Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিশ্ব রাজনীতির অতীত বর্তমান ভবিষ্যত


২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৪:৩৫

বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে গত শতাব্দী নানা নাটকীয়তা ও  সমীকরণে শেষ হয়েছে। শতাব্দী জুড়ে ছিলো বড় দুইটি বিশ্ব যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ও অর্ধশত বছর ধরে চলেছে দুই পরাশক্তির মধ্যে কথিত ঠাণ্ডা যুদ্ধ। ঠাণ্ডা যুদ্ধের পতনের পর  নব্য উদারবাদী তাত্ত্বিকরা আঞ্চলিক সংগঠনের উপর গুরুত্ব দিয়ে বিশ্ব শান্তি ও সমতা তৈরির স্বপ্ন দেখেন। তবে একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে আমেরিকার টুইন টাওয়ারে ৯/১১ হামলা ও স্যামুয়েল হান্টিংটনের  ক্লাস অব সিভিলাইজেশন তত্ত্ব আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতিবিধি পাল্টে দেয়।

বিজ্ঞাপন

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনায় উদারবাদী তত্ত্বকে আমলে নিয়ে জাতিপুঞ্জ ঘটিত হয়। কিন্তু ২৫ বছরের মধ্যে সংঘটিত হওয়া আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ জাতিপুঞ্জের পতন ঘটায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জয়ী অক্ষ নিজেদের আয়ত্তে নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার সূচনা করে জাতিসংঘ গঠন করে। জাতিসংঘের গঠন প্রায় ৮০টি দেশকে উপনিবেশবাদ থেকে বের হয়ে স্বাধীন হতে সহযোগিতা করে। তবে শতাব্দী জুড়ে অসমতার বৈশ্বিক ব্যবস্থা চালু ছিলো বিশ্বে। ইউরোপ যখন কসমোপলিটান ডেমোক্রেসি প্রতিষ্ঠা করছে তখন আফ্রিকা জুড়ে ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকার চলছে। বিশ্বায়নের যুগেও ইউরোপের নব্য উপনিবেশবাদে আফ্রিকায় এখনো রয়েছে ক্ষুধা আর দারিদ্রতা।

বিজ্ঞাপন

এসব বাস্তবতায় নিউ লিবারেল ইনস্টিটিউশন তাত্ত্বিকরা যখন আন্তর্জাতিক সংগঠন  দিয়ে শান্তির স্বপ্ন দেখছেন তখন সমালোচকরা একে দেখেছেন নতুন উপনিবেশবাদ তৈরির পায়তারা হিসেবে। নব্য বাস্তববাদী তাত্ত্বিক কেনেথ ওয়ালটজ বলেছেন, আন্তর্জাতিক সংগঠনের মাধ্যমে শান্তির পরিকল্পনায় শক্তিশালী রাষ্ট্রসমূহের শক্তির হেজেমনি থাকে, ফলে শান্তির পরিকল্পনা শক্তিশালী রাষ্ট্রের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে বাস্তবায়ন করা হয়।  ওয়ার্ল্ড সিস্টেম থিউরি তত্ত্বের প্রবক্তা ইমানুয়েল ওয়ালারস্টিন রাজনৈতিক অর্থনীতি ও নব্য উপনিবেশবাদকে চিহ্নিত করে দেখিয়েছেন কিভাবে ধনী দেশগুলোর কাঁচামাল ও শ্রমের চাহিদা মেটাচ্ছে দরিদ্র দেশসমূহ। বিশ্বব্যাংকসহ বড় বড় দেশের ঋণের জালে বন্দি হয়ে দরিদ্র থেকে দরিদ্র হচ্ছে তৃতীয় বিশ্ব।

একবিংশ শতকের শুরুতে ২০০৫ সালে ফিলিপ্পি মার্টিন লিখেন তার বিখ্যাত আর্টিকেল মেক ট্রেড নট ওয়ার? এই আর্টিকেল বিশ্ব-রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। ২০০৮ সালে বিশ্বব্যাপী মন্দার পর বৈরি সম্পর্কের দেশসমূহও বাণিজ্য সম্পর্কে জোর দেয়। এই সময়ে জাপানের অর্থনীতির পতন ও চীনের অর্থনীতির উত্থান নতুন এশিয়াকে সামনে আনে। কিন্তু একই সময়ে কথিত আরব বসন্তের উত্থান, চীনের মার্কিন আধিপত্য মোকাবিলায় ব্রিকস গঠন ও দরিদ্র দেশে বিনিয়োগ কূটনীতি ভূ-রাজনৈতিক নতুন সমীকরণ নিয়ে আসে।

কিন্তু সব সমীকরণকে বদলে দিয়েছে কোভিড-১৯ মহামারি। চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্ভাব্য নতুন শীতল যুদ্ধ সময়ের ব্যাপার মাত্র। চীনকে উদ্দেশ্য করে মার্কিন, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জাপান গঠন করেছে সামরিক জোট। কোভিড-১৯ পরিস্থিতির মধ্যে মেডিকেল সহায়তার মাধ্যমে অনেক দেশকে নিজের বলয়ে নিয়েছে চীন। চীনের নেতৃত্বে চীন, রাশিয়া, ইরান, তুরস্ক ও পাকিস্তানের জোট আলোচনায় আছে। বিপরীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বলয়ে আছে ভারত, ইসরাইল, সৌদি আরব ও আরব আমিরাত।  ইসরাইলের বিরুদ্ধে চারবার যুদ্ধে জড়ানো আরবরাই আজ ইসরাইলের নিকট বন্ধু। ইউরোপীয় ইউনিয়নের উপর আগের মতো কর্তৃত্ব নেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। জার্মানি ও ফ্রান্স নিজেরাই পরাশক্তি হয়ে উঠার স্বপ্নে বিভোর। ফলে বহুমেরু বিশ্বের উত্থান হতে যাচ্ছে।

তবে এখনো বিশ্বের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেকোনো সময় বদলে দেওয়ার সক্ষমতা রাখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৯ সালে ৭৩ হাজার কোটি ডলার সামরিক বাজেট করা যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বজুড়ে রয়েছে ৮০০ সামরিক ঘাঁটি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি এখনো সামরিক নির্ভর, অন্যদিকে জাতীয়তাবাদ টিকিয়ে রাখার জন্য তাদের শত্রু দরকার। সন্ত্রাসবাদের যুদ্ধের কথা বলে আফগানিস্তান, ইরাকের মতো গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম দেশ ধ্বংস করেছে। এখন সোভিয়েত রাশিয়া, সন্ত্রাসবাদের যুদ্ধের জায়গা করে নিচ্ছে চাইনিজ ঠেকাও যুদ্ধ। চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশই তাদের সম্ভাব্য শীতল যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি দিয়ে অনেক দেশকে নিজেদের আয়ত্তে নিচ্ছে। চলছে নতুন উপনিবেশবাদ তৈরির মহাপ্রস্তুতি। উপনিবেশবাদের চেহারাও বদলে যাচ্ছে। এখন চিত্র চলছে ‘ভূমি তোমার, সরকার ও সরকারের নিয়ন্ত্রণ আমার’। ইতিমধ্যে সিরিয়া, লিবিয়া ও আফগানিস্তানে সে ধরনের সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এই ব্যবস্থা চলতে পারে আফ্রিকা ও এশিয়ার তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহে।

তবে সামনের দিনে আন্তর্জাতিক রাজনীতি কোন তত্ত্বের ভিত্তি করে এগোবে তা নিয়েও ভাবছেন বুদ্ধিজীবীরা। ঠাণ্ডা যুদ্ধের পতনের পর নিকোলাস ওনোফ তার বই দ্য ওয়ার্ল্ড অব আওয়ার ম্যাকিং-এ উদারবাদী ও বাস্তববাদী তত্ত্বের সমালোচনা করে কনস্ট্রাকটিভ থিউরি বা গঠনমূলক তত্ত্বকে সামনে আনেন। গঠনমূলক তত্ত্বে পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সরকারের ধরন, ইতিহাস ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রভাবের কথা বলা হয়। মূলত রাষ্ট্রের চেয়ে রাষ্ট্রের আচরণ ও হিউম্যান কনসাসনেসকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। বর্তমানে প্রেক্ষিতে গঠনমূলক তত্ত্ব অধিক প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। নতুন বলয় তৈরির ক্ষেত্রে প্রভাব রাখছে দেশগুলোর নিজস্ব নীতি ও নিরাপত্তা উদ্বেগ। আরব দেশগুলো নিজেদের নিরাপত্তার জন্য ইসরাইলের দিকে ঝুঁকছে। ভারত ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নে কাশ্মীর যেমন প্রভাব রাখে ঠিক তেমনি চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে ‘এক চীন নীতি’কে সমর্থন জানাতে হয়। রাষ্ট্রে কেমন শাসক আছে, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি কী তা রাষ্ট্রের নীতি ঠিক করে দিচ্ছে। নেপোলিয়ন, হিটলার বা সাদ্দাম হোসাইন ব্যক্তি হিসাবে বিশ্ব রাজনীতির সমীকরণ বদলে দিয়েছিলো। গর্বাচেভের গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রৈকার নীতিকে সোভিয়েতের পতন ও ঠাণ্ডা যুদ্ধের অবসানের কারণ হিসেবে ধরা হয়। ১৯৭৬ সালে মাও সেতুংয়ের মৃত্যুর পর কুয়া ফেঙের আমলে চীন সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হয়নি। বরং তার নমনীয় পররাষ্ট্রনীতি ও বাণিজ্য সম্প্রসারণের পরিকল্পনার ফলে ভারত ও আমেরিকার কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার হয়।

ফলে বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন বলয় তৈরির প্রাক্কালে রাষ্ট্রে আসীন সরকার ও সরকারের ধরন ঠিক করে দিচ্ছে কে কোন বলয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে সবচেয়ে আলোচিত হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাষ্ট্র আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। নভেম্বরের সে নির্বাচনে কোন ধরনের শাসক পেতে যাচ্ছে হোয়াইট হাউজ তার প্রভাব পড়বে বিশ্ব রাজনীতির সমীকরণে। নভেম্বরের সে নির্বাচনের পর মূলত শুরু হবে বিশ্ব-রাজনীতির নতুন বলয় তৈরির প্রক্রিয়া। নতুন বলয় বদলের ফলে বদলে যেতে পারে শত্রু মিত্রের বর্তমান সমীকরণ, আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা, অন্তঃরাষ্ট্র সম্পর্ক ও আঞ্চলিক সহযোগিতার ধরন। তবে নতুন সমীকরণে আঞ্চলিক সংগঠন বিশেষ করে সার্ক, জিসিসি, ব্রিকস, সাংহাই কর্পোরেশন, ন্যাটোর ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা থাকবেই।

লেখক: শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

ঠাণ্ডা যুদ্ধ বিশ্ব রাজনীতি