Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রোহিঙ্গা সংকট: বহুপাক্ষিক কূটনৈতিক তৎপরতায় সমাধান খুঁজতে হবে


১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৮:৩৮

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির সেনাবাহিনী দ্বারা জাতিগত নিপীড়ন-নির্যাতনের মুখে লাখ লাখ রোহিঙ্গার বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার তিন বছরপূর্তিতে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের বিষয়টি আবারও গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হচ্ছে। রোহিঙ্গা সংকটের একমাত্র স্থায়ী সমাধান নিরাপত্তা এবং অধিকারসহ তাদের জন্মভূমিতে প্রত্যাবর্তন। রোহিঙ্গাদেরও দাবি, নাগরিকত্ব, কিছু মৌলিক মানবাধিকার এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পেলে তারা মিয়ানমারে ফিরতে রাজি। কিন্তু প্রত্যবাসনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে মিয়ানমার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তাই গত তিন বছরে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার ভিত্তিতে দু’বার প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও দু’বারই প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়।

বিজ্ঞাপন

প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় মিয়ানমার কখনো সহযোগিতামূলক আচরণ করেনি। বাংলাদেশ থেকে প্রেরিত রোহিঙ্গাদের তালিকা যাচাই-বাছাইয়ে কালক্ষেপণ করেছে মিয়ানমার। এবং যাচাই-বাছাইয়ের পর খুব কমসংখ্যক রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়েছে তারা। তারা এটাও জানে যে, রাখাইনের ভীতিকর পরিবেশ সেই মুষ্টিমেয় রোহিঙ্গাকেও ফিরে আসতে নিরুৎসাহিত করবে। তাই দ্বিপক্ষীয় প্রক্রিয়া রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। এক্ষেত্রে মিয়ানমারের অবস্থান স্পষ্ট— চাপের মুখে বাধ্য না হলে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে না তারা। বিশেষজ্ঞরা তাই দ্বিপক্ষীয় প্রক্রিয়ার পাশাপাশি বহুপাক্ষিক কূটনৈতিক তৎপরতার ওপর গুরুত্বারোপ করতে বলেছেন। তারা বলছেন, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বলিষ্ঠ পদক্ষেপ রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

বিজ্ঞাপন

সে জন্য আঞ্চলিক ও অন্তর্জাতিক ফোরামগুলোতে প্রত্যাবাসনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে রোহিঙ্গাদের দাবির বিপরীতে মিয়ানমারের ইচ্ছাকৃত অসহযোগিতার বিষয়টি জোরালোভাবে উপস্থাপন করতে হবে। আন্তর্জাতিক বিচার আদালত, আইসিজের অন্তর্বর্তী আদেশের পর্যবেক্ষণেও উদ্বাস্তুদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টিতে মিয়ানমারের নেতিবাচক ভূমিকার কথা বলা হয়েছে। প্রত্যাবাসনের পরিবেশ সৃষ্টিতে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ বাড়াতে সেই পর্যবেক্ষণ কাজে লাগানোর কূটনৈতিক প্রয়াস চালাতে পারে ঢাকা।

দুঃখজনক ব্যাপার হলো রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমরা আমাদের ঘনিষ্ঠতম প্রতিবেশী ভারতের সমর্থন আদায় করতে পারিনি। আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোতে ভারত মিয়ানমারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিন্দা করা থেকেও বিরত থেকেছে। সম্প্রতি ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের ঢাকা সফরকালে আমাদের পররাষ্ট্র সচিব ইস্যুটি নিরাপত্তা পরিষদে তুলতে অনুরোধ করেছেন এবং ভারতের পররাষ্ট্র সচিব তা করার আশ্বাস দিয়েছেন। উল্লেখ্য, আগামী দুই বছরের জন্য ভারত এ পরিষদের অস্থায়ী সদস্যের দায়িত্ব গ্রহণ করতে যাচ্ছে।

এদিকে নিরাপত্তা পরিষদে চীন ও রাশিয়া মিয়ানমারের ঢাল হয়ে কাজ করছে। তাদের বিরোধিতার কারণে ইতিপূর্বে মিয়ানমারে সংঘটিত সহিংসতার বিরুদ্ধে কোনো নিন্দা প্রস্তাব এবং সংকট সমাধানে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। তবে নিরাপত্তা পরিষদে এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ একেবারে অসম্ভব নয়। প্রত্যাবাসনের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টিতে মিয়ানমারকে প্রাথমিক কিছু ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ সংবলিত প্রস্তাবও যদি পাস করানো যায় সেটাও রোহিঙ্গাদের মাতৃভূমিতে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। তাই চীন ও রাশিয়ার অবস্থানকে নমনীয় করতে জোর কূটনৈতিক তৎপরতা অবশ্যই চালু রাখতে হবে।

২০১৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে প্রত্যাবাসন তরান্বিত করতে একটি নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছিলেন। সম্প্রতি আমাদের পররাষ্ট্র সচিবও জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মিয়ানমারের রাখাইনে নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন প্রত্যাশা করেছেন। রাখাইনে এখনো সহিংসতা অব্যাহত থাকায় সেখানে নিরাপত্তা ও মৌলিক সুবিধা সংবলিত নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠা খুবই জরুরি। রাখাইন রাজ্যের যেসব এলাকায় রোহিঙ্গারা বসবাস করত সেসব এলাকা নিয়ে এক বা একাধিক নিরাপদ অঞ্চল গড়ে তোলা যেতে পারে। এজন্য ভারত, চীন এবং আসিয়ান দেশগুলোসহ আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের উদ্যোগ নিতে হবে বাংলাদেশকে।

রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ে রোহিঙ্গাদের কথা বলাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি এক আন্তর্জাতিক ই-সম্মেলনে বিশিষ্টজনেরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ে উচ্চকণ্ঠ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এর মাধ্যমে ওইসব দেশের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে মতামত গঠনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ানো সম্ভব হবে। এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, চলমান করোনা মহামারির কারণে রোহিঙ্গা ইস্যু অনেকাংশে আন্তর্জাতিক মনোযোগ হারিয়েছে যা পুনরুদ্ধার করা সহায়ক হবে। নিকট অতীতে রোহিঙ্গাদের উচ্চকণ্ঠ হওয়ার দৃষ্টান্ত আছে। গত ডিসেম্বরে আইসিজেতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যা মামলার শুনানির সময় দ্য হেগের শান্তি প্রাসাদের সামনে নানা স্লোগান লেখা ব্যানার-প্ল্যাকার্ড হাতে রোহিঙ্গাদের প্রতিবাদ করতে দেখা যায়।

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সুরক্ষায় আশা জাগানোর ঘটনাও ঘটেছে। গত জানুয়ারিতে অন্তর্বর্তী আদেশে আইসিজে মিয়ানমারে থেকে যাওয়া অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা দিতে এবং গণহত্যার সব সাক্ষ্য-প্রমাণ সংরক্ষণের নির্দেশ দেন। আদালতের নির্দেশ মতো ওই আদেশ প্রতিপালনে দেশটি কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে তার একটি প্রতিবেদন গত মে মাসে পেশ করেছে তারা। আইসিজের অন্তর্বর্তী আদেশে বাস্তুহারা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবেও স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিষয়ে মিয়ানমারের ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতেও একটি মামলা চলমান রয়েছে।

আইসিজের আদেশ বাস্তবায়নের দায়িত্ব প্রধানত নিরাপত্তা পরিষদের। নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যসহ সব দেশকেই আদালতের অন্তর্বর্তী আদেশ অনুযায়ী রাষ্ট্রহীন এসব মানুষের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি ও অন্যান্য মৌলিক অধিকার আদায়ে এবং তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে মিয়ানমারকে সহযোগিতা করার কথা। প্রয়োজনে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে জাতিসংঘের এই সর্বোচ্চ সংস্থাকে। পৃথিবীব্যাপী শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব যাদের সেই নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রগুলো শরণার্থীদের অধিকার রক্ষার চেয়ে নিজেদের স্বার্থকে বড় করে দেখতে পারে না।

লেখক:  শিক্ষার্থী, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ; রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

মিয়ানমার রোহিঙ্গা সংকট

বিজ্ঞাপন

নামেই শুধু চসিকের হাসপাতাল!
২২ নভেম্বর ২০২৪ ২২:০৬

আরো

সম্পর্কিত খবর