Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মৃত্যুতেই কি মুক্তি!


১০ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৫:১০

পৃথিবীর সব থেকে অপছন্দনীয় ও ঘৃণাময় একটা শব্দ আত্মহত্যা, যা বর্তমান সময়ে আমাদের সকলের কাছে খুবই পরিচিত একটা শব্দ। যে শব্দটি প্রতিদিন আমাদের শুনতে হয়। কেননা সকালে ঘুম থেকে উঠে আবার রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত এই সময় টুকুতে দৈনন্দিন পত্রিকার পাতায়, টেলিভিশনের পর্দায় বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অহরহ এই আত্মহত্যার ঘটনাগুলো দেখতে বা শুনতে পাই। যা নিকৃষ্টতম কাজগুলোর মধ্যে আরও বেশি নিকৃষ্টতম কাজ।কিন্তু আমাদের চারপাশে, আমাদের সমাজে, দেশে ক্রমবর্ধমান হারে বেড়েই চলেছে এই আত্মহত্যা। কিন্তু মিলছে না এর সমাধান। উদঘাটন হচ্ছে না যে এই আত্মহত্যার মুল কারণ কি বা কেন এই নিকৃষ্টতম কাজের মাধ্যমে নিজেকে বিনাশ করা। সমাজের একদম নিম্নশ্রেণী থেকে উচ্চশ্রেণী এবং সাত বছর বয়সী শিশু থেকে সত্তর বছর বয়সীসহ সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে যারা অবস্থান করছেন তাদের কেউই বাদ নন এই আত্মহত্যা নামক জঘন্যতম কাজ থেকে। যা একটি সমাজ, একটি দেশ বা একটি জাতির জন্য লজ্জাজনক।

বিজ্ঞাপন

আত্মহত্যা জিনিসটা এতই জঘন্যতম যে, এই আত্মহত্যা সম্পর্কে সকলকে সচেতন করার জন্য পালন করা হয় বিশ্ব আত্মহত্যা বিরোধী দিবস। মূলত বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস একটি সচেতনতামূলক দিন যেটি বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর ১০ই সেপ্টেম্বর আত্মহত্যা প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে বিশ্বের অনেক দেশে ২০০৩ সাল থেকে পালন করা হয়। এই দিবসটি পালন করতে আন্তর্জাতিক আত্মহত্যা প্রতিরোধ সংস্থার সাথে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বৈশ্বিক মানসিক স্বাস্থ্য ফেডারেশন একসাথে কাজ করে। ২০১১ সালে আনুমানিক ৪০টি দেশ এই দিবসটি উদযাপন করে। ২০১৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার করা মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন অনুসারে, বিশ্বের নিম্ন আয়ের কোনো দেশেই আত্মহত্যা প্রতিরোধে কোন কৌশল বা কর্মপন্থা ঠিক করা নেই যেখানে নিম্ন মধ্য আয়ের দেশসমূহের ১০ ভাগ এবং উচ্চ আয়ের সব দেশেই এই প্রতিরোধ ব্যবস্থা রয়েছে। এবং সচেতনতা তৈরির একটি পন্থা যেখানে কেউ কেউ ভালোবাসা সাইন প্রদর্শন করে। কিন্তু তারপরও থেমে নেই আত্মহত্যা।

বিজ্ঞাপন

আমরা একটু লক্ষ্য করলেই দেখতে পারি যে বর্তমান সময়ে আত্মহত্যার পরিমাণটা অনেক গুন বেড় গেছে এবং যেটার কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ এমন নিকৃষ্টতম কাজের সাথে যুক্ত হচ্ছে।সম্প্রতি ঘটে যাওয়া আত্মহত্যার কিছু ঘটনা তুলে ধরছি।

(১) প্রেমের জের ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইমাম ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের আত্মহত্যা।
(২) ৬ সেপ্টেম্বর,গাজীপুরের কাপাসিয়ায় পারিবারিক কলহের জের ধরে মা এবং এক ছেলে বিষপান করে আত্মহত্যা করেছে।
(৩) ৫ সেপ্টেম্বর, সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারে বিষপানে মো. মইজ উদ্দিন (৫০) নামে এক সাবেক ইউপি সদস্য আত্মহত্যা করেছেন।
(৪) ৪ সেপ্টেম্বর, যশোরের শার্শায় বোনের সঙ্গে কথা কাটাকাটির জের ধরে অতিরিক্ত গ্যাস ট্যাবলেট খেয়ে সাবিনা খাতুন (১৭) নামে এক কলেজছাত্রী আত্মহত্যা করেছে।
(৫) ২৯ আগস্ট, রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলায় মায়ের সঙ্গে অভিমান করে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে তৃষা খাতুন (১৬) নামে এক স্কুলছাত্রী।
(৬) ২৭ আগস্ট, ঋণের বোঝা বইতে না পেরে পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলায় জাহিদুল ইসলাম কাইয়ুম (৩০) নামে এক যুবক বিষপানে আত্মহত্যা করেছেন।
(৭) ২৯ আগস্ট, রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে পড়াশোনার জন্য বকা দেওয়াতে অষ্টম শ্রেণীর এক ছাত্রীর গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।
(৮) নেত্রকোনায় তোরাবি বিনতে হক (২১) নামে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) বাংলা বিভাগের এক শিক্ষার্থী প্রেমিকার সাথে ঝামেলা হওয়াতে আত্মহত্যা করেছে।
(৯) ৩ আগস্ট, প্রেমিকার সঙ্গে অভিমান করে আত্মহত্যা করেন প্রেমিক। প্রেমিকের আত্মহত্যার দেড় মাসের ব্যবধানে শোক সইতে না পেরে এবার আত্মহত্যা করলেন প্রেমিকা। ফরিদপুরের মধুখালিতে এ ঘটনা ঘটে। এবং তারা ছিলেন কুয়েট ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

উপরোক্ত আত্মহত্যার চিত্রগুলো খুবই সামান্য। কয়েকটি বাস্তব চিত্র দেখানো হয়েছে। কিন্তু এর আড়ালে রয়ে গেছে হাজারো আত্মহত্যার ঘটনা। যেখানে খুব সহজেই সমাপ্তি ঘটে একটি জীবনের।

প্রত্যেকটি মানুষের আত্মহত্যার পিছে কিছু না কিছু কারণ থেকে যায়। যা আমরা বাইরে থেকে দেখতে পেলেও আত্মহত্যার মুল কারণ কখনও জানতে পারিনা বা তার সাথে কি এমন ঘটেছিলো যে, সে তাকে শেষ করে দিতে দ্বিধাবোধ করলো না। মানুষের জীবনে প্রতিদিন নানারকম ঘটনা ঘটতেই আছে। কখনও সুখ কখনও বা দুঃখ। এই নিয়েই ছুটে চলা অবিরাম। কিন্তু তাই বলে কি মৃত্যুই সব কিছুর সমাধান হতে পারে? পারে না। কেননা আপনার জীবনটার সাথে সংযুক্ত আরও কয়েকটি জীবন। আপনার সাথে জড়িয়ে আছে একটা পরিবার, আপনার সমাজ। আপনি সাময়িক দুঃখ কষ্টকে নিবারক করলেন আপনার আত্মাকে হত্যা করে কিন্তু সব থেকে কঠিন অবস্থায় ফেলে গেলেন আপনার পরিবারকে। কোনো আত্মহত্যাকারী কখনও তার পরিবারের কথা তার বাবা-মায়ের কথা চিন্তা করেনা। যদি তাই করতো তাহলে তাদের দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে দিতো না। এমন তো না যে আত্মহত্যা করলে সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে। সব কিছুর সমাধান হবে! তাহলে কেন আত্মহত্যা!

আত্মহত্যা সম্পর্কিত বা আত্মহত্যাকে কেন্দ্র করে সরকারি-বেসরকারি ও বিভিন্ন  সংস্থা থেকে প্রতি বছরেই জরিপ চলছে। যেমন, সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ পরিচালিত ওই জরিপটির শিরোনাম ‘বাংলাদেশ হেলথ অ্যান্ড ইনজুরি সার্ভে ২০১৬’। এই জরিপ অনুযায়ী, সড়ক দুর্ঘটনা, আত্মহত্যা, পানিতে ডুবে মৃত্যু, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু, ভবন থেকে পড়ে গিয়ে মৃত্যুসহ বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনায় শিকার হয়ে মৃত্যুর ঘটনায় শীর্ষে রয়েছে আত্মহত্যা। দেশের ১৬টি জেলায় পরিচালিত জরিপ থেকে এ তথ্য জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে বিষয়টি নিয়ে তারা আরও গবেষণা করতে চায়।জরিপের তথ্য থেকে জানা গেছে, ২০১৬ সালে ১৭ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার সংখ্যা ছিল প্রতিদিন গড়ে ৩০। ২০০৩ সালে একই সংস্থার জরিপে এই সংখ্যা ছিল ৬ জন। সেই হিসাবে ১৩ বছরের ব্যবধানে ওই বয়সী শিশু-কিশোরদের আত্মহত্যার সংখ্যা বছরে ২,২১৮ জন থেকে বেড়ে হয়েছে ১০,৯২১ জন। জরিপ অনুযায়ী, ২০১৬ সালে পূর্ণবয়স্কদের মধ্যে আত্মহত্যার সংখ্যা ছিল প্রতিদিন ৩৬ জন। এ হিসাবে সারাবছরে আত্মহত্যার মোট সংখ্যা ছিল ১৩,২২৬ জন। এছাড়াও, গত বছর আত্মহত্যার চেষ্টা করে ১৫,৯৮১ জন। জরিপ থেকে জানা যায়, যেকোনো বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার সংখ্যা প্রতি লাখে ১৪ জন। পুরুষদের মধ্যে এই হার ৮ জন, নারীদের মধ্যে ২১ জন। অন্যদিকে, ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সীদের মধ্যে এই সংখ্যা ২৮.৮ জন, ১৫ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের মধ্যে ৪৪.৯ জন, ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে ২৪.৩ জন, ২৫ থেকে ৩৯ বছর বয়সীদের মধ্যে ১৩.৭ জন, ৪০ থেকে ৫৯ বছর বয়সীদের মধ্যে ৩.৪ জন এবং ষাটোর্ধদের মধ্যে ২১.৯ জন।

এদিকে, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও পুলিশ সদর দফতরের হিসেব অনুযায়ী দেশে প্রতিদিন গড়ে ২৮ জন আত্মহত্যা করেন। সে হিসেবে প্রতিবছর দেশে প্রায় ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। বিশ্বব্যাপী আত্মহত্যার পরিসংখ্যান আত্মহত্যার ওপর বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণায় দেখা গেছে, স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চল, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো এবং জাপানে আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি। গত ৫০ বছরে সারা পৃথিবীতে, মূলত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আত্মহত্যার হার শতকরা ৬০ শতাংশ বেড়েছে। বাংলাদেশে পরিচালিত এক গবেষণায় পারিবারিক সমস্যা (৪১.২%), পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া (১১.৮%), বৈবাহিক সমস্যা (১১.৮%), ভালোবাসায় কষ্ট পাওয়া (১১.৮%), বিবাহবহির্ভূত গর্ভধারণ ও যৌন সম্পর্ক (১১.৮%), স্বামীর নির্যাতন (৫.৯%) এবং অর্থকষ্ট (৫.৯%) থেকে রেহাই পেতে আত্মহত্যার চেষ্টা করে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ বলছে, প্রতিবছর প্রায় ১০ লাখ মানুষ আত্মহত্যাজনিত কারণে মারা যান। যা নির্দেশ করে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৪০ জনের মৃত্যু হয় আত্মহত্যা কারণে। পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই মৃত্যুর প্রথম ১০টি কারণের মধ্যে এবং ১৫-৩৫ বছর বয়সীদের মধ্যে প্রথম তিনটি কারণের একটি হলো আত্মহত্যা। এবং ২০১৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর বিবিসির এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় আত্মহত্যার জরিপে বিশ্বের দশম স্থানে আছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের আত্মহত্যা ঘটনা ঘটার পিছে কিছু কারণ আছে। যেমন পারিবারিক কলহ, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া। প্রেমে বাধা, আশানুরূপ ফল না পাওয়া, চাকরি না পাওয়া অভাব-অনটন, যৌতুক, সামাজিকতার নির্যাতন, বাবা-মায়ের অতিরিক্ত শাসন, বেশি আবেগী ইত্যাদি। এবং যারা আত্মহত্যা করে তাদের ভিতরে কিছু লক্ষ্মণ দেখা যায় যেমন: হতাশা, এলোমেলো কথাবার্তা, সবার কাছে মাফ চাওয়া, সব সময় রেগে থাকা ইত্যাদি। তাই আমাদের সকলের উচিত আমাদের পারিবারিক, সামাজিক বন্ধনটা আরও শক্ত করা। একে অপরের খোজ খবর রাখা। সমাজের সকলকে সচেতন করে তোলা। তাহলে ধীরে ধীরে আত্মহত্যার প্রবণতা কমে আসবে। মুছে যাবে আত্মহত্যা নামক শব্দটি।

লেখক: ইমরান হুসাইন
শিক্ষার্থী বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়,ঢাকা।

আত্মহত্যা

বিজ্ঞাপন

বিদেশ বিভুঁই। ছবিনামা-১
২৪ নভেম্বর ২০২৪ ২৩:০০

আরো

সম্পর্কিত খবর