আরও একটি স্বপ্নের অপমৃত্যু, ‘সড়কহত্যা’ থামবে কবে?
৮ আগস্ট ২০২০ ১৬:১৪
ইমরান হুসাইন
“সড়কে থেমে গেলো পর্বতারোহীর স্বপ্ন” সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এমন খবরে আমরা থমকে যাই। মাথায় হাত রাখি! চোখে জল ফেলি! আমরা বুঝতে পারি, সড়কে আমরা কেউই নিরাপদ নই। নিরাপদ নয় আমাদের বেঁচে থাকার স্বপ্ন।
সড়কে দূর্ঘটনা নতুন নয়। সর্বশেষ গত শুক্রবার সকাল ৯টার দিকে রাজধানীর সংসদ ভবন এলাকার চন্দ্রিমা উদ্যান সংলগ্ন লেক রোডে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন পর্বতারোহী রেশমা নাহার রত্না (৩৩)। দূঃখজনক হলেও সত্য যে, প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে কোনো না কোনোভাবে সড়ক দূর্ঘটনায় আমরা হারাচ্ছি অসংখ্য মুল্যবান প্রাণ। এসব ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে, নিরাপদ সড়কের জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের যে আলোচিত আন্দোলন তা এখনো সফল হয়নি। বিষয়টি নিয়ে বিশেষভাবে পদক্ষেপ নেয়া জরুরী।
জাতীয় সংসদ ভবন এবং প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনের মাঝের সড়কে (লেক রোড) বাইসাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলেন রত্না। সেই সময় কালো রঙের একটি মাইক্রোবাস তাকে চাপা দেয়। তিনি গুরুতর আহত হন। পথচারী ও পুলিশ তাকে উদ্ধার করে পাশেই অবস্থিত শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ও নিরিবিলি সড়কে একজন বাইসাইকেল চালক যদি দূর্ঘটনার শিকার হন তবে অন্যসব ব্যস্ত সড়কের কী অবস্থা? এমন চিন্তা মাথায় আসলেই মাথা ঘুরাবে সবার। ঘর থেকে বাইরে বের হয়ে প্রাণ নিয়ে বেঁচে ফেরার স্বপ্ন যেন ধোঁয়াশা!
বেঁচে থাকার তাগিদে নিজের এবং পরিবারের সবার দুই বেলা দু’মুঠো খাবার যোগাতে সকালের আলো ফুটতেই শুরু হয় মানুষের কর্মব্যস্ততা। আর এই কর্মব্যস্ততার মধ্যেই ঘটে যায় নানারকম অঘটন। যার মধ্যে অন্যতম সড়ক দুর্ঘটনা। নিরাপদ জীবনযাপনের ক্ষেত্রে সড়ক দুর্ঘটনা একটি হুমকি।
বর্তমানে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা নিত্যদিনের একটি ঘটনায় পরিণত হয়েছে। প্রাণ হারাচ্ছে অসংখ্য মানুষ। নেই কোনো সঠিক ব্যবস্থাপনা বা জনসচেতনতা। কালে কালে দেশের সড়ক উন্নতি হলেও দিনদিন বেড়েই চলছে সড়ক দুর্ঘটনার মাত্রা। যার মাশুল দিতে হচ্ছে রাস্তায় চলাচলকারীদের। সবসময় থাকতে হয় আতংকে; এই বুঝি গাড়ি উঠে গেলো গায়ের উপর! এই বুঝি আর বাড়ি ফেরা হলো না!
ঈদের আগে-পরে ঘটে যাওয়া দেশের কয়েকটা সড়ক দুর্ঘটনার চিত্র তুলে ধরছি-
১। কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলায় ট্রাক চাপায় মোটরসাইকেল আরোহী শাহজাহান ও তার শ্যালিকা নাজমা বেগম সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত। গত ৬ আগস্ট দুপুরে উপজেলার আন্ধারীঝাড় বাজারের কাছে কুড়িগ্রাম-ভূরুঙ্গামারী সড়কের আয়নালের চাতালের সামনে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
২। গত ২ আগস্ট নীলফামারীর কিশোরগঞ্জে নৈশ কোচের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে মোটরসাইকেল আরোহী একই পরিবারের তিন সদস্য নিহত।
৩। গত ১ আগস্ট লালমনিরহাটের হাতীবান্ধায় ঈদের দাওয়াত খেতে মামার বাড়িতে যাওয়ার সময় মোটরসাইকেলের ধাক্কায় এক শিশুর মৃত্যু।
৪। গোপালগঞ্জে প্রাইভেটকার দুর্ঘটনায় সিঙ্গাপুর প্রবাসীসহ তার পরিবারের ৩ সদস্য নিহত। গত ৩০ জুলা্ই ভোর ৪টার দিকে কাশিয়ানী উপজেলার ভাটিয়াপাড়া ফ্লাইওভারে এ দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫। মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার বামুন্দী নিশিপুর গরু হাটের পাশে এটিএন নিউজের এক কর্মকর্তাসহ ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে দুইজন নিহত হয়েছেন। গত ২ আগস্ট সকাল এগারোটার দিকে এ দুর্ঘটনাটি ঘটে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, চলতি বছরের জুলাই মাসে ২৯৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় সারাদেশে নিহত হয়েছেন ৩৫৬জন। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ৩৪১জন। নিহতদের মধ্যে নারী ৬৪জন এবং শিশু ৩৫ জন।
প্রতিষ্ঠানটি আরো বলছে, দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর বেশিরভাগই ঘটেছে ঢাকা বিভাগে। এখানে ৭০টি দুর্ঘটনায় ৭৬জন নিহত হয়েছেন। সবচেয়ে কম দুর্ঘটনা ঘটেছে খুলনা বিভাগে। সেখানে ২৮টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২৭জন। একক জেলা হিসেবে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে ময়মনসিংহে। সেখানে ১৬টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ১৯জন। একক জেলা হিসেবে সবচেয়ে কম দুর্ঘটনা ঘটেছে মৌলভীবাজার। চলতি বছরের জানুয়ারী মাসের রিপোর্ট বলছে, সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩৪০টি। তাতে অন্তত ৪৪৫ জন নিহত ও ৮৩৪ জন আহত হয়েছেন।
প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনা কেড়ে নিচ্ছে তাজা প্রাণ। মুহূর্তের মধ্যে খালি করে দিচ্ছে কোনো এক মায়ের কোল। ভাগ্য ভালো হলে প্রাণ নিয়ে বেঁচে থাকছে, তবে বেঁচে থাকছে পঙ্গু হয়ে। ভুগতে হচ্ছে সারাজীবন।
কথায় আছে, “একটি দুর্ঘটনা সারাজীবনের কান্না।” ঠিক যেন তাই। কেউ যদি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান তাহলে সে মারা যাবার পর তাকে হারিয়ে নানারকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় তার পরিবারের। আর যদি তিনি আহত অবস্থায় থাকেন, তাহলেও সবাইকে ভুগতে হয় নানা সমস্যায়।
সড়ক দুর্ঘটনার পেছনে নেই কোন একক কারণ। আছে নানাবিধ কারণ যেমন-
১। অতিরিক্ত গতি সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। গন্তব্যস্থানে দ্রুত পৌঁছানোর জন্য গাড়ির চালক গতি বাড়িয়ে দেন। ফলে সামনে থাকা অন্য গাড়িকে অতিক্রম করতে গিয়ে অনেক সময় ধাক্কা লেগে যায়। এমনকি গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণে আনতে না পেরে পথচারীদের চাপা দিয়ে দেয় কিছু চালক। সড়কে কিছু চালক আছেন যারা একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতায় নেমে সড়ক দুর্ঘটনার সূত্রপাত ঘটায়। পুলিশের বেশিরভাগ রিপোর্টে সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসাবে দেখা যায় গাড়ির অতিরিক্ত গতি ও চালকের বেপরোয়া গাড়ি চালানোর মনোভাব।
২। সড়ক দুর্ঘটনার আরেকটি কারণ হচ্ছে অনুন্নত সড়কব্যবস্থা। দেশের সড়ক ব্যবস্থা যথেষ্ট উন্নত নয় বললে ভুল হবে না। এছাড়া যানবাহনের তুলনায় রাস্তা পর্যাপ্ত না। ঢাকা থেকে উত্তরাঞ্চল-দক্ষিণাঞ্চল এবং ঢাকা-চট্রগ্রামের মহাসড়কগুলো ব্যস্ততম সড়ক। ফলে সেসব ব্যস্ত সড়কে প্রতিনিয়তই ঘটছে ছোট-বড় অনেক দুর্ঘটনা। তবে সরকার সড়কগুলো চার লেন করার যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, তা সম্পন্ন হলে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হবে বলে আশা করা যায়।
৩। দেশে সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ অদক্ষ চালক। আমাদের দেশে বেশিরভাগ চালকেরই নেই যথাযথ প্রশিক্ষণ। এদের মধ্যে আবার অনেকেরই নেই লাইসেন্স। আবার অনেকে হেল্পার থেকে ড্রাইভার হয়ে যান তথাকথিত ‘অভিজ্ঞতার’ জোরে। অনেক চালক আছে যারা একেবারেই অদক্ষ এবং ট্রাফিক আইনের বিষয়ে অজ্ঞ।
৪। আরো একটি কারণ আছে, অনেক চালক গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোনে কথা বলেন, কিংবা ফুল ভলিউম দিয়ে গান শোনেন। ফলে আশেপাশের ঘটনা বা কোনো গাড়ির সংকেত বা হর্ন তারা শুনতে পান না। ফলে দূর্ঘটনার কবলে পড়ে গাড়ি।
৫। ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন সড়ক দুর্ঘটনার আরেকটি বড় কারণ। সড়কে চলাচল যানবাহনের দিকে খেয়াল করলে দেখা যায়, বহুদিনের পুরানো যানবাহনের সংখ্যাই বেশি। অসংখ্য যানবাহনের ফিটনেস সার্টিফিকেট নেই। প্রশাসন সেসব যানবাহন পরিত্যক্ত বলে ঘোষণা করার পরেও যানবাহনগুলো সড়কে চলাচল করছে এবং বড় বড় দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে।
৬। অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ সড়ক দুর্ঘটনার আরো একটি অন্যতম কারণ। বাংলাদেশ জনসংখ্যা দ্রুত গতিতে বাড়ছে। জনসংখ্যার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে যানবাহন। কিন্তু সেই তুলনায় বাড়ছে না সড়ক বা বিকল্প কোনো উপায়। ফলে বাড়ছে যানজট। আর ব্যস্ততার কারণে চালকরা গাড়ির গতি বাড়িয়ে দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছেন।
সড়কে দুর্ঘটনার পিছনে শুধু যে চালকরাই দায়ী বা সবসময় চালকদেরই দোষ; তা কিন্তু না। চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালানোর পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনার পেছনে আছে যাত্রী বা পথচারীদের অসাবধানতা বা অজ্ঞতা। যে কারণে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। মাঝে মাঝে দেখা যায় পথচারীরা ট্রাফিক আইন বা জেব্রা ক্রসিং না মেনেই এলোমেলোভাবে চলাচল করেন। আবার কখনো কখনো বাস বা ট্রাকের ছাদে উঠে অস্বাভাবিক আচরণে লিপ্ত হয়। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা আরো প্রকট আকার ধারণ করে।
দুর্ঘটনা যেভাবেই হোক না কেনো তার ফলাফল সবসময় ভয়ংকর। শুধু প্রাণ নয়, দুর্ঘটনা ক্ষতি করে শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক অবস্থান। মানব সম্পদের বিনাশ এই সড়ক দুর্ঘটনার সবচেয়ে বড় ক্ষতি। দুর্ঘটনায় কবলিত একটা পরিবার দীর্ঘদিন ধরে হাহাকার করতে থাকেন। তাদের ক্ষতি অপূরনীয়। কোনোভাবেই তা কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয় না। আর যদি পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি দুর্ঘটনার শিকার হয়ে থাকে তাহলে তার প্রভাব পড়ে দীর্ঘদিন ধরে।
সড়ক দুর্ঘটনা এড়াতে প্রত্যেকের অধিক সচেতনতা বা সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। যেমন-
চালকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদান এবং প্রকৃত লাইসেন্সধারী চালক গাড়ি চালাচ্ছে কিনা যাচাই করে দেখা দরকার। চলন্ত অবস্থায় কারো সাথে চালকদের কথা বলা উচিত না এবং ওভারটেকিং প্রতিযোগিতা থেকে বিরত থাকা। অতি পুরানো গাড়ি চলাচল নিষিদ্ধ করা। অতি ব্যস্ততম সড়কগুলোতে ফুট ওভারব্রিজ বা নিরাপত্তা জোরদার করা। ট্রাফিক বা সড়ক নিরাপত্তা আইন সম্পর্কে সচেতন করা।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধ যতো জটিলই হোক না কেন, এই সমস্যা সমাধানে সরকারের পাশাপাশি আমরা সবাই এগিয়ে এলে দুর্ঘটনা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। এ জন্য সকলকে সতর্ক হতে হবে। সড়কে সাবধানে চলাচল করতে হবে আমাদের। যথাযথ নিয়ম মেনে চলতে হবে সকলকে। একটা কথা মনে রাখতে হবে সবার “একটি দুর্ঘটনা সারাজীবনের কান্না”।
লেখক: শিক্ষার্থী ও সংবাদকর্মী
সারাবাংলা/এসবিডিই