রিড বাই নবী হোসেন, আদর্শের বিদায় !
২২ জুলাই ২০২০ ২২:১৭
‘আই অ্যাম রিড বাই নবী হোসেন। মানে কী ? প্রশ্নটা স্বাভাবিক তাই না! ৭০ বছর বয়সেও অক্ষর জ্ঞানহীন নবী হোসেন ধারাবাহিকভাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের কমপক্ষে ৬০ থেকে ৭০ জন নেতার নাম বলতে পারতেন । শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগের কোনো সমালোচনা শুনতে পারতেন না একেবারেই ৷ এক রোখা স্বভাবের নবী হোসেনকে কেউ অর্থ সাহায্য করার কথা বলে যদি হাস্যরস করেও আওয়ামী লীগের সমালোচনা করতেন, তখন তিনি রাগে চলে যেতেন। আদর্শের বাইরের মানুষের সাহায্য তিনি নিতেন না।
কারণ কী ? কেউ জিজ্ঞেস করলে ক্ষেপে যেতেন। পুরো জীবন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ বলে কাটিয়ে দেওয়া এক পাগল ছিলেন নবী হোসেন। বাড়ি ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার পাইথল ইউনিয়নের দেওলপাড়া গ্রামে। একটি ভাঙা ঘরে মাটি দিয়ে বানানো চৌকিতে থাকতেন। কিছুই ছিল না নবী হোসেনের। মৃত্যুর আগে পাড়ার ছেলেরা তাকে দেখতে গেলে বলতেন, আমার একটা নতুন ঘর হবে ? একটা সোলার বাতি পাবো ? না কিছুই পাননি । গত ২৯ জুন পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন নবী হোসেন ।
ভূমিহীন, ভিক্ষুক ও অসহায়দের জন্য বসত ঘর নির্মাণ প্রকল্পের একটিতেও তার নাম সুবিধাভোগীদের তালিকায় ছিল না । অবশ্য আশপাশে বিদ্যুতের আলো পৌঁছে গেছে অনেক আগেই। পাশের বাড়িরও মানুষজনও বিদ্যুৎ আলোর সুবিধা ভোগ করছেন। কিন্তু নবী হোসেন থাকতেন অন্ধকারে। মাঝে মধ্যে মোমবাতির আলোয়। নতুবা অন্ধকারে। তবুও নবী হোসেন এ পাড়া থেকে ওই পাড়ায় বলে বেড়াতেন, ‘ দেখেন আপনারা শেখের বেটি ( শেখ হাসিনা ) আপনাদের আলো জ্বালিয়ে দিয়েছেন। সড়ক পাকা করে দিচ্ছেন। কত উন্নয়ন করছে আওয়ামী লীগ সরকার। এরকম ইতিবাচক কথা নবী হোসেনের মুখে মুখে থাকতো।
খুব সাধারণ ও জীবনযাপন ছিলো সাদামাটা । অনেকেই তাকে ‘পাগল’ বলতো। একটি ব্যাগ হাতে ময়লা পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি পরে হেঁটে বেড়াতেন এ গ্রাম থেকে ও গ্রাম। বিভিন্ন হাঁটবাজারে দাঁড়িয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ দিতেন। ভরাট গলার এ ভাষণ শুনতে মানুষ জড়ো হতেন। ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নিগুয়ারির কুরচাই গ্রামে বিএনপির সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হয়েছিলেন পাইথল ইউনিয়নের যুবলীগ কর্মী মঞ্জু। এই হত্যার প্রতিবাদে সোচ্চার হতে দেখেছিলাম এই নৌকা পাগল নবী হোসেনকে। দেখেছিলাম, উপজেলা সদরে কাঁধে একটি ব্যাগ নিয়ে নিজ হাতে কাঠের ছোট নৌকা বানিয়ে, লাল রং করে সাজিয়ে মিছিলের অগ্রভাগে থাকতেন তিনি। একটা সময় মাঝে মধ্যে গয়েশপুর বাজার বা কাওরাইদ রেলওয়ে স্টেশনে গেলেই এই নবী হোসেনের ভরাট কণ্ঠে শুনতে পেতাম জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান।
নবী হোসেনের চিন্তা ও চেতনায় এতোটাই বঙ্গবন্ধু জুড়ে ছিলেন যে আওয়ামী লীগের কোনো জনসভার খবর পেলেই থাকতো তার উপস্থিতি । নব্বইয়ের সেই উত্তাল সময়ে সবাই যখন রাতে বিবিসি খবর শুনতেন, তখন নবী হোসেনও সেই জমায়েতে থাকতেন । আওয়ামী লীগের কথা বলার আগেই নবী হোসেন বলতেন ‘আই আ্যম রিড বাই নবী হোসেন’। দেওলপাড়া গ্রাম, পাইথল ইউনিয়ন, উপজেলার অনেক মানুষজন নবীকে চিনে ‘ রিড বাই নবী হোসেন’ নামে। গয়েশপুর বাজার থেকে দেওলপাড়া গ্রাম প্রায় তিন কিলোমিটার পথ। অন্ধকার রাতেও কোন টর্চ লাইট ছাড়া নবী হোসেন জয় বাংলা বলে বলে তার শীর্ণ মাটির ঘরে পৌঁছতেন। ২০০১ সালে যখন বিএনপি জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায়, সেই সময়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীরা যখন বাড়ি ছাড়া তখন বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ অন্তপ্রাণ ‘পাগল’ এই মানুষটি এলাকায় ঘুরে ঘুরে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতেন। স্থানীয় বিএনপি জামায়াত সমর্থিত লোকের হাতে তাকে মার খেতে হয়েছিল অসংখ্যবার। অপরাধ শুধু একটাই, নবী হোসেন নৌকা পাগল। এত অত্যাচার, নিপীড়নের পরও জয় বাংলা ও জয় বঙ্গবন্ধু বলে গিয়েছেন প্রত্যন্ত পল্লীর শীর্ণ মাটির ঘরে থাকা এ মানুষটি।
সাংসারিক জীবন ছিলো না তার। মাঝ বয়সে একটা সময় বিয়ে করলেও সে সংসার তার টিকেনি। এরপর আর বিয়ে করেননি। থাকার মধ্যে আছেন একমাত্র সৎ বোন । শেষ বয়সে এই সৎ বোন পাশে ছিলেন। বলতে গেলে দীর্ঘ সময়টা একার জীবন। মানুষের দেওয়া খাবার খেতেন তিনি। কিন্তু সবার দেওয়া খাবার তিনি গ্রহণ করতেন না।
সারাজীবন আওয়ামী লীগ করে যাওয়া নৌকা ভক্ত নবী হোসেন তেমন সুযোগ সুবিধা পাননি কখনো। সম্বল বলতে একটি বয়স্ক ভাতার কার্ড। একটি বসত ঘর বা একটি সোলার তার খুব আশা ছিলো। হতে পারে নির্লোভ এই মানুষটি তার প্রত্যাশার কথা বলেননি কারও কাছে। তবে মারা যাওয়ার আগে দেখতে যাওয়া পাড়ার কয়েকজন তরুণের কাছে নবী হোসেন বলতেন, আমি একটি নতুন ঘর পাবো ।
বিশ্ব মহামারি করোনার সময় তিনি সত্যি সত্যি ভীষণ দুর্দশায় পড়ে গিয়েছিলেন। রমজান মাসে পড়ে গিয়ে কোমর ও পায়ে ব্যথা পান। এরপর তিনি আর ঘর থেকে বের হতে পারেননি। একটা সময় খাবার জোগাড় করাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় তার জন্য। তবে স্থানীয় কয়েকজন তরুণ নবী হোসেনের জন্য ফলমূল ও একজন পল্লী চিকিৎসক নিয়ে গিয়েছিলেন। হতে পারে মানবিক সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিলেন কেউ কেউ। দেউলপাড়া গ্রামের প্রতিবেশীদের কাছ থেকে যতটুকু জানা, নবী হোসেন মারা যাওয়ার আগে তার জীবনটা অনেক কষ্টেই কেটেছে। সোলারের বাতির আলোর নিচে ঘুমাতে পারেন নি । ছিলো না একটি কাঠের চৌকি। একটি বসত ঘর পাওয়ার আশা । তারপরও ইতিবাচক মন্তব্য ছিলো তার। বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেন কত কিছু। অনেক ইতিবাচক ঘটনা ভাইরাল হয়। একটা সময় এই প্রত্যন্ত পল্লীর নির্লোভ সহজ সরল বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ ভক্ত নবী হোসেনরা কতটা লড়াই করেছেন তা সংকলন লিখেও শেষ করা যাবে না।
আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু অন্তপ্রাণ নৌকা ভক্ত এই মানুষটি ২৯ জুন সকালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার বিদায়ের মধ্য দিয়ে একটা আদর্শের মৃত্যু হলো ! স্যালুট জানাই, আদর্শের প্রতীক ‘ আই আ্যম রিড বাই নবী হোসেনকে ।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা