ছয় বছরেও ভুলতে পারিনি পিনাক-৬
৪ আগস্ট ২০২০ ২০:২৯
আগস্টের ৪ তারিখ ভুলে যাওয়ার মতো কোন দিন না। প্রতি বছর দিনটি এলেই মনে পড়ে যায় পিনাক-৬ লঞ্চডুবির সেই ঘটনা। সেই ঘটনার ৬ বছর হতে চললো। মাদারিপুরের কাওড়াকান্দি ঘাট থেকে তিন শতাধিক যাত্রী নিয়ে পিনাক-৬ সেদিন রওনা করেছিলো মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার উদ্দেশ্যে। ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বহণকারী পিনাক-৬ সেদিন প্রবল স্রোতের কবলে পড়ে যায় পদ্মার বুকে, মাওয়া ঘাটের কাছে এসে ডুবে যায়।
তখন আমি দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। সকাল সাড়ে ১১টার দিকে দুর্ঘটনার কথা জানতে পেরে সারাটা দিন কেমন উৎকণ্ঠায় কাটিয়েছিলাম। টিভির সামনে বসে উদ্ধারাভিযান দেখেছিলাম, ক্ষণে ক্ষণে মৃত্যুর মিছিলে যোগ হওয়া নতুনদের হিসেব গুণছিলাম, টিভির পর্দায় স্বজন হারানো পরিবারের আর্তনাদ, লঞ্চে উঠেই নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের ভাগ্নীদের আপলোড করা সর্বশেষ সেলফি, এসব দেখে…সব মিলিয়ে প্রচন্ড অগোছালো একটা দিন কাটিয়েছিলাম সেদিন।
আমার এখনও মনে পড়ে, শুধু সেদিন কেন? টানা ৭ দিন একই উৎকন্ঠায় পার করেছে এ অঞ্চলের মানুষজন। কারণ, উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম, সন্ধানী এবং দুরন্ত ছাড়াও বিআইডব্লিউটিএ (বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ), সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, র্যাব, কোস্টগার্ড ও ফায়ার সার্ভিস, সবাই মিলেও সেদিন পিনাক-৬ লঞ্চের কোনো হদিস পায়নি! পরবর্তীতে উদ্ধারকাজে অগ্রগতি না থাকায় অষ্টম দিনে উদ্ধারকাজ স্থগিত করা হয়েছিল।
বাংলাদেশে নদী পথের দুর্ঘটনাগুলো যতটা না প্রাকৃতিক, তার চেয়ে বেশি অবহেলাজনিত বলেই আমার ধারণা। পিনাক-৬ লঞ্চটি ডুবে যাওয়ার কারণ যে শুধুমাত্র খরস্রোতা পদ্মার উত্তাল ঢেউ, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। বাংলাদেশে স্থল ও জলপথে চলাচল করা যানবাহনগুলোর মধ্যে অতিরিক্ত যাত্রী বহণের প্রবণতা নতুন কোন ঘটনা নয়। তবে পিনাক-৬ যেন আগের সব বেপরোয়া পরিবহনকেও হার মানিয়েছিল!
২০১৪ সালের আগস্টের শুরু থেকেই পদ্মা ছিল উত্তাল, ঘোষণা করা হয়েছিলো ২ নম্বর সতর্ক সংকেতও। নিয়মানুযায়ী, এমতাবস্থায় ৬৫ ফুটের কম দৈর্ঘ্যের লঞ্চ চলাচল করা নিষিদ্ধ থাকলেও, সমস্ত বিধি-নিষেধ অমান্য করে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত ৪ থেকে ৫ গুণ যাত্রী নিয়ে রওনা করে ৫২ ফুট (সাড়ে ১৯ মিটার) দৈর্ঘ্যের পিনাক-৬। পরিনতি? উদ্ধার হয় ৪৯ জনের লাশ, বেওয়ারিশ হিসেবে শিবচরে দাফন করা হয় ২১ জনের মৃতদেহ। এছাড়াও সরকারি হিসেবেই নিখোঁজ থাকে ৬১ যাত্রী। সেদিন হত, আহত ও নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের গগণবিদারী চিৎকারে ভারি হয়ে ওঠে পদ্মার পার। সেটা যেন হয়ে উঠেছিল এক মৃত্যুপুরী!
পত্রিকা পড়ে জেনেছিলাম, দুর্ঘটনার পরের দিন অর্থাৎ ৫ আগস্ট রাতে অধিক মুনাফার আশায় ক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করে বেপরোয়া লঞ্চ চালিয়ে অবহেলাজনিত নরহত্যার অপরাধে ছয়জনকে আসামী করে লৌহজং থানায় মামলা দায়ের করে বিআইডব্লিউটিএ। মেরিন কোর্টে মামলা দায়ের করেছিল সমুদ্র অধিদপ্তর। লঞ্চের মালিক আবু বকর সিদ্দিকী গ্রেফতার হওয়ার পরে যথারীতি শুরু হয় ‘ব্লেইম গেইম’।
লঞ্চের মালিক বিআইডব্লিউটিএ’কে দোষারোপ করে বলেছিলেন, ‘ঈদের ১০ দিন আগে ও পরে লঞ্চ বিআইডব্লিউটিএ’র নিয়ন্ত্রনাধীনে থাকে, সুতরাং কর্তৃপক্ষ দায়ী।’ অন্যদিকে র্যাবের তৎপরতায় জানা গিয়েছিল, ‘১৯৯১ সালে তৈরি হওয়া পিনাক-৬ লঞ্চে ছিল না যাত্রীদের আত্মরক্ষার জন্য কোন সেফটি ইকুইপমেন্ট, এমনকি চালকের লাইসেন্স পর্যন্ত ছিল না।’
ব্লেইম গেইমের গুঁটি বিআইডব্লিউটিএ, সমুদ্র অধিদপ্তর, লঞ্চের মালিক, ঘাটের ইজারাদার হয়ে ঘুরতে ঘুরতে সবশেষে মামলাটিই দাফন হয়ে যায়। অথচ দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে তড়িঘড়ি করে দুটি কমিটিও গঠন করা হয়েছিল তখন; নৌ-মন্ত্রনালয় কর্তৃক ৭ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি, নৌ–বিভাগ কর্তৃক ৪ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি। উল্লেখ্য যে, কোন কমিটিতেই মেরিন টেকনিক্যাল বিশেষজ্ঞদের তেমন উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়নি।
প্রায় ছয় বছর আগের এই বিষাদময় স্মৃতিচারণ কেন করলাম আসা যাক সেই প্রেক্ষাপটে। চলতি বছর জুনের ২৯ তারিখ সকালে বহুদিন পর হঠাৎ চট্টগ্রাম থেকে এক আত্মীয়ের টেলিফোন পেলাম। উৎকন্ঠার সাথে জানতে চাইলেন বাসার সবাই নিরাপদ আছি কি না। ঘটনা জিজ্ঞাসায় জানতে পারলাম, সকালে মর্নিং বার্ড নামের একটা ছোট লঞ্চ ৬০/৭০ জন যাত্রী নিয়ে ডুবে গেছে। লঞ্চে থাকা যাত্রীদের অধিকাংশই মুন্সিগঞ্জের বাসিন্দা। ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ে টেলিভিশন চালু করে দেখি ট্রলারভর্তি করে লঞ্চডুবিতে উদ্ধারকরা ৩২ জনের লাশের ছবি। ময়ূর-২ এর ধাক্কায় ঘটা এই দুর্ঘটনা ইচ্ছাকৃত হত্যাকাণ্ড কি-না সে প্রসঙ্গে যাব না। তবে সেদিনও সারাদিন উদ্ধারকার্যের খবর রাখলাম। মৃতের আত্মীয়দের আহাজারি দেখলাম, নিখোঁজ স্বজনের প্রতীক্ষায় কাতর প্রাণগুলো, যারা অন্তত লাশ হলেও শেষবারের মতো প্রিয়জনকে দেখার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে! কি নির্মম!
গত ছয় বছরেও মুন্সিগঞ্জবাসী পিনাক-৬ দুর্ঘটনার কথা ভুলতে পারেনি, এর উপর আবার মর্নিং বার্ড ট্রাজেডি- এ যেনো মড়ার উপর খাড়ার ঘাঁ!
মাত্র ছয় বছরের ব্যবধানে দুটো লঞ্চ দুর্ঘটনায় কি কি অমিল আছে না জানলেও বেশ কিছু মিল লক্ষ্য করেছি। চালকের অবহেলা, জাহাজ মালিকের উদাসিনতা ও অজ্ঞতা, নির্মাণ ত্রুটি, উভয় ঘটনায় লঞ্চগুলোতে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বহন, লঞ্চের ফিটনেস না থাকা, এবং নামমাত্র জালিয়াতি সার্টিফিকেটধারী, লঞ্চডুবির পরে উভয় ঘটনায় উদ্ধার তৎপরতায় দীর্ঘসূত্রিতা, আধুনিক প্রযুক্তি ও দক্ষতার অভাব, তড়িঘড়ি করে দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি গঠন এবং সেই কমিটিতে টেকনিক্যাল বিশেষজ্ঞদের দৃশ্যমান অনুপস্থিতি, বিআইডব্লিউটিএ-নৌ বিভাগ-লঞ্চ মালিক-ইজারাদারকে ঘিরে চলমান ব্লেইম গেইম, নিহতের স্বজনদের আর্থিক সাহায্য প্রদানের নামে প্রহসন আর নিখোঁজ স্বজনের প্রতীক্ষা। এগুলোই সাদৃশ্য!
আরো বিস্মিত হয়েছি, যখন শুনলাম মর্নিং বার্ডের উদ্ধার কাজে আসতে চাওয়া জাহাজ পোস্তগোলা ব্রিজের সাথে আটকে যাওয়ায় (উচ্চতার কারণে) ঘটনাস্থলে আসতে পারেনি। ভাবলাম কতো পরিকল্পনা করেই না আমাদের উন্নয়ন অবকাঠামোগুলোর নকশা প্রণয়ন করা হয়!
প্রজাতন্ত্রের ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্সের (অভ্যন্তরীণ নৌ অধ্যাদেশ) ৫৫ নং ধারায় বলা আছে, ঝড়ের সংকেত থাকা অবস্থায় নৌযাত্রা নিষিদ্ধ। এ আইন অমান্য করা হলে অভ্যন্তরীণ নৌযান মাস্টারের তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। অথচ পদ্মায় ২নং সতর্ক সংকেত আরোপিত থাকার পরেও পিনাক-৬ যাত্রারম্ভ করেছিল।
আইনের কঠোর প্রয়োগ থাকলে যাত্রার প্রারম্ভেই এই দুঃসাহস হয়তো সেদিন পিনাক-৬ করতই না! অধ্যাদেশের ৭০ নং ধারায় অসদাচরণ ইত্যাদির কারণে জাহাজ বিপদাপন্ন করার শাস্তির বর্ণনা করা আছে। ধারাটির (২) অনুসারে, যেখানে কোন অভ্যন্তরীণ নৌযান দুর্ঘটনার ফলে প্রাণহানি বা কোন ব্যক্তি আহত বা নৌযানের বা অন্য কোনো নৌযানের সম্পদ নষ্ট হয়ে থাকে তবে অভ্যন্তরীণ নৌযানের মালিক, মাস্টার বা কোনো কর্মকর্তা বা ক্রু সদস্য বা তাদের প্রত্যেকেই পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা এক লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা কিংবা উভয় দণ্ডেই দণ্ডিত হবেন। নরহত্যার মতো অপরাধে এই শাস্তি অতি নগন্য নয় কি?
শেষ করার আগে বলি, বিআইডব্লিউটিএ এর তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৮৭ দশমিক ৮০ মিলিয়ন মানুষ নদীপথে যাতায়াত করে। কারণ নদীপথ তুলনামূলক কম ব্যয়বহুল, আরামদায়ক এবং পরিবেশবান্ধব। অথচ দিনে দিনে নদীপথ যেন পরিণত হচ্ছে আতঙ্কের সমার্থক শব্দে!
৬.১৫ কিলোমিটারের পদ্মা সেতুর কাজ সম্পন্ন হলে দক্ষিনের ২০ জেলাকে সরাসরি ঢাকার সাথে স্থলপথে যুক্ত করা সম্ভব হবে। ফলে অধিকাংশ যাত্রীই হয়তো বাধ্য হয়ে নদীপথের এই মৃত্যু ঘাঁটিকে আর যাতায়াতের পথ হিসেবে বেছে নেওয়া থেকে মুক্তি পাবে। এই মুক্তি যত দ্রুত পাওয়া যাবে জাতির জন্য ততই মঙ্গল। নৌ দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে কার্যকরী আইন, প্রচলিত আইনের সংশোধনির মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক এবং কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। নতুবা বছর ঘুরতে না ঘুরতেই নতুন কোন পিনাক-৬ কিংবা মর্নিং বার্ড ট্রাজেদির সংবাদ শুনলে আর বিস্মিত হবো না। দুঃসংবাদ হজম করাকেই না হয় অভ্যাসে পরিনত করবো!
লেখক: শিক্ষার্থী, ডিপার্টমেন্ট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
অতিরিক্ত যাত্রী বহন পদ্মা সেতু পিনাক-৬ মর্নিং বার্ড মর্নিং বার্ড লঞ্চ মুন্সিগঞ্জ লঞ্চ দুর্ঘটনা