এতগুলো প্রাণের দায় কে নেবে?
৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৯:৩৩
নারায়ণগঞ্জের মসজিদে বিস্ফোরণে অনেক মানুষ হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ২৪ জন। বাকি যে ১৩ জন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন আছেন, তাদের অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এই যে এতগুলো মানুষের প্রাণ গেল, এই দায় কে নেবে?
ঘটনার পর থেকে আমরা যা জানতে পারছি— মসজিদে এসি বিস্ফোরণের কারণে সেখানে আগুন লাগে। পরে জানা গেল, সেখানে গ্যাসের লাইন লিকেজের কারণে গ্যাস বের হতো। সেখান থেকেই এই অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত।
ঘটনার দিকে আরেকটু নজর দিলে বুঝতে পারা যায়, মসজিদটির বর্ধিত অংশ রাস্তার ওপর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এর কিছু অংশের নির্মাণ হয়েছে তিতাস গ্যাসের সঞ্চালন লাইনের ওপর দিয়ে। এসব বিষয়ে কাউকেই কোনো কথা বলতে দেখলাম না। সবাই শুধু সরকারের ওপর দোষ চাপিয়ে দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে চাচ্ছেন। আপনি যখন কোনো একটি স্থাপনা তৈরি করবেন, তখন অবশ্যই আপনাকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে— সেটা নিজের বাড়ি হোক অথবা কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মসজিদ-মন্দিরই হোক।
নারায়ণগঞ্জের মসজিদে বিস্ফোরণের আসল কারণ নিয়ে কেউই কোনো কথা বলছেন না। বিষয়টি খুবই ‘স্পর্শকাতর’ বলেই হয়তো এই বিষয়ে সবাই চুপ!
সবাই তিতাস গ্যাসকে ধুয়ে দিচ্ছেন। অনেকেই বলার চেষ্টা করছেন, গ্যাসের লাইন লিকেজ ছিল এটা তিতাসকে জানানোর পরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কোনো মসজিদে তো গ্যাসের লাইনের দরকার হয় না। প্রথমেই তাই বিষয়টিতে খটকা লেগেছে। কাহিনীটা কী— বোঝার চেষ্টা করেছি প্রথমে।
এখানে দু’টি বিষয় রয়েছে। প্রথমত, মসজিদ কমিটি কেন এমন দায়িত্ব জ্ঞানহীন আচরণ করলো এবং বর্ধিত অংশ রাস্তার ওপর কেন নির্মাণ করতে গেল? দ্বিতীয়ত, তিতাসের সঞ্চালন লাইনের ওপর দিয়ে যখন মসজিদটির বর্ধিত অংশ নির্মাণ হয়েছিল, তখন কি মসজিদ কমিটি তিতাস গ্যাসকে জানিয়েছিল যে তাদের মসজিদের নিচ দিয়ে গ্যাসের লাইন রয়েছে? সেইসঙ্গে আরও একটি প্রশ্ন এসে যাচ্ছে— আপনি নিয়ম-নীতি না মেনে রাস্তার ওপর মসজিদের বর্ধিত অংশ তুলে দিলেন, যেখানে গ্যাসের লাইন রয়েছে। চাইলেই কি সেই লাইন তুলে অন্যত্র সরিয়ে ফেলা সম্ভব?
আরেকটি কথা এখন মসজিদ কমিটি বলার চেষ্টা করছে। সেটা হলো— গ্যাসের লিকেজের কথা তিতাসকে জানানোর পরও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এমন অভিযোগের কথা মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে তিতাসকে জানানোই হয়নি। কারণ ওই মসজিদটি তিতাসের লাইনের ওপর অবৈধভাবে সম্প্রসারিত হয়েছিল। ঘটনা যদি সত্যিও হয় যে তিতাস ঘুষ চেয়েছিল, তারপরও কেন মসজিদ কমিটি এতগুলো মানুষের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেখানে নামাজ পড়ার অনুমতি দিয়ে গেছেন, যেখানে গ্যাসের লিকেজ থেকে গ্যাস বের হয়ে মসজিদের ভেতর বুদবুদের সৃষ্টি হয়েছিল? আপনি যখন দেখবেন এমন বিদপজনক অবস্থায় গ্যাস লিকেজ হচ্ছে, তবু কেন সেখানে মসজিদটি সাময়িকভাবে বন্ধ না করে নামাজ চালিয়ে গেলেন?
সম্পূর্ণ মসজিদটি এয়ারকন্ডিশন্ড করার কারণে ভেতরটা বদ্ধ অবস্থায় থাকত। দরজা-জানালা কাঁচ দিয়ে ঘেরা থাকত। এ অবস্থায় গ্যাসের লিকেজ থেকে ভেতর গ্যাস বের হয়ে এলে গোটা মসজিদটিই একটি গ্যাস চেম্বারে পরিণত হয়। কোনো দায়িত্বশীল মানুষ বা মসজিদ কমিটি একবারও মনে করলো না যে এখান থেকে কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে?
মসজিদ কমিটি সম্পূর্ণ কাজটিই করেছে মানুষের ধর্মীয় অনুভূতির সুযোগ নিয়ে। এভাবে আপনি নিয়ম-নীতি না মেনে গ্যাসের লাইনের ওপর মসজিদ বানাবেন, আবার দুর্ঘটনা ঘটলে তিতাসকেই দায়ী করবেন! এটা কতটা যৌক্তিক?
বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। দুর্ঘটনার ফ্যাক্টচুয়াল কারণ নিয়ে কথা বলুন, যেন ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা না ঘটে। কারণ সারাদেশেই এরকমভাবে নিয়ম-নীতি না মেনে অনেক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ অনেক স্থাপনা গড়ে উঠেছে।
খবরে পড়লাম, বিদ্যুতের যে লাইনটি ছিল ওই মসজিদে, এতগুলো এসি চালানোর মতো সক্ষমতার লাইন সেটি ছিল না। তার ওপর নিম্নমানের তার ও সার্কিটের ব্যবহার এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনাকে ত্বরান্বিত করেছে। ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা প্রতিরোধে বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান যাই নির্মাণ করুন না কেন, যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিয়ম-কানুন মেনে স্থাপনা নির্মাণ করুন। নায়ারণগঞ্জের মসজিদে দুর্ঘটনার পর থেকেই বারবার একটি কথাই মনে হচ্ছে— এতগুলো প্রাণের দায় কে নেবে?
পুরো মসজিদটিই গ্যাসে পরিপূর্ণ ছিল। আগুন লাগার পরও মসজিদের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে গ্যাস বুদবুদ আকারে বেড় হচ্ছিল। যেহেতু এসি চালানোর জন্য মসজিদের জানালা-দরজা সব বন্ধ ছিল, সে কারণেই পুরো মসজিদ গ্যাস চেম্বারে পরিণত হয়েছিল। যেকোন ক্ষুদ্র আগুনেই বড় দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা ছিল। সেই আশঙ্কাকেই সত্যি পরিণত করে ঘটেছে বিস্ফোরণ, যা কেড়ে নিলো এতগুলো মানুষের প্রাণ।
লেখক: নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক। ছদ্মনাম: ডার্ক নাইট।
গ্যাসের লাইন তিতাস গ্যাস নারায়ণগঞ্জে বিস্ফোরণ মসজিদে বিস্ফোরণ মৃত ২৪