হতাশায় মোড়ানো আকাঙ্ক্ষার অনলাইন গণমাধ্যম নিবন্ধন
২ আগস্ট ২০২০ ১৫:০৪
সরকার দেশের চলমান অনলাইন গণমাধ্যমগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আনার চেষ্টা করছে। এরই ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার (৩০ জুলাই) রাতে ৩৪ টি নিবন্ধনযোগ্য অনলাইন পোর্টালের তালিকা প্রকাশ করেছে। তবে এসব তালিকায় রয়েছে বেশ কিছু অপরিচিত পোর্টাল। যাদের সংবাদের মান কিংবা জনবল কোনটাই নেই। অথচ নিবন্ধন পাচ্ছে। এমন অবস্থায় অনলাইন গণমাধ্যমে নিবন্ধন নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে।
অথচ বর্তমান যুগ ইন্টারনেট তথা প্রযুক্তিনির্ভর যুগ। প্রতিদিন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অভাবনীয় সব উদ্ভাবন বিশ্বকে বদলে দিচ্ছে; বদলে দিচ্ছে আমাদের জীবনযাপনের ধরণ। একই সঙ্গে বদলে দিচ্ছে গণমাধ্যমের ধরণও। আর গণমাধ্যমের সাথে গণ-মানুষের সম্পর্ক ও যোগাযোগের ধরণ বদলে দিচ্ছে অনলাইন গণমাধ্যম। এজন্যই বর্তমানে দেশের সকল প্রথম সারির দৈনিক ছাপা সংস্করণের পাশাপাশি অনলাইনেও সচল রয়েছে। আছে শুধু অনলাইন ভিত্তিক গণমাধ্যমও।
২০০৬ সালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের মাধ্যমে অনলাইন গণমাধ্যমের যুগে প্রবেশ করে বাংলাদেশ। এরপর সময়ের সাথে সাথে বেড়েছে অনলাইন গণমাধ্যমের সংখ্যা। সবশেষ তিন-চার বছরে অনলাইন গণমাধ্যমের সংখ্যা এতটাই বেড়েছে যে- এখন ‘পকেটে পকেটে’ অনলাইন পত্রিকা, টেলিভিশন, রেডিও রয়েছে। ঠিক ব্যাঙের ছাতার মতো যেখানে-সেখানে গড়ে উঠেছে নামে-বেনামে একাধিক অনলাইন সংবাদ পোর্টাল। আর পাড়া-মহল্লা কিংবা শহরের অলি-গলিতে রয়েছে সম্পাদক-প্রকাশক।
এমন অবস্থায় সরকার দেশের সকল অনলাইনের জন্য ‘জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম ২০১৭’ নামে একটি নীতিমালা করে। ২০১৭ সালের ৫ জুলাই প্রকাশিত এ গেজেটের ‘অনলাইন গণমাধ্যম’ এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে- বাংলাদেশের ভূখণ্ড হতে হোস্টিংকৃত বাংলা, ইংরেজি বা অন্য কোন ভাষায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইন্টারনেটভিত্তিক রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্র বা ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে সম্প্রচারের উদ্দেশ্য ব্যবহৃত স্থির ও চলমান চিত্র, ধ্বনি ও লেখা বা মাল্টিমিডিয়ার অন্য কোনো রূপে উপস্থাপিত তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ বা সম্প্রচারকারী বাংলাদেশি বা বাংলাদেশে নিবন্ধিত সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান বুঝাবে।
নীতিমালায় অনলাইন গণমাধ্যম নিবন্ধন সংক্রান্ত বিষয়ে বলা হয়েছে, সব অনলাইন গণমাধ্যমকে নিবন্ধিত হতে হবে। বিদ্যমান অনলাইন গণমাধ্যমগুলো শর্ত পূরণ করে নিবন্ধিত হবে। আর নিবন্ধন পাওয়ার জন্য থাকতে হবে চারটি যোগ্যতা। এগুলো হলো- বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন, অফিসসহ চাহিদা মাফিক জনবল, নিয়মিত বেতনভাতা পরিশোধ, আবেদনকারীর কর শনাক্ত নম্বর টিআইএন।
এর আগে ২০১৫ সালের ৯ নভেম্বর এক তথ্য বিবরণীতে তথ্য অধিদফতর জানায়, সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত ও অপসাংবাদিকতা রোধে অনলাইন পত্রিকাগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আনা হবে। এ জন্য নির্ধারিত নিবন্ধন ফরম ও প্রত্যয়নপত্র বা হলফনামা পূরণ করে তথ্য অধিদফতরে জমা দিতে হবে। দেশের চলমান সব অনলাইন নিউজ পোর্টালকে ওই বছরের ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে আবেদন করতে বলা হয়েছিল। এরপর সময় কয়েক দফা বাড়ানো হয়। সবশেষ ২০১৯ সালের ১৬ জুলাই পর্যন্ত সময় দেয়া হয়েছিল। এসময়ের মধ্যে নিবন্ধন পেতে প্রায় ৮ হাজার আবেদন জমা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৫ সালে ছিল ৩ হাজার, আর ২০১৯ সালে জমা পড়েছে ৫ হাজার।
আবেদনকৃত গণমাধ্যম নিবন্ধন দিতে তিনটি গোয়েন্দা সংস্থা তদন্ত করেছে। তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার (৩০ জুলাই) তথ্য মন্ত্রণালয় নিবন্ধনযোগ্য ৩৪ টি অনলাইন গণমাধ্যমের তালিকা প্রকাশ করে। আগামী ২০ কার্যদিবসের মধ্যে নির্বাচিত এই নিউজ পোর্টালগুলোকে নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে নিবন্ধন সম্পন্ন করতে হবে জানানো হয়।
তবে তালিকায় থাকা ৩৪ টি গণমাধ্যমের মধ্যে নেই দেশের প্রথম অনলাইন গণমাধ্যম বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম। এছাড়াও নেই বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, আমাদেরসময় ডটকম, সারাবাংলা ডট নেট, পূর্বপশ্চিম বিডি, ঢাকা টাইমস টোয়েন্টিফোর, ডেইলি বাংলাদেশ, পরিবর্তন, বাংলা, বার্তা টোয়েন্টিফোর ডটকম, বাংলা ইনসাইডার, অধিকারসহ বেশকিছু পাঠক প্রিয় অনলাইন পত্রিকা।
তবে এসব তালিকায় না থাকা মানে যে বাদ পড়ে গেছে এমনটি নয়। কারণ, এ তালিকা প্রকাশের আগেই তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, ‘আমাদের ওয়েবসাইটে যে তালিকা আপলোড হবে, সেখানে অনেক প্রতিষ্ঠিত অনলাইনের নাম হয়তো দেখা যাবে না। তার কারণ এটি নয় যে তাদের ব্যাপারে রিপোর্ট নেগেটিভ। আসলে তাদের ব্যাপারে এখনও প্রতিবেদন না পৌঁছানোই এর কারণ। পরবর্তীতে অন্যান্য অনলাইন নিউজ-পোর্টালের ব্যাপারে অনাপত্তি প্রতিবেদন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলোকে নিবন্ধনের অনুমতি দেওয়া হবে।’
কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের প্রথম সারির অনলাইন গণমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদন দেরিতে আসার কারণ কী? এছাড়া তালিকায় এমন কিছু অনলাইন পত্রিকার নাম আছে যা কখনও দেখিনি। কিংবা গত অর্ধযুগ ধরে গণমাধ্যমে কাজ করার সুবাদে একদিনের জন্য হলেও নিবন্ধনযোগ্য পোর্টালগুলোর নাম শুনিনি। অথচ একজন সংবাদকর্মী হিসেবে ভালো পত্রিকাগুলোর নাম আমাদের জানা থাকার কথা। অন্তত একজন সাধারণ পাঠকের চাইতে গনমাধ্যমকর্মীদের ধারণা পাওয়ার কথা কিংবা থাকার কথা। কিন্তু যেসব অনলাইন নিবন্ধনযোগ্য তালিকায় স্থান পেয়েছে এসব নিউজ পোর্টাল সম্পর্কে আমাদের অনেকের ধারণাই নেই।
এছাড়া প্রকাশিত ৩৪ টি পোর্টালের মধ্যে বেশিরভাগ অনলাইন পোর্টালের নিউজের মান খুবই খারাপ। কোনো কোনো পোর্টালের প্রতিনিধি নেই বিভাগীয় শহরগুলোতেও। অথচ এরা নিবন্ধন পেয়েছে। সরকার তাদের স্বীকৃতি দিয়েছে। এমন অবস্থায় যদি আরও নিবন্ধন হয় তাহলে শৃঙ্খলার আশা জলে যাবে। তৈরি হবে বিশৃঙ্খলার জঞ্জাল। এ জঞ্জাল সহজে ভেঙে ফেলা যাবে না। এজন্য শুরুতেই ভালো মানের ও দায়িত্বশীল গণমাধ্যমগুলো নিবন্ধন দিতে হবে। এতে অনলাইন নীতিমালা কিংবা ভুঁইফোড়দের রোধকরা যাবে।
লেখক- সংবাদকর্মী ও শিক্ষানবিশ আইনজীবী, সিলেট জজ কোর্ট
ইমেইল : [email protected]