দুর্নীতিতে নিমজ্জিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে
২৫ জুলাই ২০২০ ১৮:৫৮
জহিরুল ইসলাম
দেশবাসীর পাঁচটি মৌলিক অধিকারের মধ্যে এ মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে চিকিৎসা বা স্বাস্থ্যসেবা। কিন্তু সীমাহীন দুর্নীতির কারণে বর্তমানে এ খাতটি ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। সম্পূর্ণরূপে ঢেলে সাজানো ছাড়া জোড়াতালি দিয়ে এ খাতকে কার্যকর রাখা আর সম্ভব বলে মনে হচ্ছে না।
এর আগে বালিশকাণ্ডের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসার পর করোনা দুর্যোগের মধ্যেই এ খাতে নতুন করে আলোচনায় আসে গ্লাভস, পিপিই এবং এন-৯৫ মাস্ককাণ্ড। সরকার যখন করোনা দুর্যোগের কারণে বেসামালপ্রায় ঠিক তখনই কিছু দুর্নীতবাজ অনৈতিক কাজের মাধ্যমে মেতে ওঠে নিজেদের আখের গোছাতে। গত মার্চ মাসেই কেন্দ্রীয় ঔষধাগার থেকে নিম্নমানের মাস্ক এবং পিপিই দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করে মুগদা মেডিক্যাল কলেজ। এ নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি গঠন করে। সর্বশেষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের করোনা ইউনিটে নকল এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহের অভিযোগে আওয়ামী লীগের সাবেক নেত্রী শারমিন জাহানকে তিন দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন আদালত। এর আগে স্বাস্থ্য অধিদফতর করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ল্যাবরেটরি যন্ত্রপাতি, পিপিই, টেস্টিং কিট, ওষুধপত্র ইত্যাদি চিকিৎসাসামগ্রী কেনাকাটায় অন্তত ২২ কোটি টাকার সঠিক হিসাব দিতে পারেনি বলে সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয়। এসব দুর্নীতির খবর প্রকাশ পেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাউকে ছাড় না দেওয়ার নির্দেশ দেন। এরপরই সম্ভবত নড়েচড়ে বসে সশ্লিষ্টরা। বিভিন্ন হাসপাতালে শুরু হয় অভিযান। গ্রেফতার করা হয় এ খাতের মহা মহা দুর্নীতিবাজকে।
করোনা সংকটের শুরুতেই বিনামূল্যে নমুনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করে সরকার। এই কাজে সহযোগিতা করার জন্য ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠান জেকেজি হেলথকেয়ারকে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। কিন্তু কিছুদিন পর দেখা যায়, নমুনা পরীক্ষা না করেই রিপোর্ট দিত জেকেজি। একই অভিযোগে অভিযুক্ত হয় সরকারের তরফ থেকে স্বীকৃত করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল রিজেন্ট। করোনার নমুনা সংগ্রহ করে ভুয়া রিপোর্ট প্রদান করত এ দুটি প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়াও সরকার থেকে বিনামূল্যে কোভিড-১৯ টেস্ট করার অনুমতি নিয়ে রিপোর্টপ্রতি বড় অঙ্কের টাকা আদায় করত তারা।
অভিযোগ রয়েছে, বিগত কয়েক বছরে স্বাস্থ্য খাতে মন্ত্রণালয় কিংবা অধিদফতরে যারা প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের অদূরদর্শিতা, অক্ষমতা কিংবা দুর্নীতিতে ডুবেছে স্বাস্থ্য খাত। বিগত কয়েক বছর শুধু কেনাকাটাই যেন ছিল মন্ত্রণালয়ের প্রধান কাজ। অনেক ক্ষেত্রে নাকি কেনাকাটার চাহিদা হাসপাতাল কিংবা সংশ্লিষ্ট বিভাগের চিকিৎসক নয়, ঠিক করে দিত মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিদের পছন্দের ঠিকাদাররা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এই কেনাকাটা নির্দিষ্ট ঠিকাদারদের না দিলে অনেক হাসপাতালের ব্যবস্থাপক ওএসডি কিংবা বদলি হয়েছেন বলে জানা গেছে।
করোনা সংকটের সময় উল্লেখযোগ্য আরেকটি দুর্নীতির অভিযোগ হলো আরটি পিসিআর মেশিন কেলেঙ্কারি। প্রথমে মাত্র একটি মেশিন দিয়ে নমুনা পরীক্ষার কাজ শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী সব জেলায় করোনার নমুনা পরীক্ষার নির্দেশ দিলে স্বাস্থ্য অধিদফতর ২০০৯ মডেলের মেশিন ক্রয় করে। এই মেশিনগুলো কম কার্যকর, কম নমুনা পরীক্ষা করতে পারে এবং এগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিটের সংকটও দেখা দেয়। এসব মেশিন ক্রয়ের পেছনে অসৎ উদ্দেশ্য কাজ করেছে বলে সন্দেহ হওয়া অমূলক নয়।
সাম্প্রতিক ব্যাপকভাবে আলোচিত উপরের কয়েকটি ঘটনা ছাড়াও ইদানীং হেন দুর্নীতি বা অনিয়ম নেই যা স্বাস্থ্য খাতে হচ্ছে না। সর্বশেষ নেগেটিভ রোগীকে করোনা পজিটিভ বলে হাসপাতালে ভর্তি রেখে বাণিজ্যের অভিযোগ পাওয়া যায় রাজধানীর সাহাবুদ্দিন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বিরুদ্ধে। এ ছাড়াও হাসপাতালটিতে অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন ধরনের অসঙ্গতি পায় র্যাব। এর মধ্যে অন্যতম হলো সরকারের অনুমতি ছাড়াই গোপনে করোনাভাইরাস পরীক্ষা। তাও আবার অননুমোদিত র্যাপিড কিট দিয়ে পরীক্ষা চলছিল। এই পরীক্ষার নামে রোগীদের কাছ থেকে বড় অঙ্কের টাকা করে নিত তারা। হাসপাতালটির অপারেশন থিয়েটার থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ সার্জিক্যাল সামগ্রীও উদ্ধার করা হয়।
ইদানীং স্বাস্থ্য খাতে অনিয়মের আরেকটি দিক হচ্ছে সারা দেশে ভুয়া ডাক্তারের সংখ্যা বৃদ্ধি। কিছুদিন আগে দেশের প্রত্যন্ত একটি এলাকায় এক মাছ ব্যবসায়ী তার ক্লিনিকে নিজে ডাক্তার সেজে প্রসূতি মায়ের অপারেশন করে। এ ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে র্যাবের একটি দল অভিযান চালিয়ে ক্লিনিকের মালিক ওই মাছ ব্যবসায়ীকে তিন মাসের কারাদণ্ড ও ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। এ ঘটনার সপ্তাহখানেক পরেই একই এলাকা থেকে পুলিশ আটক করে এক ভুয়া চক্ষু বিশেষজ্ঞকে।
খোদ রাজধানীর মতিঝিলে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে একজন ভুয়া ডাক্তার ১২ বছর ধরে চিকিৎসা দিয়ে আসছিল বলে জানা যায়। সে ইউনানির সাময়িক অনুমোদন নিয়েই দিয়ে আসছিল অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা। দেশে এমন ঘটনার নজিরও আছে যে বিএমএ’র আজীবন সদস্যও ভুয়া ডাক্তার বলে পরে প্রমাণিত হয়। ভুয়া চিকিৎসক আটকের ঘটনা মাত্র একটি দুটি না, সারা দেশে এবং প্রচুর সংখ্যায় ভুয়া ডাক্তার মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলায় মেতে রয়েছে। এসব ভুয়া ডাক্তার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পরই শধু সাধারণ মানুষ জানতে পারে তাদের আসল পরিচয়। কিন্তু তার আগে যতটা ক্ষতি সাধন তা করে ফেলে এসব তথাকথিত ডাক্তার।
এদিকে দেশের বেশিরভাগ হাসপাতালেরই লাইসেন্সই হালনাগাদ নেই বলেও জানাচ্ছে গণমাধ্যমগুলো। শুরুতে তারা যেসব ডাক্তার ও সুযোগ-সুবিধার কথা উল্লেখ করে লাইসেন্স গ্রহণ করে, কিছুদিন পর এসব ডাক্তার এবং সুযোগ-সুবিধার বেশিরভাগেরই কোনো অস্তিত্ব থাকে না। স্বাস্থ্য খাতের এসব কর্মকাণ্ড ঠিকঠাকমতো হচ্ছে কি না সেসব দেখার জন্য নিশ্চয় সরকারের বিভিন্ন বিভাগ রয়েছে। এতদিন তারা কী করেছে সে প্রশ্ন সবার। একই সঙ্গে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, দুর্নীতির যেসব ঘটনা প্রকাশ পাচ্ছে আর এসবের সঙ্গে যারা জড়িত তারা যথাযোগ্য শাস্তি পাবে কি না।
অনেকেই এ ব্যাপারে আশাবাদী হলেও চুন খেয়ে মুখ পোড়া কেউ কেউ বেশ সন্দিহান। তবে অনেকেই মনে করছেন, সাম্প্রতিক প্রধানমন্ত্রীর অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির কারণেই ইদানীং স্বাস্থ্য খাতের বড় বড় দুর্নীতির ঘটনা বেরিয়ে আসছে আর এ খাতের রাঘব-বোয়ালরা ধরা পড়ছে। জাতীয় সংসদে এক বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, দুর্নীতিবাজ যে-ই হোক ব্যবস্থা গ্রহণ অব্যাহত থাকবে। কে কোন দলের তা বড় কথা নয়, দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িতদের আমরা ধরে যাচ্ছি। বক্তৃতায় কঠোরহস্তে অনিয়ম-দুর্নীতি দমনে জোর দেন তিনি। তার নির্দেশেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে আগে থেকেই চলে আসা অভিযান নতুন মাত্রা পায়। ভুয়া রিপোর্ট দেওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে রিজেন্ট হাসপাতাল সিলগালা করে দেওয়া হয়, গ্রেফতার হয় এর মালিক মোহাম্মদ সাহেদ। রিপোর্ট জালিয়াতির অভিযোগে জেকেজি হেলথকেয়ারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফ চৌধুরী এবং চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা চৌধুরী গ্রেফতার হয়। দলীয় পরিচিতি কিংবা এমপি-মন্ত্রীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা কোনো কিছুতেই শেষরক্ষা হয়নি প্রতারক সাহেদের। ভারতে পালিয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে র্যাবের হাতে ধরা পড়ে সে।
নানা অসাধু উপায়ে অবৈধভাবে অর্থবিত্তের মালিক হয়েছিল তার সহযোগী সাবরিনা এবং আরিফও। তাদেরও শেষরক্ষা হয়নি। করোনার পরীক্ষা নিয়ে প্রতারণা করার মামলায় গ্রেফতারকৃত সাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ তিনজনকে রিমান্ডে দেওয়া হয়েছে। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে নকল এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহের অভিযোগে আওয়ামী লীগের সাবেক নেত্রী শারমিন জাহানকে তিন দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন আদালত।
এদিকে করোনা পরীক্ষা, পিপিই ও কিট সরবরাহ নিয়ে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া স্বাস্থ্য খাতের কয়েকজন হর্তাকর্তার বিরুদ্ধেও নানা শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। করোনাকালে ত্রাণ তৎপরতায় যেসব জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে, তাদেরও তাৎক্ষণিক বরখাস্ত করে কঠোর বার্তা দিয়েছে সরকার। এদের মধ্যে অনেকে গ্রেফতারও হয়েছে। এসব জনপ্রতিনিধির বেশিরভাগই আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, সরকার দুর্নীতিবাজদের দলীয় পরিচয়কে গুরুত্ব দিচ্ছে না।
সর্বশেষ নানান সমালোচনার মুখে পদত্যাগ করেছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক। স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে নিয়েও সমালোচনা কম হয়নি। তবে দেশের মানুষ স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের পদত্যাগ বা সাহেদ-সাবরিনা-আরিফ-শারমিনের গ্রেফতারেই খুশি নয়। তারা চায় এদেরসহ এখনও যেসব ধুরন্ধর ধরাছোঁয়ার বাইরে আছে তাদের সবার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। সব দুর্নীতিবাজকে শাস্তির আওতায় এনে স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজানো ছাড়া এ খাতে সুনীতি ফেরানোর আর কোনো পথ সম্ভবত খোলা নেই।
লেখক : সাংবাদিক ও শিশুসাহিত্যিক
সারাবাংলা/এসবিডিই