চিকিৎসার নামে বাণিজ্য, কঠোর নজরদারি জরুরী
১৯ জুলাই ২০২০ ১৩:৪২
গোপাল অধিকারী
বাংলাদেশে চিকিৎসা নিয়ে বাণিজ্য নতুন কিছু নয়। চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসা বন্ধ হয়নি এখনো। অভিযান, আইন প্রয়োগ ও শাস্তি প্রয়োগের নানা কর্মকান্ডের পরও স্বাভাবিক হয়নি সেক্টরটি। চিকিৎসকবিহীন চিকিৎসা, প্রয়োজনবিহীন টেস্ট আর প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিবিহীন রিপোর্ট; নির্মূল হয়নি এসব প্রতারণা।
সর্বশেষ করোনা নিয়েও চলছে চিকিৎসা বাণিজ্য। আমরা দেখেছি, করোনার সার্টিফিকেট জালিয়াতি বা অনুমোদনহীন করোনার নমুনা সংগ্রহ। কতোটা অমানবিক হলে এই সংকটময় সময়ে চিকিৎসার নামে বাণিজ্য করা যায়; তা আমার কাছে বোধগম্য নয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলেই সার্টিফিকেট জালিয়াতি করা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করার খবর পেয়েছি। সর্বশেষ চিকিৎসা সেক্টরের অপরাধের মাঝে ঘি ঢেলেছেন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী ও রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ।
করোনা মহামারিতে মানুষের জীবন নিয়ে নির্মম প্রতারণায় উঠে এসেছে সাবরিনা চৌধুরী নামে এক নারী চিকিৎসক ও তার স্বামীর নাম। জেকেজি নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে তদন্ত করতে গিয়েই উঠে আসে তাদের নাম।
জেকেজির ব্যাপারে তদন্ত করে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা না করেই প্রতিষ্ঠানটি ১৫ হাজার ৪৬০ জনকে করোনা টেস্টের ভুয়া রিপোর্ট দিয়েছে। গুলশানে তাদের অফিসের ১৫ তলার ফ্লোরে থাকা একটি ল্যাপটপ থেকেই এসব মনগড়া করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট তৈরি করে নমুনা প্রদানকারীদের মেইলে পাঠাতো তারা। প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয় থেকে জব্দ করা ল্যাপটপ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে করোনা টেস্ট জালিয়াতির এমন চমকপ্রদ তথ্য মিলেছে।
টেস্টের জন্য জনপ্রতি সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার টাকা নিতো জেকেজি। বিদেশি নাগরিকদের কাছ থেকে নিতো জনপ্রতি একশ’ ডলার। হিসাব করে দেখা যায়, করোনা টেস্ট বাণিজ্য করে জেকেজি হাতিয়ে নিয়েছে সাত কোটি ৭০ লাখ টাকা।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত সাবরিনার হাত ধরেই করোনার স্যাম্পল কালেকশনের কাজটি ভাগিয়ে নেয় জেকেজি। ঢাকার তিতুমীর কলেজের মাঠে স্যাম্পল কালেকশন বুথ স্থাপনের অনুমতি পেলেওও প্রভাব খাটিয়ে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা এবং ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলা থেকেও নমুনা সংগ্রহ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
বিএমএর নেতার পরিচয় ভাঙিয়ে চলাফেরা করতেন সাবরিনা। গত ২৪ জুন জেকেজির গুলশান কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে আরিফসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের দুই দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। দু’জন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। এ ঘটনায় তেজগাঁও থানায় চারটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
সন্দেহভাজন করোনা রোগীদের নমুনা সংগ্রহের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে চুক্তি ছিল জেকেজির। পরে ওই চুক্তি বাতিল করা হয়। জেকেজির চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা চৌধুরী জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক। তার স্বামীর নাম আরিফ চৌধুরী। এই দম্পতির জীবনযাপনও রূপকথার গল্পের মতো।
দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তা হয়ে সাবরিনার এমন অনৈতিক কর্মকান্ড কোনো বিবেকবান সমাজ মেনে নিতে পারে না। শুধু সাবরিনাই নয়, তার মতো বহু সাবরিনা চোখের আড়ালে কিংবা চোখের সামনেই অনিয়ম করেই চলছেন। দেখেও দেখছেন না পদধারীরা। এমন ঘটনা চলছেই, থামছে না। সময় ও নামের শুধু পরিবর্তন দেখি। কিন্তু কেন? এই অব্যবস্থাপনার জন্য আসলে দায়ী কারা?
শুধু এই কেলেঙ্কারিই নয়। মডেল হওয়ার জন্যও চেষ্টা করেছেন সাবরিনা। নানা ভঙ্গির ছবি প্রকাশ করে তোলপাড় সৃষ্টি করেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। একজন চিকিৎসকের কাছ থেকে এমনটা আশা করে না সমাজ।
এবার চোখ রাখি সাহেদের দিকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ কেউ তাকে বোরকা সাহেদ নামে আবার কেউ কেউ সাহেদা নামেও উপস্থাপন করছেন। ঘটনা সবারই জানা। গত ৬ জুলাই রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযানের পর সাহেদসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। অভিযানের পর প্রতারণার দায়ে রিজেন্ট হাসপাতাল ও প্রধান কার্যালয় সিলগালা করে দেয় র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।
ঘটনার পর চোখের আড়ালে চলে যান সাহেদ। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি তার। দেশজুড়ে আলোচিত রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ গ্রেপ্তার হন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে। ১৫ জুলাই বুধবার ভোরে সাতক্ষীরা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
করোনার নমুনা পরীক্ষার মনগড়া রিপোর্ট দেয়ার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়ছে। কেবল করোনা নিয়েই প্রতারনা নয়, বহু অপকর্মের সাথে জড়িত সাহেদ; সেসব বেরিয়ে আসছে গণমাধ্যমে। জানা গেছে, ২০১০ সালের দিকে ধানমন্ডি এলাকায় বিডিএস ক্লিক ওয়ান এবং কর্মমুখী কর্মসংস্থান সোসাইটি (কেকেএস) নামে দুটি এমএলএম কোম্পানি খুলে গ্রাহকদের কাছ থেকে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় সাহেদ।
সাহেদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩২টি মামলা খুঁজে পেয়েছেন র্যাব। এর বেশিরভাগই প্রতারণা মামলা। কারণ প্রতারণা করে অর্থ-সম্পদ গড়ে তোলাই ছিল তার মূলকাজ। এ জন্য করোনা মহামারি চলাকালেও স্পর্শকাতর একটি বিষয়েও সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণা করতে বিবেকে বাঁধেনি তার। ২০১১ সালে প্রতারণা মামলায় একবার গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন সাহেদ। কিন্তু অর্থের বিনিময়ে দ্রুতই তিনি জামিন নিয়ে কারাগার থেকে বের হয়ে আসেন। এরপর প্রতারণার অর্থ দিয়ে তিনি রিজেন্ট গ্রুপ নামে ব্যবসা শুরু করেন। চালু করেন রিজেন্ট হাসপাতাল।
২০১৪ সালে রিজেন্ট হাসপাতালের লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এই নিয়েও আছে লম্বা ইতিহাস। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, রিজেন্ট হাসপাতালকে অনুমোদন দেয়া হতো না যদি না মন্ত্রণালয় থেকে না বলা হতো। অন্যদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, রিজেন্ট হাসপাতালের সাথে চুক্তির আগে অধিদপ্তর তাদের কাছে কোনো নথি পাঠায়নি, কোনো প্রস্তাবও পাঠায়নি।
জানা গেছে, করোনা নিয়ে হাসপাতালটির সাথে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের অনুষ্ঠানে মন্ত্রীকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল। সেই দাওয়াতেই মন্ত্রী উপস্থিত হয়েছিলেন। এসব বিষয় সামনে আসতেই মন্ত্রনালয় থেকে জানানো হলো, স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের পূর্বের প্রধান সম্মতি দিয়েছিল। এই তথ্যের গড়মিল বা নিজেকে বাঁচানোর প্রবণতা থেকে সহজেই বোঝা যায় স্বাস্থ্যখাতের কালো বিড়ালের ইতিহাস।
চিকিৎসা নিয়ে ব্যবসা বা জনগুরুত্বপূর্ণ এই সেক্টরের অব্যবস্থাপনা কোনভাবেই কাম্য নয়। সাধারণ জনগণ ও গুরুত্বপূর্ণ জনগণ- এই দুই নামের জনগণ আছে কিনা বা তাদের জন্য আইনের ফাঁক-ফোকর আছে কিনা তা নিয়ে আমি বেশ সঙ্কিত। সঙ্কিত এই কারণে যে, আমরা সাধরণ জনগণ যে কোনো প্রতিষ্ঠান করতে গেলে জাতীয় পরিচয়পত্র থেকে শুরু করে এই সার্টিফিকেট-সেই সার্টিফিকেট, সত্যায়িত, প্রমাণিত কতো কিছুর প্রয়োজন হয়। কিন্তু সাহেদ বা সাবরিনার কি কিছুই প্রয়োজন হয়নি? তাদের জন্য কি নিয়মটা ভিন্ন ছিল, না তাদের বৈধ্যতাদানের প্রতিষ্ঠান ভিন্ন ছিল যে এতো অপকর্ম থাকার পরও তারা চিকিৎসা নিয়ে ব্যবসা করতে পারল। শুধু বেসরকারি সেক্টরেই নয়, গলদ আছে সরকারি সেক্টরেও। পর্দা কেলেঙ্কারি, মেশিন কেলেঙ্কারির কথা এখনো ভুলেনি মানুষ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে, একটি দেশের জনসংখ্যার অনুপাতে যতজন ডাক্তার, নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, অ্যানেসথেটিস্ট থাকা আদর্শ তা বাংলাদেশে নেই৷ করোনার কারণে সেই সংকট প্রবলভাবে দেখা গেছে৷
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী বলছেন, একজন ডাক্তারের বিপরীতে নার্স থাকতে হয় তিনজন৷ কিন্তু বাংলাদেশে আছে আধাজন৷ এছাড়া স্বাস্থ্যসেবা দিতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাবতো আছেই৷
একটার পর একটা দুর্নীতি-অনিয়মের কেলেঙ্কারি ধরা পড়ছে বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতালগুলোতে। আর এসব ঘটনার সাথে যারা জড়িত তারা সবাই অপকর্ম করছে রাজনৈতিক পরিচয়ে। দলগুলো তাদের পরিচয় অস্বীকার করলেও দায় কি এড়াতে পারে? আমি আগেই বলেছি চিকিৎসা নিয়ে বাণিজ্য কখনোই কাম্য নয়। আমি মনে করি চিকিৎসা নিয়ে বাণিজ্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার সামিল। কারণ চিকিৎসার অধিকার একজন নাগরিকের মৌলিক অধিকার। তাছাড়া অন্যান্য মৌলিক অধিকার খর্ব হলে মানুষ বাঁচতে পারে মানবেতরভাবে কিন্তু চিকিৎসা খাতে বাণিজ্য হলে মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ে।
ইতিমধ্যে বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে পদত্যাগ করার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উঠেছে। স্বাস্থ্যখাতে প্রকৃতপক্ষেই ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি চোখে পড়ছে। হয়ত করোনায় সেগুলো প্রকাশ করতে সহায়তা করছে। আমার কাছে মনে হয় খারাপ কাজে জয়ী হওয়ার চেয়ে ভালো কাজে পরাজয়ও ভালো। এখন যদি স্বাস্থ্যমন্ত্রী পদত্যাগ করেন তবে তিনি নিজের বিচক্ষণতার পরিচয় দিবেন। কারণ তার বিভাগের দূর্নীতি ও তার কথার গলদ সকলে জেনেছেন।
স্বাস্থ্য বিভাগের তিনটি বিষয়ে আমার মনে হয় কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। এক, কোনো প্রতিষ্ঠান সঠিক নিয়মে অনুমোদন নিচ্ছে বা নবায়ন করছে কিনা, দুই, কোনো প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনবিহীন টেস্ট করছে কিনা, তিন, কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান চিকিৎসকবিহীন চলছে কিনা।
প্রয়োজনে এই তিনটি কাজ তদারকির জন্য সারাদেশে আলাদা পরিষদ গঠন করতে পারেন। চিকিৎসার নামে বাণিজ্য বা অপচিকিৎসা কোনোটাই সভ্য রাষ্ট্রের জন্য কাম্য নয়। কাম্য নয় চিকিৎসা বিভাগের ধীরগতি।
এদিকে করোনা টেস্টের বিষয়ে যে বাধ্যবাধকতা দিয়েছে সরকার আমি তার সাথে দ্বিমত পোষণ করছি। কারণ জাতীয় সংকটময় সময়ে দেশে যেমন জরুরী অবস্থা জারী করা হয় আমার মতে সংকট সময়ে যে সেক্টরে সংকট ত্বরান্বিত হচ্ছে সেই সেক্টরকে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নেওয়া উচিত। অর্থ্যাৎ, আমি বলতে চাচ্ছি, বর্তমানে করোনা টেস্টের সংখ্যা বৃদ্ধি করা এবং ফি বাদ দিয়ে রাষ্ট্রমালিকানায় বিনামূল্যে করা উচিত। সংকট দ্রুততম সময়ে সমাধান করতে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় মালিকানায় সীমিত সময়ের মধ্যে করা উচিত। তবেই সংকট সহজে সমাধান হবে। সরকারের উপর দায়ভার কমবে।
একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমি স্বাস্থ্য বিভাগের উন্নতি কামনা করি। আমি দাবি করছি, অনিয়মের সাথে জড়িত থাকা সব চিকিৎসা কেন্দ্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকারের ভাবমূর্তি অক্ষুন্ন রাখতে স্বাস্থ্যখাতের সকল অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। কঠোর আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে স্বাস্থ্য সুরক্ষা।
স্বাস্থ্যখাতের কঠোর সর্তকতা বা নজরদারি ছাড়া সাহেদ বা সাবরিনার মতো আরও অনেক ধূর্ত ব্যক্তিরা এই সেক্টরকে ব্যবসায় পরিণত করবে। ক্ষুন্ন হবে সরকার তথা দেশের সুনাম। এখনই সময় স্বাস্থ্যখাতকে ঢেলে সাজানোর। সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিন। সর্তক থাকুন আর সর্তক রাখুন।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই