Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের দুই বছর, এখনও বদলায়নি দৃশ্যপট


২৯ জুলাই ২০২০ ১৮:২৪

২০১৮ সালের ২৯ জুলাই রোববার দুপুর ১২টা। রাজধানীর শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের সামনে জাবালে নূর পরিবহনের দুটি বাস প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে কলেজের শিক্ষার্থীদের চাপা দেয়। বাস চাপা ঘটনায় সেখানেই প্রাণ হারান কলেজের দুই শিক্ষার্থী রাজীব ও দিয়া খানম মিম। দু’জনের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে সারাদেশে নিরাপদ সড়ক পরিবহন আইনের দাবিতে নজিরবিহীন আন্দোলন করে শিক্ষার্থীরা। সেই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর তড়িঘড়ি করে জাতীয় সংসদে পাস হয় সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮। এরপর ৮ অক্টোবর আইনটির গেজেট প্রকাশিত হয়। তার ঠিক ১১ মাস পর চলতি বছরের ২৩ অক্টোবর আইনের গেজেট প্রকাশ করা হয়।

বিজ্ঞাপন

২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের অন্যতম বড় ছাত্র আন্দোলন। ২৯ জুলাই সেই আন্দোলনের দুই বছর পূর্ণ হলো। আঠারোর সেই রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের পর আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের নিয়ে গড়ে ওঠে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন (নিসআ)। এটি একটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক নিরপেক্ষ ছাত্র সংগঠন।

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর চলতি বছরের পহেলা নভেম্বর কার্যকর করা হয় বহুল আলোচিত সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮। আইনটি জাতীয় সংসদে পাস হওয়ার পর পরিবহন মালিক শ্রমিকদের বাধার মুখে পড়ে। ফলে প্রায় ১৩ মাস পর তা কার্যকর করে সরকার। তবে বিধি প্রণয়ন না থাকা ও নানা অসঙ্গতি থাকায় সরকারকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে।

আমিও সেই আন্দোলনকারীদের একজন। আজ থেকে ঠিক দুই বছর আগে শহীদ রমিজ উদ্দীন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের সামনে এমইএস বাস স্টপে জাবালে নূর বাসের সেই প্রতিযোগিতায় প্রাণ যায় রাজীব ও দিয়া’র। আমার কলেজের ছোট ভাই-বোনের মৃত্যুর খবর শুনে আমার মন প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছিল। নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি তখন। ভাই-বোনের মৃত্যুর বিচারের দাবীতে আন্দোলনে সকলের সাথে শামিল হই।

দিয়া-রাজীব হত্যার ঘটনার বিচার চেয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা কয়েকটি দাবি জানিয়েছিল। সেসব দাবি একত্রিত করে ঘটনার পরের দিন ৩০শে জুলাই জাতির উদ্দেশ্যে গণমাধ্যমের সামনে ঐতিহাসিক ৯ দফা দাবি জানিয়েছিলাম। তারপর থেকেই সারাদেশে সকল শিক্ষার্থীরা মাঠে নেমে গিয়েছিল ভাই-বোন হত্যার বিচারের দাবীতে। আমাদের ৯ দফা ছিল সর্বজনগ্রাহ্য। প্রধানমন্ত্রীসহ সকল রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ আমাদের ৯ দফা দাবির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছিলেন। আমাদের দাবির মূল বিষয় ছিল একটাই- সড়কের নিরাপত্তা। সড়ক কীভাবে নিরাপদ রাখা যায়, কীভাবে সড়কে প্রাণহানি কমানো যায় সেসব নিয়েই ছিল আমাদের দাবি দাওয়া।

বিজ্ঞাপন

আজ আন্দোলনের দুই বছর পর সড়কের পরিবেশ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে মনে হচ্ছে, আসলে শিক্ষার্থীরা যে নিরাপদ সড়কের জন্য লড়াই করেছিল, যে সড়কের বিশৃঙ্খলা কমানোর জন্য বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল, সে সড়ক আজও অরক্ষিতই রয়ে গেছে। সড়ক আন্দোলন চলাকালীন কোমলমতী শিক্ষার্থীদেরকে থামানোর জন্য এক শ্রেণীর সন্ত্রাসীরা বর্বরোচিত হামলা চালিয়েছিল। সেই হামলায় আহত হয়েছিল অনেক ছাত্র-ছাত্রী। কেউ কেউ পঙ্গু হয়েছিল। সেই সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করে গণমাধ্যমে বিভিন্ন সংবাদ প্রকাশিত হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনোরকম আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়নি এখনো। অথচ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদেরকে বিনা অপরাধে মামলার পর মামলা দিয়ে তাদের জীবন বিষিয়ে তোলা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন সেসব মামলা আজও চলছে। এর শেষ কোথায়!

সড়কে যাদের প্রভাব সবচেয়ে বেশি তারা হলেন পরিবহন শ্রমিক। তারা চাইলেই সড়কে চলাচলকারী যাত্রীদের দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন। আবার তাদের অদক্ষতার কারণেই পিষে ফেলতে পারেন যাত্রীদের। আন্দোলনের সময় পরিবহন শ্রমিকদের লাইসেন্স চেক করার কারণে সারাদেশে যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল করে দিয়েছিলেন তারা। শুধু তাই নয়, তাদের অব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা বলার কারণে সাধারণ যাত্রী থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীদের মুখে আলকাতরা মাখিয়ে দিয়েছিলেন। সেসব ঘটনা ভোলার নয়।

সারাদেশে ৭০ লক্ষ পরিবহণ শ্রমিক ড্রাইভিং পেশার সাথে জড়িত। কিন্তু আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে চালকদের দক্ষ করে তোলার জন্য কোনো প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা হয়নি। তাদের তদারকি করার জন্য কোনো মহল থেকে উপর্যুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এ দায়ভার আসলে কাদের!

আপনারা অনেকেই জানেন, সম্প্রতি লকডাউনে সবচেয়ে বেশি কষ্টে ছিলেন পরিবহন শ্রমিকরা। সড়ক আন্দোলনকারীদের সমন্বিত প্ল্যাটফর্ম নিসআ এর পক্ষ থেকে নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের পাশে দাঁড়িয়েছি। সারাদেশে পরিবহন শ্রমিকদের দরজায় পৌঁছে দিয়েছি খাবারসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী। অথচ বছরের পর বছর তাদের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়া শ্রমিক নেতাদের দেখা মেলেনি সেই সময়ে। বরং শ্রমিকদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন তারা। পরের ঘটনা আরও অবাক হওয়ার মতো, পরিবহন লকডাউন শেষে যখন ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়টা এলো, তখন অজানা গর্ত থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এলো সেসব নেতা।

এক পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে, পরিবহন শ্রমিকদের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বছরে ২০০০ কোটি টাকা চাঁদা নেয় শ্রমিক নেতারা। চিন্তা করতে পারেন, অনানুষ্ঠানিক অ্যামাউন্ট তাহলে কত হতে পারে। শ্রমিকদের কষ্টের সময় তথাকথিত শ্রমিকনেতাদের নির্লিপ্ততা আমাদের অবাক করেছে। আমরা নিসআ এর পক্ষ থেকে আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী চেষ্টা করেছি সাহায্য করার। তবে প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই কম ছিল। আমরা চেষ্টা করেছি।

নিসআ’তে শিক্ষার্থীরা নিজেদের হাত খরচের টাকা জমিয়ে দেশের নিরাপদ সড়ক বিনির্মাণে কাজ করে যাচ্ছে। যাদের একমাত্র চাওয়া হচ্ছে সড়কের নিরাপত্তা। সড়কে বাসের রেষারেষি বন্ধ করতে মরিয়া হয়ে কাজ করে যাচ্ছে তারা। যদি কেউ তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, কী লাভে বা কিসের আশায় তারা এ কাজ করে যাচ্ছে? একটাই উত্তর পাবেন- সড়কের নিরাপত্তা। তাদের আর কোনো ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন যেন সড়কে যানবাহনের অসুস্থ প্রতিযোগিতার শিকার না হয়।

বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত যত বড় বড় সমস্যার সমাধান হয়েছে তা ছাত্রদের মাধ্যমেই হয়েছে। দেশের সড়কের নিরাপত্তা দেশের প্রতিটি নাগরিকের চাওয়া। সেই লক্ষ্যেই আমরা (নিসআ) কাজ করে যাচ্ছি। আমরা বিশ্বাস করি যদি সঠিকভাবে সড়কের আইন মেনে নিজেরা সচেতন হই, যানবাহনের চালক-হেলপার সচেতন হয় তাহলে একদিন ঠিকই আমাদের সড়ক নিরাপদ হবে।

পরিশেষে একটি কথা বলতে চাই, আমরা সড়কের জন্য আন্দোলন করলেও আমাদের প্রাপ্তির থেকে অপ্রাপ্তির পাল্লা বেশি ভারী। আসুন আমরা সবাই দেশের নিরাপদ সড়ক বিনির্মাণে কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে একসাথে কাজ করি। দেশের সড়ক নিরাপদ করে একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলি।

লেখক: ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকারী ও যুগ্ম আহ্বায়ক, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন (নিসআ)

দিয়া রাজীব সড়ক আন্দোলন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর