Wednesday 27 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইন ক্লাস: বাস্তব কার্যকারিতা কতটুকু?


৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৬:৩৮

অনিক মাহমুদ (ছদ্মনাম) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে পড়ছেন দেশের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। গ্রামের বাড়ি খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার মহারাজপুর ইউনিয়নে। করোনায় বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার দিনগুলোয় অন্যান্য শিক্ষার্থীদের মতো তিনিও চলে গেছেন বাড়িতে। সেখান থেকেই অনলাইনে ক্লাস করতে হচ্ছে তাকে। সমস্যা হচ্ছে, তার বাড়িতে নেটওয়ার্ক থাকে না বললেই চলে। এজন্য ক্লাসে অংশ নিতে তাকে সবসময়ই দুই মাইল দূরের এক বট গাছের উপর উঠে বসতে হয়। তবেই মিলে হাইস্পিড ইন্টারনেট।

বিজ্ঞাপন

অনলাইন ক্লাসের ধারণাটির সাথে বাহিরের দেশের শিক্ষার্থীরা বেশ পরিচিত থাকলেও সে তুলনায় বাংলাদেশে ততটা পরিচিত নয় নতুন ধারার এই শিক্ষা কার্যক্রমটি। করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার সময়ে বিকল্প পাঠদান ব্যবস্থা হিসেবে গেল কয়েক মাসে বেশ আলোচিত এই ধরণটি। স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই নিয়মিত অনলাইন ক্লাস হচ্ছে এখন। কিন্তু কতটা কার্যকরী ভূমিকা রাখছে এই ব্যবস্থা? প্রযুক্তির সহায়তায় নেওয়া এসব ক্লাস থেকে সুফল পাওয়ার প্রশ্নে শিক্ষার্থীরাই বা কতটা গুরুত্বের সাথে নিচ্ছে ভার্চুয়াল এই পাঠদান? বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইন ক্লাসের বাস্তব চিত্র তুলে ধরে এই লেখায় এসব প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টা থাকবে।

বিজ্ঞাপন

শুরুতেই প্রযুক্তিগত বিষয়টি নিয়ে আলোকপাত করতে চাই। সাধারণত লকডাউনের সময়টায় জুম, গুগল মিট এবং স্ট্রিমইয়ার্ড এর মতো এপসগুলো অনলাইন ক্লাস নেওয়ার ক্ষেত্রে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তবে ব্যয়বহুল হওয়ায় এসব এপস ব্যবহারে আগ্রহ পাচ্ছেন না সংশ্লিষ্টরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইআর) বিভাগের তিনজন সহযোগী অধ্যাপকের এক গবেষণার তথ্যমতে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৬২ শতাংশ মোবাইল ডেটা, ৩৬ শতাংশ ওয়াইফাই বা ব্রডব্যান্ড ও ২ শতাংশ পোর্টেবল মডেমের মাধ্যমে ইন্টারনেট সুবিধা গ্রহণ করছে। জরিপের ফল বলছে, মোবাইল ডেটার ব্যবহার করে ক্লাস করার হার সবচেয়ে বেশি।

স্মার্টফোনে জুম এপস এক ঘণ্টা ব্যবহারে প্রায় ২৮০-৩০০ মেগাবাইট ডেটা খরচ হয়। এরচেয়ে কিছুটা বেশি খরচ হয় গুগল মিটে। ল্যাপটপে ব্যবহারের ক্ষেত্রে এই ডেটা খরচ বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। প্রতিদিন তিন থেকে চারটি ক্লাস করলেই এক গিগাবাইট ডেটা খরচ হয়ে যায়। এতে করে মাস শেষে ইন্টারনেট বিল দিতে গড়ে সাত থেকে আটশ টাকা গুনতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী ইন্টারনেটের এত খরচ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলছিলেন, “এই সময়ে এসে এই টাকা আমার পারিবারের পক্ষে যোগান দেওয়া সম্ভব নয়। ঢাকায় টিউশনি করে আমি আমার নিজের খরচ নিজেই চালাতাম। এখন সেটাও বন্ধ।” মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য গেল মাসে শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে ইন্টারনেট প্রদান অথবা স্বল্পমূল্যে ইন্টারনেট প্যাকেজ দেওয়া যায় কিনা সে ব্যাপারে মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আলোচনা চলার কথা জানিয়েছিলেন। তারই ফলশ্রুতিতে ২ সেপ্টেম্বর টেলিটকের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মাসিক ১০০ টাকা খরচে ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে ইউজিসি। তবে এটি কবে বাস্তবায়ন হবে সেটি স্পষ্ট করা হয়নি। অনেক শিক্ষার্থী ক্লাস না করার কারণ হিসেবে ডিভাইস না থাকার কথাও বলেছেন। সম্প্রতি ইউজিসি এমন শিক্ষার্থীদের তালিকা করতে বলেছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে।

এ তো গেল আর্থিক দিক, এটি ছাপিয়ে আলোচনায় এসেছে ইন্টারনেটের গতি। এসব এপসে যেহেতু ভিডিওকলের সুবিধা নিয়ে শিক্ষকরা ক্লাস করেন, তাই উচ্চগতির ইন্টারনেট না থাকলে ভিডিও আটকে থাকে, ব্যাহত হয় ক্লাস। শহরে ইন্টারনেটের গতি সহনীয় পর্যায়ে থাকলেও গ্রামে বেহাল অবস্থা। এজন্য অনিকের মত অনেক শিক্ষার্থীকে গতি পেতে অদ্ভুতুড়ে সব উপায় বের করতে হচ্ছে। তাতেও সফল না হলে ক্লাস করা থেকে বঞ্চিত থাকতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের বড় একটা অংশকে। এটি নিয়ে সামগ্রিক কোনো জরিপের তথ্য না থাকলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন সাদেকা হালিম বলছেন, “আমরা জরিপ করে দেখেছি, নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে পারছে না।”
তাহলে কি বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে ক্লাসে অংশ নিতে না পারা শিক্ষার্থীদের?

এতসব বাধা আর সমস্যার পথ পেরিয়ে যারা ক্লাস করতে পারছে তারা কতটা উপকৃত হচ্ছে সেটা জানা দরকার। তার আগে চলুন একটু ধারণা নিই অনলাইন ক্লাস সম্পর্কে। ক্লাসরুমে যেসব শিক্ষক পাওয়ার পয়েন্টের মাধ্যমে ক্লাস নেন তাদের জন্য অনলাইন ক্লাস করানোয় তেমন অসুবিধা নেই। এপসগুলোয় স্ক্রিন শেয়ারের সুবিধা থাকায় সহজেই পাওয়ার পয়েন্টের মাধ্যমে স্লাইড উপস্থাপন করা যায়। কিন্তু যেসব শিক্ষক ক্লাসে হোয়াইট বোর্ডের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাতেন তাদের জন্য এক বড় সমস্যাই এই অনলাইন ক্লাস। নিরুপায় হয়ে তাদেরকে বিকল্প উপায় বেছে নিতে হচ্ছে। শিক্ষার্থীরাও কতটা সুফল পাচ্ছে এই ব্যবস্থায় সেটি নিয়েও প্রশ্ন আছে। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বলছিলেন, “ভিডিও অফ করে রাখার সুবিধা থাকায় আমরা কি করছি না করছি বা আসলেই ক্লাসে মনোযোগ দিচ্ছি কি না সেটা জানার সুযোগ নেই শিক্ষকদের। ” অনেক শিক্ষার্থীই এই সুবিধা নিয়ে ক্লাসে ঢুকে অন্য কাজে ব্যস্ত রাখছেন নিজেকে, কেউ বা ঘুমিয়েও পড়ছেন! প্রযুক্তির অপব্যবহার তাই ঠিক ক্লাসরুমের পাঠদানের সমকক্ষ করতে পারছে না অনলাইনের পাঠদান পদ্ধতিকে। শিক্ষার্থীদের অবশ্য অভিযোগ আছে ক্লাসের সময় নিয়েও। ক্লাস নেওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের কোনো নির্দিষ্ট সময় ঠিক করা না থাকায় তারা সকাল, বিকাল এমনকি রাতেও ক্লাস নিচ্ছেন। তাদের যুক্তি শিক্ষার্থীরা তো বাসায়ই আছে, তাহলে যে কোনো সময়ই তারা ক্লাস করতে পারে। কিন্তু বাসায় থাকলেও পারিবারিক নানান কাজও থাকতে পারে কিংবা যারা নেটওয়ার্ক পেতে বাড়ির বাইরে গিয়ে ক্লাস করে তাদের জন্যও অসুবিধার কারণ ‘অসময়ের’ ক্লাসগুলো। শিক্ষার্থীরা তাই ক্লাস নেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের সুবিধা অসুবিধার খোঁজ নিতে বলছেন।

ক্লাসের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিতই এসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশন কিংবা ক্লাস টেস্টের মতো মেধা যাচাইয়ের পদ্ধতি রয়েছে। অনলাইনে ক্লাস নেওয়া গেলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পরীক্ষা নেওয়াটা একরকম অসম্ভবই। তাই সেমিস্টার কিংবা ক্লাস টেস্ট – এসব তুলে রাখা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার অপেক্ষায়। এসাইনমেন্ট আর প্রেজেন্টেশনও সীমিত পরিসরে শিক্ষকরা নিতে চেষ্টা করছেন তবে এখানেও বাধার দেওয়াল সেই ইন্টারনেটই। ক্লাসরুমের সুবিধাগুলো অনলাইন ক্লাস দিয়ে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা গেলেও এক্ষেত্রে একেবারেই স্থবির  হয়ে আছে ল্যাবভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম, যেটি শিক্ষার্থীদের সশরীরে উপস্থিতি ছাড়া সম্ভব নয়। তাই অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের বাস্তব কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। তবু সেশন জট এড়াতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং সংশ্লিষ্ট সকলের প্রচেষ্টার ফলাফল সব বাধার পথ এড়াবে- এমনটাই প্রত্যাশা।

লেখক: শিক্ষার্থী, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

করোনা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর