Sunday 08 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

হিরো আলম, টিকটিক অপু ও আমাদের সাংস্কৃতিক দেউলিয়াত্ব


২০ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৫:১৬
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমের ব্যবহার নিয়ে আমাদের দেশে বেশ মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। চলতি দশকের শুরু থেকে ফেসবুকের মাত্রাতিরিক্ত জনপ্রিয়তা সমাজের প্রায় প্রতিটি স্তরে একটা প্রভাব রেখে যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যম সিলেটের শিশু রাজন হত্যা, বরগুনার রিফাত হত্যাসহ বহু অপরাধের বিরুদ্ধে ভার্চুয়াল আন্দোলন তুলেছে। বিপরীত ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হিন্দু মন্দিরে হামলা ও রামুর বৌদ্ধ মন্দিরে হামলা হয়েছে ফেসবুকের গুজবের কারণে।

তবে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যম হয়ে উঠেছে বিনোদনের অন্যতম উৎস। বর্তমানে সিনেমা হল ও টিভি নাটকের জায়গা দখল করে নিচ্ছে বিভিন্ন ওয়েব পোর্টাল ও ইউটিউব চ্যানেল। যেহেতু খুব সহজেই ইউটিউব ও ফেসবুকে ভিডিও আপলোড করা যায় ফলে প্রায় সব শ্রেণির মানুষ এখানে নিজেদের বিনোদনমূলক ভিডিও পোস্ট করছে। তবে সব ভিডিও সবার জন্য বিনোদন নয়। সামাজিক, অর্থনৈতিক শ্রেণির মতো সাংস্কৃতিক শ্রেণিও রয়েছে। গ্রামের বা নিম্নবিত্ত মানুষের বিনোদনের খোরাক যোগানো ভিডিও শহুরে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণির কাছে ট্রোলের বিষয়।

বিজ্ঞাপন

আমরা বগুড়ার আশরাফুল আলম নামের যে ব্যক্তিটিকে হিরো আলম নামে চিনি তাকে মূলত ট্রোলের মাধ্যমেই চিনি। চিকন গঠনের কালো, গ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা কোনো লোক হিরো হবে এটা আমাদের শহুরে ও শিক্ষিত শ্রেণির কাছে ট্রোলের বিষয়। অর্থনৈতিক অবস্থান সাংস্কৃতিক পছন্দও ঠিক করে দেয়। হিরো আলম শহুরে শ্রেণির হিরো না হলেও গ্রামের ও দেশের নিম্নবিত্ত মানুষের কাছে সে হিরো। ডিশ ব্যবসায়ী হিরো আলমের সিডি ক্যাসেট দেখে বিনোদন পাওয়া সাংস্কৃতিক শ্রেণির ব্যাপারে শহুরে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণি কিঞ্চিৎই অবগত। আমাদের শহরকেন্দ্রিক যে সাংস্কৃতিক আয়োজন তাও কোনভাবে সে শ্রেণির কাছে পৌঁছাতে পারেনি।

এবার আসি কথিত অপু ভাইয়ের আলাপে। টিকটিক ও লাইকি নামে দুইটি অ্যাপসে ১৫-২০ সেকেন্ডের এক ধরনের ভিডিও বানিয়ে জনপ্রিয় হয়েছে অপু নামে এক কিশোর। ছেলেটির জনপ্রিয়তাকে জন-আলোচনায় তৈরি করেছে কিছু ইউটিউবার। শহরের মধ্যবিত্ত শ্রেণির এই ইউটিউবাররা অপুর চুল, তার হাসি, উচ্চারণ এসব নিয়ে সমালোচনা করতে গিয়ে তাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল দিচ্ছে। তারা বুঝাতে চায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনপ্রিয়তা শুধু শহুরে শ্রেণি ডিজার্ভ করে। নাপিতের দোকানের কর্মচারী অপুর কিভাবে মিলিয়ন ফলোয়ার থাকে! তাই হিরো আলম, অপুরা হচ্ছে তাদের কাছে ট্রোল। এছাড়া রিপনদা নামে গ্রামের যে লোকটির ছন্দ ভিডিও ভাইরাল হয় তাকেও তো তাচ্ছিল্য করে ভাইরাল করা হয়। এসব না হয় পাবলিক পরিসর। কিন্তু সামাজিক নিম্ন-শ্রেণির মানুষের ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যম ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহারও নিয়েও ট্রোল করা হয়।

ওমান প্রবাসী একজন শ্রমিক তার ফেসবুক আইডির নাম দিয়েছিল,‘ আমি নোমান থাকি ওমান’। তার আইডির স্ক্রিনশট নিয়ে নাম নিয়ে ট্রোল করা হলো। যারা ট্রোল করেছে তারা সবাই সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমের শহুরে শ্রেণির অংশ। তারা মনে করেন, সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যম তাদের মতো শহুরে শিক্ষিত শ্রেণির জন্য। যাদের স্ট্যাটাস ও ছবি আপলোডে বেশ ব্যক্তিত্ব থাকে।

এবার আলোচনায় আসা যাক টিকটিক লাইকির অপুরা কিভাবে লাখ ছাড়িয়ে কোটি লোকের কাছে পৌঁছে গেছে। মাত্র ১৫-২০ সেকেন্ডের বিনোদনমূলক ভিডিও তৈরি করে এরা জনপ্রিয় হয়। আরও আশঙ্কার ব্যাপার এখানে বেশিরভাগ ভিডিও আপত্তিকর। কিন্তু সমাজের বড় একটি অংশ এসব দেখছে, পছন্দ করছে। এটার কারণ সুষ্ঠু সাংস্কৃতিক চর্চা আমাদের নেই। মায়েরা এখন ঘুম পাড়ানি গান করে না, দাদিরা শোনায় না রহস্যপুরীর গল্প। পুঁথি শুনে কেউ আর চোখ ভেজায় না। শহুরে শিক্ষিত শ্রেণির বাইরের যে বড় একটি সমাজ রয়েছে সেখানে এই সাংস্কৃতিক শূন্যতা তৈরি হয়ে আছে। আর সে শূন্যতায় জায়গা করে নিচ্ছে অপু আর হিরো আলমরা।

অপুদের সমালোচনাকারীদের অন্যতম অভিযোগ তারা রাস্তা বন্ধ করে শুটিং করছে, আপত্তিকর ভিডিও বানাচ্ছে। কিন্তু শহুরে ইউটিউবারদের আলোচনাটা আমরা আনি না। ইউটিউবে যারা ফানি ভিডিও করে, প্রাংক ভিডিওয়ের নামে রাস্তাঘাটে মানুষকে বিব্রত করে আর সারাদিন নিজেদের চেহারা দেখিয়ে ব্যক্তিগত ব্লগ করে তাদের নিয়ে আপত্তি উঠছে না। তারাও অনলাইনে একে অপরের বিরুদ্ধে বিষদাগার করে। হুমকি-ধমকি , বাইক শোডাউন করে। রাস্তা বন্ধ করে শুটিং করে। তবে এদের সামাজিক শ্রেণি অপু, আলমদের উপরে। ফলে সমাজের উঁচু শ্রেণির অপরাধ আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়।

ইউটিউবে সারাদিন নিজের চেহারা দেখিয়ে ব্লগ করা তরুণরা তাদের ভিডিওতে প্রায়শই বলে, ‘আমরা ই্য়াং জেনারেশনের জন্য করছি, দেশকে রিপ্রেজেন্ট করছি’। তাদের এসব দাবিকে স্বাভাবিক চোখে দেখা আর শুধু অপুদের অপরাধী হিসাবে ভাবা বৈষম্যমূলক, যে সমাজকে আমরা মগজে মস্তিষ্কে ধারণ করে আছি তারই প্রতিফলন।

অপুরা টিকটিক-কেন্দ্রিক কিশোর গ্যাং তৈরি করছে। শহরেও ইউটিউবের লাইক-কমেন্ট-সাবসক্রাইবার রঙিন জীবনে মোহিত হয়ে অনেক তরুণ পড়াশোনা বাদ দিয়ে ডিএসএলআর ক্যামেরা নিয়ে সারাদিন ব্লগ আর শুটিংয়ে মেতে থাকছে। এদের মধ্যে যারা ভাইরাল হতে পারে না তারা একসময় হতাশ হয়ে পড়ে। ততদিনে শেষ হয়ে যায় জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সময়।

অপুরা যা করছে তা সুষ্ঠু সাংস্কৃতিক চর্চা নয়। কিন্তু কিছু কিছু ইউটিবাবের এসব সস্তা ফানি ভিডিও কি সঠিক সাংস্কৃতিক চর্চা? বর্তমানে ইউটিউব বা ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ার জন্য তরুণরা যা করছে তা সত্যিই বিপদজনক। এছাড়া জামা ও গেঞ্জির গায়ে অধুনা আকা বেশিরভাগ ছবিই বাঙালির সংস্কৃতি নয়। পাবজি খেলার নামে তরুণদের বড় একটি অংশ দিনের বেশিরভাগ সময় স্মার্টফোনে ব্যয় করছে। গ্রামের অপু, হিরো আলম বা রিপনদাকে ট্রোল করা শহরের অধিবাসীরা কি জানে তাদের প্রদীপের নিচে কতটা অন্ধকার হয়ে আছে?

একটি মঞ্চ-নাটক দর্শকের দর্শন বদলে দিতে পারে। কিন্তু মঞ্চ-নাটক দেখতে দর্শক নেই। ইউটিউবের ফানি ভিডিও, ব্যক্তিগত ব্লগে মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ হচ্ছে। এটা কি আমাদের সুষ্ঠু সাংস্কৃতিক পরিবেশ নির্মাণ ও চর্চার ব্যর্থতা, না-কি ঠিক সংস্কৃতির গোঁড়ায়ই আমরা পৌঁছতে পারিনি সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে সমাজবিজ্ঞানীদের।

লেখক: শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

অপু হিরো আলম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর