রেলপথের বাস্তবতা ও কিছু জিজ্ঞাসার উত্তর
৮ আগস্ট ২০২০ ১৬:২৩
ঢাকা থেকে খুলনা; ট্রেন মাত্র একটা। পাঁচশত সিট, অনলাইনে তো এক সেকেন্ডে হাওয়া হবেই! এটা অবাস্তব কিছু নয়। আসুন বাস্তবতা নিয়ে একটু ভাবি- অনলাইনে সব টিকেট ছেড়ে দেওয়াই কি সব সমস্যার সমাধান? মোটেই না। পৃথিবীর কোন দেশেই ট্রেনের শতভাগ টিকেট অনলাইনে পাওয়া যাবে না। সেটা যৌক্তিক কারণেই অসম্ভব।
আমি গ্রিনিচ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসাবে মাসিক ভিত্তিতে আন্ডারগ্রাউন্ড/জুবিলি লাইনের টিকেট সাপ্তাহিক বা মাসিক ভিত্তিতে কাটতাম। আমার জাত-পাত-পদবী কোনোকিছুই জিজ্ঞেস না করে টিকেট চেকার টিকেটের দিকে তাকিয়ে মাথা নীচু করে দ্রুত সরে যেতেন।
যার আইডি কার্ড নেই, তার কি ট্রেন ভ্রমনের অধিকার নেই?
যাত্রী হিসাবে এটা অবশ্যই তার নাগরিক অধিকার। কিংবা অপ্রাপ্ত বয়স্ক বাচ্চারা কিভাবে এনআইডি কার্ড পাবে? একজন অন্ধ, প্রতিবন্ধী, মুর্খ, এন্ড্রয়েডবিহীন চাষা কিংবা বিদেশীদের কি হবে? টিকেট অনলাইনে অথচ প্রিন্ট অফলাইনে! এ আবার কেমন অনলাইন? ‘সিএনএস’ তো রেলওয়ের ভেন্ডর মাত্র। অথচ তার কাছেই পুরো সিস্টেম কেন জিম্মি হবে? আবার আমার টিকেট কাটার কমিশন রেল না পেয়ে অন্য ফোন অপারেটর কেন পাবে?
আমাদের পেমেন্ট গেটওয়ে কি সক্রিয় আছে? অ্যাপসটা কি স্বয়ংক্রিয় হয়েছে? সে কি রেলের সব কমান্ড ধারণ করতে সক্ষম? ট্রেনে টিকেট কাটার সাথেই শত শত প্রশ্ন; হার্ড কপি পাব কই? আমার নিজের অভিজ্ঞতা, একই টিকেট তিন জনের কাছে! মোবাইল কোর্টে আমি নিজেই জরিমানা করেছি৷
টিকেট থাকবে মোবাইলের ডিসপ্লেতে। আপনার মোবাইলে থাকা অ্যাপসে ইনপুট দিলেই টিকেট স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপনার ছবি ও টিকেট ডিসপ্লেতে দেখা যাবে। ব্যাস, হয়ে গেল।
স্টান্ডিং যাত্রী থাকলে অসুবিধা কি?
বুলেট ট্রেন ছাড়া পৃথিবীর সব ট্রেনেই স্টান্ডিং যাত্রী নেওয়া হয়৷ করোনাকাল বাদ দিলে কেউ যদি এসি রুমে স্টান্ডিং কষ্ট করে প্যাসেঞ্জার হয়ে যাতায়াত করে তাতে সমস্যা কিসে? কেউ সীটে বসতে পারলেই নিজেকে বড় কিছু ভেবে বসেন। আরে কেন বাপু? দরকার হলে ৬০ শতাংশ রেটে স্টান্ডিং প্যাসেঞ্জার উঠলে ভদ্রলোক যাত্রীর কি এমন সমস্যা? কেউ উসখুশ করলে দরকার হলে তিনি কেবিনে যাক। এই দরিদ্র দেশে এত গচ্চা দিয়ে সিটের সামনে দিয়ে কেউ যাতে পারবে না- এমন আচরণ ত্যাগ করতে হবে। আমি নিজেও তো প্রায় প্রতিদিন হো মেরিস আইল্যান্ড থেকে মেডওয়ে বা গ্রিনউইচ ট্রেনে দাঁড়িয়ে গেছি। দু’একদিন স্থানীয় এমপি সাহেবকেও রডে ঝুলতে দেখেছি। আপনি টিকেট পেয়েই ভাগ্যবান বনে গেলেন, অথচ কতো অসহায় যাত্রী একটা দাঁড়ানো টিকেটের জন্য বিলাপ করছে, আপনি কি তা ভেবেছেন কখনো?
প্লিজ, আসুন অন্যের কষ্টের কথাও একবার ভাবি। যদি কোনো অনিয়মের কথা ভাবতে হয় কিংবা অনিয়ম ধরতে হয়, তাহলে সব কোচে সিসিটিভি লাগালেই তো হয়।
ডিজিটাল গেটলক কতদূর?
আধুনিক প্রায় সব দেশের ট্রেন স্টেশনগুলো ডিজিটাল সিস্টেমের আওতায়। টিকেট পাঞ্চ করা ছাড়া প্লাটফর্মে ঢুকতেই পারবে না যাত্রী। আমরা বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত অনেক কথা বলছি, কখনো কখনো পুলকিত হয়ে মারহাবা মারহাবা বলে হাততালি দিচ্ছি। কিন্তু রেল প্রযুক্তিবিদদের কাছ থেকে এ পর্যন্ত কোনো উৎসাহিত হওয়ার মতো প্রস্তাব কী পেলাম?
সার্ভার কেন হ্যাং হবে?
গত ঈদে সার্ভার বিড়ম্বনার কথা আমরা অনেকেই শুনেছি। অথচ “amazon.com” এর মতো বড় কোম্পানিগুলোও সাময়িকভাবে তাদের ডোমেইন ভাড়া দেয়। আমরা সে চেষ্টা কেন করি না?
দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ ট্রেন পাগল। ব্রিটিশরা প্রায় এক লক্ষাধিক একর জমি রেলের জন্য অধিগ্রহণ করে দিয়ে গেছে। শতবছরে সেটা লক্ষ লক্ষ মানুষ গিলে খেয়ে ফেলেছে। আমার মতো কিছু পাহারাদার (সেটা আবার অন ডেপুটেশন) গত বছর অর্ধশত উচ্ছেদ আর মোবাইল কোর্ট দিয়ে যতটুকু উদ্ধার করেছি, হয়তো দখল হয়েছে তার চেয়েও বেশি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, রেলের কোয়ার্টার, বিপুল সম্পত্তিগুলোকে আধুনিক ব্যবস্থাপনায় আনতে পারলে সেখান থেকে বছরে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। সেটা রেলের টিকেট/পরিবহন তথা কমার্শিয়াল আয় থেকেও বেশি হতে পারে। তবে এভাবে ধারাপাত মার্কা ব্যবস্থাপনা দিয়ে কবে আমরা আধুনিক রেল সিস্টেম পাবো; সেটা আল্লাহই ভালো জানেন।
লিখে কোনো সমস্যার সমাধান হবে না জানি। তবে এই দেশকে আমরা ভালোবাসি, জাতির জনকের স্বপ্ন আমরা বুকে লালন করি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হৃদয়ের বিশালত্ব, মাননীয় রেলপথমন্ত্রী মহোদয়ের আন্তরিকতা, বর্তমান রেলসচিব স্যারের অভিজ্ঞতা আর ডিজি মহোদয়ের নিখাদ দেশপ্রেম একত্রিত করে আমরা যদি কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ি তাহলে আমাদের রেল হতে পারে অনেকের কাছে ঈর্ষণীয় আধুনিক এক গতিদানব। তবে অবশ্যই এর সাথে যুক্ত হতে হবে একঝাঁক আধুনিক, দেশপ্রেমিক পরিকল্পনা ও প্রযুক্তিবিদের নিরলস পরিশ্রম।
লেখক: নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, বাংলাদেশ রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চল ও ডিভিশনাল ভুসম্পত্তি অফিসার