বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড; দায় এড়াতে পারে কি বাংলাদেশ!
১০ আগস্ট ২০২০ ১৮:১০
এস.এম. রাকিব সিরাজী
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডি.সি-র পূর্বনাম ছিল ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়া। ১৭৭৬ সালে বৃটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করা আমেরিকা মাত্র ১৪ বছর পরে ১৭৯০ সালে এই শহরের নাম পরিবর্তন করে তারা তাদের জাতির পিতা ও প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের নামে নামকরণ করে । বলা হয়ে থাকে, পৃথিবীতে ঘোষণা দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে মাত্র দুটি দেশ। একটি বাংলাদেশ ও অপরটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিনীদের জ্ঞান-গরীমা, ইতিহাস-ঐতিহ্য, নাগরিকদের শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান তথা জীবনমান; এক কথায় বর্তমান দুনিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কোথায় সেটা কমবেশি আমরা সবাই জানি। সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুধু কি জাতির পিতার নামে রাজধানীর নামকরণ করেই ইতিহাসের দায়মোচন করেছে? না। বাংলাদেশে যেমন জাতীয় স্মৃতিসৌধ আছে, আমেরিকাতেও এমন জাতীয় স্মৃতিসৌধসহ ছোট-বড় বহু স্মৃতিসৌধ আছে। কিন্তু আমেরিকায় জাতির পিতা জর্জ ওয়াশিংটনের স্মরণে আলাদা করে বিশাল আকৃতির আরো একটি নান্দনিক ও ঐতিহাসিক স্মৃতিসৌধ আছে, যার বর্ণনা এমন যে ‘The Washington Monument is an obelisk on the National Mall in Washington, D.C. built to commemorate George Washington, once Commander – In – Chief of the Continental Army (1775–1784), in the American Revolutionary War and the first President of the United States (1789–1797).’
আমেরিকায় জর্জ ওয়াশিংটনের নামে এমন আরো অনেক কিছুই আছে। তাদের জাতির পিতার স্থায়ীভাবে প্রাপ্য সম্মান তারা নিজ দায়িত্বে বুঝিয়ে দিয়েছে ইতিহাস নির্মাণের শুরুতেই। এক্ষেত্রে কোনো কার্পণ্য বা সংকীর্ণতা বা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যাবার মতো জঘন্য বিতর্ক বা সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়নি। এখনও না, তখনও না। এজন্যই হয়ত মার্কিনীরা বর্তমান পৃথিবীতে এখন সমুন্নত জাতি। বঙ্গবন্ধুর যেমন পলিটিকাল লিগ্যাসি আছে, জর্জ ওয়াশিংটনেরও তেমন পলিটিকাল লিগ্যাসি আছে। অথচ বাংলাদেশে জাতির পিতার নামে রাজধানীর নামকরণ করা দূরে থাক, এই ধরণের চিন্তা করাটাও এই দেশে পাপ ও বিকৃত চিন্তার মানুষ হিসেবে স্বীকৃত হয়। যাও কয়েকটি ছোটখাটো প্রতিষ্ঠান বা স্থাপনা বঙ্গবন্ধুর নামে করা হয়েছে, তা ভবিষ্যতে অন্য কোনো সরকার এসে রাখবে কিনা এটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। যেমন, ২০০০ সালে ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে নামকরণকৃত ‘বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের নাম পরিবর্তন করে ২০০২ সালে ‘বাংলাদেশ চীনমৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র’ নাম দিয়ে উদ্বোধন করেছিল তৎকালীন সরকার। এমন বহু উদাহরণ আছে।
যাই হোক, শুরুতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রসঙ্গ টানার কারণ হলো আমি বা আপনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তুলনামূলক পরিমাপের স্টান্ডার্ড উদাহরণ মনে না করলেও, অধিকাংশ লোকই সেটা মনে করেন।
তবে আমরা বাংলাদেশের মানুষজন যে দেশের উদাহরণ দিলে খুব সহজে বুঝি তা হলো ভারত। প্রতিবেশী দেশ বলেই হয়ত এমন সহজবোধ্যতা। ভারতের জাতির পিতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ওরফে মহাত্মা গান্ধী। গান্ধীজীকে ভারতে কতটুকু মূল্যায়ন ও সম্মান করা হয় তার ধারণা পাওয়ার জন্য সাম্প্রতিক সময়ে ভারত সফরে আসা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সফরসূচীটি লক্ষ্য করা যেতে পারে। ট্রাম্প আমেদাবাদ বিমানবন্দরে অবতরণ করতেই তাকে রিসিভ শেষে ২২ কিলোমিটার রোডশো করে ভারতীয় জনতা পার্টির নেতা ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী প্রথমেই নিয়ে যান সবরমতী আশ্রমে। সেখানে জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীকে শ্রদ্ধার্ঘ জানানোই ছিলো বিজেপি শাসিত ভারতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সফরের প্রথম কর্মসূচি। অথচ মহাত্মা গান্ধীর রাজনৈতিক লিগ্যাসি মোটামুটি যতটুকুই ছিল তা গান্ধী পরিবার তথা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের দিকে। এটা রাষ্ট্র হিসেবে ভারতে পলিটিক্যাল ম্যাচিউরিটি বা রাজনৈতিক পরিপক্কতার উদাহরণ বললেও ভুল বলা হবে না। বাংলাদেশে বিগত সময়ে আওয়ামী লীগ ছাড়া যে বা যারাই ক্ষমতায় ছিল, বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে সেইসব সরকারের সরকারি উদ্যোগে এই ধরণের ঘটনা প্রায় বিরল বললেই চলে।
মহাত্মা গান্ধীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি এবং হত্যাকারীদেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে বিচার সম্পন্ন করা হয় ১৯৪৯ সালের ১৪ই নভেম্বর। ২ বছরেরও কম সময়ের ব্যবধানে তারা এই জঘন্য কাণ্ডের বিচার সম্পন্ন করে কলংকমুক্ত হয়েছিল, ইতিহাসের দায়মোচন করেছিল।
আর বাংলাদেশে তাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার স্থায়ীভাবে বন্ধ করার জন্য সংসদে আইন পাশ করা হয়েছিল! সংবিধান সংশোধন করা হয়েছিল! যতটুকু বিচার হয়েছে তা সম্পন্ন করতে লেগেছে ৩৫ বছর। তাও অর্ধেক! বাকি অর্ধেক আসামী এখনো পালাতক।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে উপরের দুটি উদাহরণ দেখে আমাদের কেউ কেউ বলতে পারেন এসব বিধর্মীদের দেশ। ঐসব দেশের সাথে আমাদের দেশের তুলনামূলক আলোচনা বা উদাহরণ টেনে আনা অনর্থক। সেসব মানুষজনের উদ্দেশ্যে সৌদি আরবের উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।
সৌদি আরব পৃথিবীর হাতেগোনা কয়েকটি দেশের একটি, যাদের কোনো লিখিত সংবিধান নেই। ফলে সৌদি আরবের জাতির পিতা আব্দ আল আজিজ বিন সৌদ এর মর্যাদার জন্য লিখিত কোন নিয়ম নেই। তবে অলিখিত যে ‘মর্যাদা’ বিদ্যমান, তা বোধ করি পৃথিবীর আর কোনো দেশে নেই। সৌদি আরবে তার মুর্তি ছাড়া সকল ধরনের শত শত প্রতিষ্ঠান, স্থাপনা, সড়ক আছে। এমনকি প্রতিটি শহরে, গ্রামে, গঞ্জে। তার সমালোচনা? সরাসরি রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল এবং এর শাস্তি ‘গর্দান কেটে কল্লা আলাদা’ করে দেওয়ার মতো!
এমনিভাবে মুসলিম-অমুসলিম পৃথিবীর প্রায় অধিকাংশ দেশের জাতির পিতা আছে এবং তিনি সচরাচর বিতর্কের উর্ধ্বে। জাতির পিতার সর্বোচ্চ সাংবিধানিক মর্যাদা বিদ্যমান এবং রাষ্ট্র বা সরকার তা স্বতঃস্ফুর্ত আগ্রহ থেকেই পালন করে থাকে। পৃথিবীর প্রায় সব জাতির জনকেরই ‘পলিটিকাল লিগ্যাসি’ রয়েছে। তাদের আদর্শিক রাজনৈতিক দল রয়েছে। অধিকাংশ দেশে জাতির জনকের পলিটিক্যাল লিগ্যাসির বিরোধী দল রয়েছে এবং সেইসব দল জাতির জনককে জাতির জনক হিসেবে মেনেই রাজনীতি করে। বোধহয় পৃথিবীর একমাত্র ব্যতিক্রম দেশ এই বাংলাদেশ। অবশ্য বাংলাদেশ এটা ছাড়াও এরকম আরো বহু অদ্ভুত বিষয়ে ব্যতিক্রমের উদাহরণ। বাংলাদেশে কেন এমনটা হয়? তার সাধারণ দৃশ্যমান অনেক কারণ থাকলেও, ঠিকঠাক কারণ বর্ণনা বিশাল গবেষণার বিষয়। তবে এর কারণ হিসেবে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ যা ধারণা করি তা হচ্ছে, দীর্ঘ বছরের রাজনৈতিক অপপ্রচার আর আমাদের সংকীর্ণ মানসিকতা।
উল্লেখ করার মতো ব্যাপার হলো, কিছুদিন আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা কর্তৃক তার নিজস্ব ফেসবুক আইডিতে বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বঙ্গতাজ শহীদ তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে দেয়া এক পোষ্টের পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্ট বিতর্কে নানানজন নানান কথা লিখেছেন। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের বড় একটা অংশ এটা নিয়ে কিছুদিন বেশ ভালোই সরব ছিল। এরইমধ্যে আমার পরিচিত এক বড়ভাইয়ের ফেসবুক পোস্ট চোখে পড়ল। তিনি যা লিখেছেন তা থেকে আমি যা বুঝলাম তার সারমর্ম হচ্ছে –“তাজউদ্দীন আহমদ সাহেবের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা বা প্রজ্ঞা বঙ্গবন্ধুকে ছাড়িয়ে যাবার একটা সম্ভাবনা থেকে ৬০ এর দশকের শেষ কিংবা ৭০ এর দশকের শুরু থেকেই আওয়ামী লীগের মধ্যে শেখ পরিবারের যারা আছেন তারা একটা ‘ইনসিকিউরিটি ফিল’ করতে থাকেন এবং সেই ‘ইনসিকিউরিটি ফিলিংস’ থেকেই তাজউদ্দীন আহমদ ও তার পরিবারকে আওয়ামী লীগে কোণঠাসা করে রাখার একটা চেষ্টা চলছে সেই সময় থেকেই। এবং সেই চেষ্টার ধারাবাহিকতা থেকেই প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের ঐ কর্মকর্তার ওরকম ফেসবুক পোস্ট!”
তার ফেসবুক পোস্টের এক পর্যায়ে তিনি লিখিছেন, ‘আওয়ামী লীগ শেখ পরিবারের পারিবারিক ফ্রাঞ্চাইজি, শেখ মুজিব সেই ফ্রাঞ্চাইজির একমাত্র ব্র্যান্ড! ‘শব্দচয়ন লক্ষ্য করুন! একটা দেশের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করা একজন তরুণ, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টেলেকচুয়াল সার্কিটগুলোতে আনাগোনা করতেন এবং বর্তমানে নিজেকে পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পছন্দ করছেন, তিনি তার দেশের জাতির পিতাকে বলছেন একটা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ‘একমাত্র ব্র্যান্ড’! এটা হচ্ছে স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে স্বাধীন বাংলাদেশের একজন আন্তর্জাতিক মানের ‘অধিকার সচেতন’ নাগরিক কর্তৃক তার দেশের জাতির জনককে নিয়ে কথা বলা ও সম্বোধনের পরিপক্কতা! ঐ যে ভারতের পলিটিক্যাল ম্যাচিউরিটির কথা বললাম না? বাংলাদেশও এমন পলিটিকাল ম্যাচিউর হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু একটা দেশের নেতা কেমন হবে তা যেমন নির্ভর করে সেই দেশের জনগণ কেমন তার উপর, তেমনই একটা দেশের পলিটিকালি ম্যাচিউর্ড হয় তখন, যখন সেই দেশের জনগণ রাজনৈতিকভাবে পরিপক্ক হয়।
যাই হোক, তার এই ফেসবুক পোস্ট নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা সময়সাপেক্ষ বিতর্কের বিষয়। তার এই লেখা দেখতে পারলে তুখোড় মেধাবী ও গাম্ভীর্যপূর্ণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী স্বয়ং তাজউদ্দীন আহমদ সাহেবও গাম্ভীর্য ভেঙে হাসতেন নাকি কাঁদতেন নাকি তার দূরদর্শিতা দিয়ে ধরে ফেলতেন এই লেখার সুদূরপ্রসারী হেতু কি, তা আমাদের আক্ষেপ হিসেবেই থেকে যাবে আজীবন। কারণ তিনি বেঁচে নেই। তবে এই ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে তার সন্তানদের লেখা চিঠিতে তাজউদ্দীন আহমদ পরিবার স্বাধীন বাংলাদেশের জাতির পিতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে যেভাবে দ্বিধাহীনচিত্তে সম্মান ও সম্বোধন করেছেন, তা থেকে এটা স্পষ্ট যে ঐ বড়ভাই এর বক্তব্য ও বক্তব্যের সারমর্ম একান্তই তার নিজের ভাবনা থেকে সৃষ্ট বক্তব্য। কারণ আওয়ামী লীগ বিরোধী ছাড়া বাংলাদেশের কোনো অংশের, কোনো পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতা বা কর্মী বা ‘ব্যক্তি তাজউদ্দীন আহমদ’কে নিয়ে যারা গবেষণাও করেন, তাদের কাছ থেকেও কোনদিন এই রহস্যময় ‘ইনসিকিউরিটি ফিলিংস’ থিওরির কথা শুনিনি।
অবশ্য এন্টি আওয়ামী লীগ, এন্টি শেখ মুজিব বা এন্টি তাজউদ্দীনপন্থীদের কাছে এই ধরণের তো বটেই এর চেয়েও আরো তীব্র কৌতুকময় থিওরি বহু আগে থেকেই বিরাজমান। যাকে বা যাদেরকে আমার ভালো লাগে না, তাকে বা তাদেরকে নিয়ে চোখ বুজে নেতিবাচক বা ধ্বংসাত্মক কল্পনার মতো অমৃত সুখ বাঙালীদের চেয়ে বেশি কেউ অনুভব করতে পারে না, এ কথা হলফ করেই বলতে পারি। আর ফেসবুকের এই যুগে আজকাল সেই সুখানুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটায় ফেসবুকে লিখে, লাভ রিঅ্যাক্ট করে, কমেন্ট করে!
আপনি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের হাজারটা সমালোচনা করতে পারেন, আওয়মী লীগে শেখ পরিবারের উপস্থিতি নিয়ে আপনার ব্যক্তিগত আপত্তি থাকলে আপনি সমালোচনা করতে পারেন, কেউ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ব্যবসা করলে সেটাও সমালোচনা করতে পারেন; সেটা আপনার ব্যক্তিগত বিষয়। অথবা আপনি কোনো রাজনৈতিক আদর্শের সমর্থক হলে সেটা আপনার রাজনৈতিক বিষয়ও বটে। কিন্তু ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দেশের জন্য যে ত্যাগ ও সংগ্রাম, তার যে রাজনৈতিক দর্শন এবং আমৃত্যু তার যে উদার ও বিশাল ব্যক্তিত্ববোধ ছিল, তা আপনার বা আপনার মতো যারা এভাবে ভাবেন ও লিখেন, তাদের কর্তৃক বঙ্গবন্ধুকে অসম্মানিত করা হয়। কারণ আমরা আপনাদেরকে প্রথম বিশ্বের উন্নত বোধ সম্পন্ন মানুষদের মতো ‘ম্যাচিউর্ড সিটিজেন’ হিসেবে কল্পনা করি।
বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। একটি দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান নেতা ও দেশটির স্থপতি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব করার মতো অনেক কিছু থাকলেও, এর চেয়ে বড় গৌরবের বিষয় কি হতে পারে সেটা আমার বোধগম্য নয়। সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে নামকাওয়াস্তে একটি ম্যুরাল ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে উল্লেখ করার মতো আর কি আছে তা আমি গত ৬ বছর এই বিশ্বিবদ্যালয়ে পড়াশোনার জন্য অবস্থানকালে জানতে পারিনি। যারা বলবেন, একটি হল আছে বঙ্গবন্ধুর নামে ,তারা এটাও জানেন যে এমন আরো ২০টি হল ২০জনের নামে আছে। এটা উল্লেখ করার মতো বিশেষ কিছু নয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু আমাদের কাছে বিশেষ কিছু এবং তা নিঃসন্দেহে। অথচ এখানে শিক্ষা ও গবেষণার চেয়ে ঢের বেশি প্রতিনিয়ত বঙ্গবন্ধুকে বিক্রি করা হচ্ছে।
কিছুদিন আগে টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের উল্টো দিকে মিলন চত্বরের সামনে বঙ্গবন্ধুর একটি নানন্দিক পোট্রের্ট সম্বলিত চমৎকার অস্থায়ী মঞ্চ স্থাপন করা হয়েছিল। দল-মত নির্বিশেষে এই মঞ্চের প্রতি মানুষের ভালোবাসা ও ভালোলাগা ছিল চোখে পড়ার মতো। খুব স্বাভাবিকভাবেই কোনো সমালোচনা ছিল না। কারণ প্রাসঙ্গিক কোনকিছু নিয়ে আমাদের তথাকথিত ইন্টেলেকচুয়ালরা সমালোচনা করলেও সাধারণ মানুষ অপ্রাসঙ্গিক এই সমালোচনাকে ঘৃণাই করে। আর বঙ্গবন্ধু সাধারণ মানুষের নেতা ছিলেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সম্পৃক্ত বহু মানুষ এমনকি দলীয় শিক্ষক নেতারা প্রতিনিয়ত বঙ্গবন্ধুর নামে বক্তৃতা করে মুখে ফেনা তুলেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে এই বিশ্বিবদ্যালয়ে চিরভাস্বর করে রাখার জন্য কোন স্থায়ী উদ্যোগ বা পরিকল্পনার কথা আমরা শুনিনা। যারা টুকটাক ভাবতে চান তারা হয়ে যান কোনঠাসা!
বর্তমানে টানা তিনবারসহ আওয়ামী লীগ এ নিয়ে চতুর্থবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় (১৯৭৫ সালের পরে)। বিভিন্ন দিবস এলে ১০/১৫ জনের ছবির এক কোণে বঙ্গবন্ধুর ছবি দিয়ে এই লীগ, ঐ লীগ, আতিলীগ, পাতিলীগের পোষ্টারে ছেয়ে যায় রাজধানী। অন্যান্য বিভাগীয় শহর, জেলা শহর, উপজেলা শহর এমনকি গ্রাম-গঞ্জের অবস্থাও প্রায় একই। অথচ আওয়ামী লীগের বা সরকারের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুকে স্থায়ীভাবে স্মরণীয় করে রাখার জন্য চোখে পড়ার মতো কোনো উদ্যোগ বা আইন গৃহীত হয়েছে বলে আমি মনে করতে পারছি না। যা দুঃখজনক। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক লিগ্যাসির দল হিসেবে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ এই দায় এড়াতে পারে না।
এখনো সময় আছে অনেক কিছু করার। এখনো সময় আছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সব ধরনের ব্যবসা বন্ধ করার। তাই আওয়ামী লীগ সরকারের উচিত হবে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে এই মৌলিক বিষয়টায় জোর দেয়া। একটি দেশ বা জাতিকে পরিশুদ্ধ করার জন্য, উন্নত করে গড়ে তুলার জন্য, মাথা উঁচু করে চলার জন্য সবার আগে সেই জাতিকে ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা থেকে দায়মোচন নিতে হয়। সেই হিসেবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অনেক ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা থাকলেও সবার আগে জাতির পিতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে সব রকমের বিতর্কের উর্ধ্বে রেখে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করাই প্রথম কাজ বলে আমি মনে করি।
আমাদের জাতীয় ঐক্যের অন্যতম প্রতীক হতে পারেন রাষ্ট্রের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কারণ আমাদেরকে সচেতনভাবে খুব ভালো করেই এটা মাথায় রাখা প্রয়োজন যে, আমি-আপনি মানি বা না মানি, আমার-আপনার ভালো লাগুক বা না লাগুক, যৌক্তিক, বাস্তবিক কারণে নূন্যতম সন্দেহের অবকাশ ছাড়াই পৃথিবীর ইতিহাসে বাংলাদেশের জাতির পিতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু তার আপন কর্ম ও মহিমায় স্থান করে নিয়েছেন। ফলে ডান, বাম, মধ্যম, উত্তর বা দক্ষিণপন্থী আমরা যারাই যে পন্থী আছি আমাদের এটা মেনে নিয়েই রাজনীতি করতে হবে যে জর্জ ওয়াশিংটনকে বাদ দিয়ে যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস নির্মাণ সম্ভব নয়, নেলসন মেন্ডেলাকে বাদ দিয়ে যেমন দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাস নির্মাণ সম্ভব নয়, মোস্তফা কামাল পাশাকে বাদ দিয়ে যেমন তুরস্ক, মাও সেতুংকে বাদ দিয়ে যেমন চীন কিংবা মহাত্মা গান্ধীকে বাদ দিয়ে যেমন ভারতের ইতিহাস নির্মাণ সম্ভব নয়, তেমনি জাতির পিতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাদ দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস নির্মাণের চিন্তা করাও সম্ভব নয়।
লেখক: সাহিত্য সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ ও সাবেক সভাপতি, ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটি
সারাবাংলা/এসবিডিই
১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড