Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ভয়ে ভরা আগস্ট ভয়মুক্ত হবে কিভাবে?


৩১ আগস্ট ২০২০ ১৮:১৫

১৯৭৫ সালের আগস্ট ট্রাজেডির বহুকাল পর ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট এবং ২০০৫ সালের ১৭ আগস্টের বিভীষিকাময় ঘটনা দু’টি বাংলাদেশে বিশেষ করে আওয়ামী লীগের ভিতরে নিরন্তর আগস্টভীতির জন্ম দিয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো এই ভয় কাটবে কিভাবে? আসলে উজ্জ্বল ’৭১ ও ভয়ঙ্কর ’৭৫ এর পরে যাদের জন্ম এবং যারা মিথ্যাচার শুনে শুনে বড় হয়েছে তাদের কাছে  এই দুই সময়ের আসল ইতিহাস নেই। তবে অসংখ্য বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে যারা সব জেনে গেছে তারা সেই সময়ের অনেকের চেয়েও এই দুই সময়ের হেতু ও মর্ম বেশি ভালো বুঝবে। কারণ ঐ দুই সময়েরও অনেকে আছেন যারা পত্রিকা বা বইপত্র না পড়ে অন্যের কাছ থেকে মিথ্যাচার শুনে শুনে মস্তিষ্ককে অন্ধকারে ভরে রেখেছেন। যেমন, ঐ সময়ের অনেকেই এখনো বলবেন মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস বঙ্গবন্ধু ছিলেন জেলে, তাই স্বাধীনতা লাভে তার কোন ভূমিকাই নেই এবং মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে জিয়ার ঘোষণায় আর জিয়াই এর আসল নায়ক। আবার, ‘৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পরেও কেউ টু শব্দটিও করল না কেনো? এর উত্তরে তারা বলবে শেখ মুজিব রক্ষীবাহিনী দিয়ে দেশটা ধ্বংস করে ফেলছিল আর তার ছেলে শেখ কামাল ব্যাংক ডাকাতি, লুটতরাজ করে মানুষের বিরক্তির এমন সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল যে ৭৫ এর ঘটনাটা দরকারই ছিল; তাই কোন প্রতিবাদ আসেনি। তাছাড়া ‘৭৫ এর ঘটনাকে আরও বেশি ধোঁয়াশাচ্ছন্ন করে দিতে ইত্তেফাকের মতো প্রথম সারির পত্রিকাও ভূমিকা রেখেছিল। ঐসময়ের পত্রিকা দেখলেই তা বুঝা যায়। অর্থাৎ আসল ঘটনাটি জানা খুবই মুশকিলের ব্যাপার ছিলো। কাদের সিদ্দিকীর মতো কেউ কেউ যে দলবল নিয়ে প্রতিবাদ করেছিল তার খবর তো ওদের কাছে নেই। তারা বলবে ১৫ই আগস্টের ঘটনাটা না ঘটলে দেশ আরও অরাজক হতো; ভারতের আগ্রাসনে চলে  যেতো বা এদেশ আর মুসলমানরা থাকতো না ইত্যাদি।

বিজ্ঞাপন

একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে নতুন প্রজন্মের একটা বড় অংশ ১৫ আগস্টের আসল ঘটনা জানার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যা সেই সময়ের অনেকেই করেনি। মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলৎজ বলছেন ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডে মোশতাকের চেয়েও বড় ভূমিকায় ছিল জিয়া। ১৫ আগস্টের কিছুদিন আগে, বাংলাদেশ জোনের তৎকালীন সিআইএ প্রধান ফিলিপ চেরীর সাথে জিয়ার নৈশভোজেই অভ্যুত্থান ঘটানোর বিষয়ে আলোচনা হয় বলে তিনি দাবী করেন। তাছাড়া উপসেনাপ্রধান জিয়ার সমর্থন ছাড়া এমন বড় অভ্যুত্থান সম্ভব নয় বলেও তিনি মত দেন।

বিজ্ঞাপন

এবার আসি আমাদের কথায়। আমরা কেনো এত বছর ধরে চুপ ছিলাম? আর এখন বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু বলে জান দিচ্ছি! এর পিছনে ছিল অনেকগুলো কারণ। (১) চতুর জিয়া তার সূক্ষ্ম চাতুর্যনীতি দিয়ে পুরো অভ্যুত্থান এবং এর পরবর্তী সময়টাকে ধোঁয়াশায় ঢেকে দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে নিজেকে নিরপেক্ষ হিসেবে পরিচিত করাতে সফল হন। (২) জিয়ার বিএনপি গঠন এবং বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা ও নেতৃত্বের উপর অস্বস্তিকর ও পরশ্রীকাতর হয়ে থাকা একদল মানুষকে সেখানে আশ্রয় দান। (৩) দেশপ্রেমের ছদ্মাবরণে পুরো দেশকে জিয়াময় করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা। (৪) ১৫ আগস্ট পরবর্তী থমথমে অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে কৌশলে বঙ্গবন্ধুর শাসন ও জনপ্রিয়তার উপর মিথ্যাচারের ফুলঝুরি এবং সফলতার সহিত ইনডেমনিটি পাশ। (৫) এতকিছুর পর মানব-মস্তিষ্কের আচ্ছন্নতা রোগ বা সিদ্ধান্তহীনতা বিষয়ক যে সীমাবদ্ধতা তাতে আমাদের আচ্ছন্ন হয়ে পড়া।

আসলে আমরা আচ্ছন্নই ছিলাম এবং এখনো আছি, নয়তো আমাদের মাথায় এ চিন্তাটা কেন এলো না যে ডালিমের মতো বরখাস্ত হওয়া একজন স্থূল মস্তিষ্কের মেজর কার অনুমতি নিয়ে অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্রশস্ত্র, এমনকি কামানের গোলাবারুদ নিয়ে বেরিয়ে পড়লো? সেনাপ্রধান তো সবসময় এতকিছু দেখার সময় সুযোগ পান না। কিন্তু উপপ্রধানও কি জানতেন না। এরপর! কর্নেল জামিল বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতে গিয়ে গুলি খেলেন। সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ বের হয়ে দেখলেন ক্ষমতা এবং পরিস্থিতি কোনোটাই তার হাতে নেই। তাহলে কার হাতে ছিল সব? এমন অনেক সহজ প্রশ্নের উত্তর খোঁজারও চেষ্টা করিনি আমরা।

এবার আসি ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ঘটনায়। ঘটনাস্থলে শেখ হাসিনা উপস্থিত, তার কান  আহত হলো; তার দলের লোকেরা মানব দেওয়াল বানিয়ে তাকে রক্ষা করলেন। আর খালেদা জিয়া বলে দিলেন- “শেখ হাসিনা তার ভ্যানেটি ব্যাগের ভিতরে গ্রেনেড রেখেছিলেন”। এটা সুস্পষ্ট যে, এমন মন্তব্য  ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়। তদুপরি ২০০৫ সালে আবার ৬৩ জেলায় বোমা হামলা। এভাবে আগস্টকেই কেন বেছে নেওয়া হচ্ছে? এর চেয়েও বড় প্রশ্ন , খুনিরা কেন ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবসে বঙ্গবন্ধুকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল?  তাহলে কি ভারত বিদ্বেষ এর একটি বড় কারণ? তার মানে ১৫ আগস্টের ঘটনায় তো ভিনদেশী চক্রান্ত ছিলই বলা যায়। যদি তাই হয়,  আমরা কেন ভারত বিদ্বেষকে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছি? ১৯৭১-এ ভারতবিদ্বেষী ছিল তো রাজাকাররা। ‘ভারতের দালালেরা হুশিয়ার সাবধান’ এই স্লোগান দিয়েই তো রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ করতো। এখন আমরা কেন এত ভারতবিদ্বেষী হয়ে উঠলাম? গঙ্গার পানি দেয়নি বলে? অন্য প্রশ্ন, ৭৫ এর ১৫ আগস্ট এবং এর পরবর্তী  হত্যাকাণ্ডসমূহের সাথে জিয়ার এত সম্পৃক্ততা থাকার পরও জিয়া এবং বিএনপি এখনো কেন এত জনপ্রিয়? এটা আমাদের অযথার্থ আচ্ছন্নতা নয় কি? আচ্ছা, রক্ষীবাহিনী ইস্যু, অরাজকতা, দুর্নীতি এসব নেতিবাচক বিষয়গুলো দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের তৈরি কি-না যা বঙ্গবন্ধুকে  তাজউদ্দীন ও জনগণের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিল?

কমিশন গঠন করে হোক আর যেভাবেই হোক  এই প্রশ্নগুলোর জবাব খোলাসা হলে আগস্টভীতি আর থাকবে না। নতুবা, এ ভয় দূর হবেনা; ষড়যন্ত্রকারীরা ছলে বলে কলে কৌশলে নানানভাবে বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাস থেকে নিশ্চিহ্ন করার এবং তার বংশধরদেরকে মেরে ফেলার প্রচেষ্টা চালাবে আবার।  বদরুদ্দিন উমর যেমন বলেছিলেন ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবের কোন ভূমিকাই নেই, তেমনি ওদের কারো কারো মুখে এখনই শোনা যায় স্বাধীন বাংলার স্থপতি হলেন শেরে বাংলা অথবা সোহরাওয়ার্দী; শেখ মুজিব তো নয়। উপরের সব প্রশ্নের জবাব খোলাসা করে দিলে এসব ষড়যন্ত্রকারীদের সব চক্রান্ত এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে।

লেখক: প্রধান নির্বাহী,  ফুল-পাখি-চাঁদ-নদী রিসার্চ এন্ড এডভোকেসি ফোরাম।

আগস্ট

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর