেছে কখনো তরবারি, কখনো ট্যাংকের ঝনঝনানি। কখনো ধর্ম, কখনো জাতীয়তাবাদের হুংকারে থেমে থেমে যুদ্ধে লিপ্ত থেকেছে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী ভারত-পাকিস্তান।

বিজ্ঞাপন

আজ চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে এসেও দক্ষিণ এশিয়া যুদ্ধের দুষ্টচক্র থেকে বের হতে পারেনি। ফলে বিশ্বের এক চতুর্থাংশ জনসংখ্যার এই অঞ্চলের মানুষের দারিদ্রতা ও ক্ষুধা এতটুকু কমেনি।

দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ দেশ ভারত-পাকিস্তানের সম্পর্ক এক অদৃশ্য দুষ্টচক্রে ঘুরেছে বারবার। সন্ত্রাসবাদ, নদীর পানির হিস্যা, সীমান্তে সংঘাত নিয়ে দুই দেশের সম্পর্কে উত্তেজনা থাকলেও শেষ পর্যন্ত আলোচনা থেমেছে কাশ্মীর ইস্যুতে।

দুই দেশের ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর তাসখন্দ চুক্তি অন্যদিকে ১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তি আদতে সম্পর্কে কোন সুফল আনতে পারেনি। স্বাধীনতাত্তর ভারত ও পাকিস্তানের কাছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র বিমোচনের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে সামরিক বাজেট। সামরিক উচ্চাভিলাসী পাকিস্তান সামরিক জোট বাগদাদ প্যাক্ট (১৯৫৫-৫৮), SEATO (১৯৫৪), CENTO (১৯৫৮-৭৯) এ হয়ে ওঠে অন্যতম অংশীদার। ভারতও তার জোট নিরপেক্ষতার খোলস ভেঙে রাশিয়ার সাথে সামরিকভাবে ঘনিষ্ট হয়ে উঠে।

১৯৭৪ সালে ভারত পোখরান পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটালে পাক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানীরা প্রয়োজনে ঘাস খাবে, তবু তারা পারমাণবিক বোমা বানাবে।’

বিজ্ঞাপন

কোন পর্যায়ের সামরিক উত্তেজনায় ব্যস্ত ছিল প্রতিবেশী দুই দেশ তা এই মন্তব্যে অনুমেয়। তবে রাজীব গান্ধির শাসনামলে ও পাকিস্তানে বেনজির ভূট্টো প্রধানমন্ত্রী হলে দুই দেশের সম্পর্কে বরফ গলা শুরু হয়। ১৯৮৩ সালে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে যৌথ কমিশন গঠন করা হলেও পরবর্তী বছরই সিয়াচেন হিমবাহের মতো বরফের মরুভূমি নিয়ে সংঘাতে জড়ায় দুই দেশ। যদিও ১৯৮৫ সালে দুই দেশ পরস্পরের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা না করার প্রতিশ্রুতি দেয়। ১৯৮৮ সালে পাকিস্তানের মার্কিন অস্ত্র ক্রয়, ১৯৮৯ সালে বেনজির ভূট্টো উত্তর কোরিয়া থেকে মিসাইল ক্রয়ের চুক্তি করলে সম্পর্ক আবার অস্থিতিশীল হয়ে উঠে। ১৯৯১ সালে সেপ্টেম্বরে আজাদ কাশ্মীর ও জম্মু কাশ্মীরের পুঞ্চ জেলায় সংঘাত, অক্টোবরে কার্গিলে উত্তেজনা ও পরবর্তী বছরে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভাঙা নিয়ে সম্পর্ক এতোটা বিষিয়ে ওঠে যে করাচির ভারতীয় দূতাবাস পর্যন্ত বন্ধ করা হয়।

১৯৯৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাজপেয়ি-নওয়াজ শরীফের বাস কূটনীতি চালু হলেও সে বছরের মে-জুন মাসে কারগিলে ফের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে দুই দেশের সেনাবাহিনী। ১৯৯৩ সালে মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসী হামলা, ১৯৯৯ সালে কাঠমুন্ডু- দিল্লী আইসি-৮১৪ বিমান অপহরণ, ২০০১ সালে ভারতীয় সংসদে সন্ত্রাসী হামলা এবং আলোচিত ২৬/১১ মুম্বাই হামলার জন্য ভারত পাকিস্তানকে দায়ী করে। ফলে কোনভাবে আগাতে পারেনি দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি প্রক্রিয়া। ভারত পাকিস্তান কাশ্মীর সীমান্তে যে পরিমাণ সামরিক ব্যয় করেছে তা দিয়ে হয়তো আরেকটি নতুন কাশ্মীর বানানো যেত। ১৯৮০ সালেও চীন-ভারতের জিডিপি ছিল সমান কিন্তু আজ চীন প্রায় ১৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি আর ভারতের জিডিপি ৩.২ ট্রিলিয়ন ডলার। চীন পুরা বিশ্বে তার বাজার তৈরী করেছে। অন্যদিকে ভারত ও পাকিস্তান তাদের সামরিক উত্তেজনার বশে দারিদ্রমুক্ত দক্ষিণ এশিয়ার স্বপ্ন দেখা আঞ্চলিক জোট সার্ক’কে কার্যকর করতে দেয়নি।

২০১৪ সালে ভারতে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার প্রথম বছরে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, নেপাল, ভূটান সফর করেন অন্যদিকে একই বছরে চীন, রাশিয়া ও বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টকে উড়িয়ে নিয়ে যান দিল্লী। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে পাক প্রধানমন্ত্রীর নওয়াজ শরীফের জন্মদিনে একযুগ পর ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসাবে পাকিস্তান সফর করেন মোদি। ‘পঞ্চশীল’ ও ‘হিন্দি চীনা ভাই ভাই’ কূটনীতিকে ভারত–চীন সম্পর্কের ভিত্তি ধরা হয়।

২০১০ সালে চীন-ভারত-রাশিয়া-ব্রাজিল-দক্ষিণ আফ্রিকার জোট ব্রিকস গঠন চীন-ভারত সম্পর্ক উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যায়। সাংহাই কর্পোরেশনে ভারত ও পাকিস্তানের যোগদান একটি শান্তিপূর্ণ দক্ষিণ এশিয়ার বার্তাকে দৃঢ় করছিল। চীনের প্রত্যাশা ছিল ভারত চীনের প্রস্তাবিত বেল্ট এন্ড রোড ইনেশিয়াটিভে যোগ দেবে। কিন্তু ২০১৬ সাল থেকে ভারতের পলিসি বদলে যায়। উরি হামলাকে কেন্দ্র করে সার্ক সম্মেলন বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিতর্কিত কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে বিজেপি একপাক্ষিক সিদ্ধান্ত নিয়ে মোদির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ আজাদ কাশ্মীর, আকসাই চীন ও গিলগিট-বাল্টিস্তান দখলের হুমকি দেন। এই হুমকি ভারতের বৃহৎ বানিজ্যিক অংশীদার চীনকেও সীমান্ত সংঘাতে নিয়ে আসে। ফলে একটি শান্তিপূর্ণ ও বানিজ্যবান্ধব দক্ষিণ এশিয়ার সম্ভাবনা যেন নিমিষেই বিলীন হয়ে যায়।

এই করোনা মহামারির সময়ে সীমান্ত সংঘাত ও বানিজ্য যুদ্ধে মেতে উঠেছে ভারত-চীন। ভারত-চীনের গালওয়ান সীমান্ত সংঘাত ডেকে এনেছে পাকিস্তানকেও। তারাও গিলগিট-বালতিস্তান প্রদেশ সীমান্তে সামরিক উপস্থিতি ঘটিয়েছে। এমন মহামারির দিনেও পাকিস্তান ২০২০-২০২১ অর্থবছরে প্রতিরক্ষা খাতে বাজেট করেছে ৮৭৫ কোটি ডলার অন্যদিকে স্বাস্থ্য খাতে ধরা হয়েছে মাত্র ১৫ কোটি ডলার। দেশটির ৪১ শতাংশ ব্যয়ই বৈদেশিক ঋণ আর কোভিড-১৯ দরিদ্র্র জনগোষ্ঠীকে আরও দরিদ্র করেছে তবু দেশটিতে প্রাধান্য পাচ্ছে সামরিক ব্যয়। অন্যদিকে সামরিক ব্যয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পরই ভারতের অবস্থান। ২০১৯ সালে ভারতের সামরিক ব্যয় ছিল ৭১.১ বিলিয়ন ডলার। ২০২০-২০২১ তে তা ধরা হয়েছে ৭৩.৬৫ বিলিয়ন ডলার যার মধ্যে শুধু সামরিক সরঞ্জাম কেনা হবে ১৮.৫২ বিলিয়ন ডলারের। অথচ স্বাস্থ্য খাতে ৯.১৯ বিলিয়ন ডলারের বাজেট।

অষ্ট্রেলিয়া-যুক্তরাষ্ট্র-ভারত-জাপানের মধ্যে এক দশক ধরে ‘QUAD’ নামে যে আতাঁত ঘটে উঠছে সে জোট আগামী মাসে চীনকে লক্ষ্য করে বৃহৎ নৌ মহড়া করার পরিকল্পনা করছে। চীন ভারতকে নানা সামরিক বেইস দিয়ে ঘিরে ফেলেছে। চীন কর্তৃক ইয়াঙ্গুনের গ্রেট কোকো রিফ, রাখাইনের (আরকান) কাউয়ুকপায়ুতে সামরিক ঘাঁটি ও শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা, পাকিস্তানের গোয়াদারে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ ও মালদ্বীপে দ্বীপ কেনার ফলে ইন্দো-মার্কিন সামরিক ঘাঁটি দিয়াগো গার্সিয়া ও আন্দোমান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের সামরিক ঘাঁটি হুমকির মুখে পড়েছে। ফলে আরও বড় ধরনের সামরিক ব্যয়ের দিকে ঝুঁকতে যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়া বিশেষ করে ভারত। কিন্তু গত চার-পাঁচ বছর আগেও চীন-ভারতের বানিজ্য সম্পর্ক ছিল বলার মতো।

ভারতের অতিরিক্ত মার্কিন বলয়ে ঢুকে পড়া, কাশ্মীর ইস্যুতে মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক টানাপোড়ন ভারতকে ‘QUAD’ বলয়ের একটা সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত করছে। যা দক্ষিণ এশিয়ায় যুদ্ধ প্রতিযোগিতা বাড়াচ্ছে। ইতিমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া ভারতীয় সামরিক ঘাঁটি ব্যবহার সংক্রান্ত চুক্তি করেছে ভারতের সাথে। তবে অস্থিতিশীল দক্ষিণ এশিয়ার জন্য চীনের দায়ও কম নয়। লাদাখের সীমান্তবর্তী ভারতীয় দৌলতবেগ আলভি বিমানঘাঁটি অভিমুখে রাস্তা নির্মাণে বাধা দিচ্ছে চীন। সীমান্তে ভারতীয় সামরিক উপস্থিতিতে চীন স্বায়ত্বশাসিত তিব্বত ও উইঘুর অধ্যুষিত জিংজিয়াং প্রদেশের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। ফলে চীন ভারতের দিকে অস্ত্র তাক করছে। তবে চীনের এটা জেনে রাখা উচিত কেউ বৃহৎ পরাশক্তি হতে চাইলে তাকে আঞ্চলিক প্রতিবেশীদের নিয়ে ‘রিজিওনাল পিস’ বজায় রাখতে হয়।

তাইওয়ান, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের সাথে চীনের সম্পর্ক ভালো না। বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের সাথে সম্পর্কহানি তাদের আরও অনিরাপদ করবে। ভারত চীন দুই দেশেরই বোঝা উচিত তারা ব্যবসাকে প্রাধান্য দিলে এই অঞ্চলের চেহারা বদলে দিবে। সিকিম, ভূটান হয়ে ভারতের উত্তর পূর্ব রাজ্য ও বাংলাদেশের সাথে বানিজ্য যোগাযোগ তৈরী হলে আসিয়ানের চেয়ে বড় একটি বাজারে পরিণত হবে দক্ষিণ এশিয়ার অবহেলিত এই অঞ্চল। ভারতীয় মহলে অভিযোগ পাকিস্তান চায়না করিডোরের মাধ্যমে পাকিস্তান চীনের ঋণের জালে আটকা পড়ছে। এই আশঙ্কা সত্যি হয়ে থাকলে ভারতেরই পাকিস্তানের পাশে দাঁড়ানো উচিত। চীনের ওপর নির্ভরশীল প্রতিবেশী ভারতের জন্য মঙ্গলকর হবে না। বরং প্রতিবেশী পাকিস্তানের সাথে দেশের সাথে সম্পর্কে উন্নয়ন ঘটলে পারস্য উপসাগর অভিমুখে ভারতের নৌ চলাচল নিরাপদ হবে।

সার্ককে কার্যকর করার মধ্য দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় অভ্যন্তরীণ বানিজ্য ও যোগাযোগ বাড়লে ভারতই বিশ্বের সাথে আরও বেশী সংযুক্ত হবে এবং নিরাপদ সীমান্ত তৈরী হবে। তবে বর্তমান মোদি সরকারের পলিসি ভারতকে দক্ষিণ এশিয়ায় বন্ধুহীন করে তুলেছে। দেশগুলোতে বাড়ছে সামরিক ব্যয়। ফলে হুমকিতে পড়েছে একটি সমৃদ্ধ দক্ষিণ এশিয়ার স্বপ্ন। একটি ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত উন্নত দক্ষিণ এশিয়া গঠনের জন্য নেতাদের সর্বপ্রথম যুদ্ধের চক্র থেকে বের হতে হবে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক

 

সারাবাংলা/এসবিডিই

দক্ষিণ এশিয়া পাকিস্তান ভারত-চীন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর