ধর্ষণকাণ্ড ও ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের বেসামাল রাজনীতি
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০০:১৫
গেলো ২১শে সেপ্টেম্বর ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক হাসান আল মামুনকে মুল আসামি করে একই সংগঠনের আরও পাঁচ জনের নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের এক ছাত্রী ‘বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ, ধর্ষণে সহায়তা, ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার অপচেষ্টা এবং ভীতি প্রদর্শন’র অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করেন। এছাড়াও একই ছাত্রী পরের দিন ঢাকার কোতোয়ালী থানায় সেই সংগঠনেরই যুগ্ম আহ্বায়ক নাজমুল হাসান সোহাগকে মূল আসামি করে আগের পাঁচ জন সহ নারী নির্যাতন ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আরও একটি মামলা দায়ের করেন। দু’টি মামলাতেই অন্যান্য আসামির সঙ্গে ডাকসুর সাবেক ভিপি ও ছাত্র অধিকার পরিষদের সবচেয়ে বড় মুখ নুরুল হক নুরও অভিযুক্ত। তার বিরুদ্ধে মুল অভিযোগ তিনি উক্ত ঘটনা ধামাচাপা দিতে বাদীকে চাপ প্রয়োগ করেছেন, বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন এবং ভীতি প্রদর্শন করেছেন। ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের কাজ মহামান্য আদালতের। সে কারণে মামলার মেরিট নিয়ে কোনো প্রশ্ন আমি তুলছি না। একইসঙ্গে আমি আশা করব বাদী ও বিবাদী পক্ষ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে বিচারের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করবে।
যখন একটি মামলা করা হয় তখন এটিই স্বাভাবিক যে দুই পক্ষ আদালতে তাদের সমস্যা সমাধান করবে। কিন্তু অত্যন্ত ন্যক্কারজনক হলেও সত্য যে, ডাকসুর সদ্য সাবেক সহ সভাপতি, তারই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী শিক্ষার্থীর (যিনি কিনা তারই সংগঠনের এক কর্মী) দায়েরকৃত ধর্ষণের মতো একটি স্পর্শকাতর মামলার বিরুদ্ধে রাজপথে নেমেছেন। আমরা অতীতেও দেখেছি ক্রিয়াশীল অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের বিভিন্ন স্তরের নেতা কিংবা কর্মী অনেকবার এমন অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন এবং অভিযুক্ত হবার সঙ্গে সঙ্গেই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ ও তদন্ত করা হয়েছে। কিন্তু সম্ভবত এই প্রথমবার কোনো একটি ছাত্র সংগঠনের নেতৃস্থানীয় এতোসংখ্যক নেতা ধর্ষণের মতো একটি অভিযোগে একইসাথে অভিযুক্ত হয়েছেন। সেইসাথে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা তো নেওয়া হয়নি বরং উক্ত সংগঠনের উচ্চপর্যায় থেকে চিরাচরিত সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়েছে ও বিষোদ্গার করা হয়েছে। ঘটনার সপ্তাহখানেক পর যখন আমি এটি লিখছি সেসময় শুনলাম, শুধুমাত্র হাসান আল মামুনকে সাময়িক অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে সেইসাথে একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে। কিন্তু একটি ছাত্র সংগঠন হিসেবে ধর্ষণের অভিযোগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা এবং বাদীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্য কুৎসা রটানোর পর তদন্ত করার কোনো নৈতিক অধিকার কি তাদের আছে? আর বাকি অভিযুক্তদের সাংগঠনিক শীর্ষ পদে রেখে একটি ন্যূনতম তদন্ত প্রক্রিয়াও কি সম্পন্ন করা সম্ভব?
তাদের প্রতিবাদের ভাষা শুনে মনে হচ্ছে কতিপয় ব্যক্তি নয় যেন পুরো দলটিই অভিযুক্ত হয়েছে। যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেই মামলাটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং মিথ্যা তবুও সেটি আদালতেই প্রমাণ করতে হবে। কিন্তু অভিযুক্ত কেউ এখন অবদি সাহসের সঙ্গে বলতে পারেননি যে ঘটনাটি ঘটেনি কিংবা তিনি আইনি লড়াইয়ে নামবেন। বরং ডাকসুর সাবেক ভিপি নুর বলেছেন যে, ‘আমরা এই মিথ্যা মামলা আদালতে নয় বরং রাজপথে মোকাবিলা করবো’। তার এমন বক্তব্য স্পষ্টতই আইনের প্রতি অশ্রদ্ধার শামিল ও একটি ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ।
মোটাদাগে তাদের এমন বেসামাল অত্যুক্তির কারণ হতে পারে দুইটি। প্রথমত, ঘটনাটি মিথ্যা নয় যে কারণে তারা সমূহ বিপদের শঙ্কা দেখতে পাচ্ছেন। দ্বিতীয়ত, যদি এই অভিযোগে তাদের সাজা হয়ে যায় সেক্ষেত্রে সংগঠনটি অনেকটাই নেতৃত্বশূন্য হয়ে যাবে, শিক্ষার্থীদের কাছে জনপ্রিয়তা হারাবে এবং করোনার কারণে এই অজুহাতে ক্যম্পাসে কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবে না। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই তারা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই সম্পূর্ণ সাংগঠনিক শক্তি নিয়োগ করে ঘটনাটিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে চাইবে। যদি তারা তা করতে ব্যর্থ হয় এবং আসলেই আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত হয় তবে শুধু অভিযুক্তরাই নয় বরং সংগঠন হিসেবেও তারা ধর্ষকের দলের তকমা পেতে পারে। কারণ আমরা দেখেছি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মানবতাবিরোধী অপরাধের নির্দেশ দেওয়ায় আদালত কর্তৃক জামাতে ইসলামী দল হিসেবে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত হয়েছে।
শুধুমাত্র এই ঘটনাটিই নয়। কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সংগঠন হলো ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। যেহেতু আন্দোলনটি ব্যাপক জনসম্পৃক্ততা পেয়েছিলো তারই ফলস্বরূপ ছাত্রলীগ, ছাত্রদল ও বাম সংগঠনগুলোকে হারিয়ে দিয়ে ২৮ বছর পর অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনে উক্ত সংগঠন থেকে সহসভাপতি নির্বাচিত হয়। দেশের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রছাত্রীর ভোটে নির্বাচিত হয়ে স্বভাবতই তাদের উচিত ছিলো শিক্ষার্থীদের দাবি আদায়ে সচেষ্ট হওয়া। কিন্তু সেই দিকে তাদের যতটুকু প্রচেষ্টা ছিলো তার চেয়ে ঢের বেশি সময় তারা ব্যয় করেছে যেকোনো ইস্যুতে সরকারবিরোধী বক্তব্য প্রদান এবং মানুষের করুণা আদায়ে।
আমি বলছি না যে তারা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে পারবে না, তবে একজন ছাত্র প্রতিনিধি ও ছাত্র সংগঠনের প্রধানতম দায়িত্ব অবশ্যই ছাত্রদের কল্যাণে কাজ করা যেটি করতে তারা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন। এছাড়াও ডাকসুতে আসার পর থেকেই নূরকে দেখা গিয়েছে প্রকাশ্যে ধর্মভিত্তিক, মৌলবাদী রাজনীতিকে পৃষ্ঠপোষকতা ও তোষণ করতে। সেজন্য গত বছর ২৬ সেপ্টেম্বরে ডাকসু যখন ক্যাম্পাসে ছাত্র শিবিরসহ ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে চায়, সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়ান তৎকালীন ডাকসুতে প্রতিনিধিত্ব করা ছাত্র সংরক্ষণ অধিকার পরিষদের সদস্যরা। নূর কোনো কর্মসূচি ডাক দিলে তার পেছনে ১০ জন সাধারণ শিক্ষার্থীদের না দেখা গেলেও বরাবার ইসলামি শাসনতন্ত্র ও অন্যান্য মৌলবাদী সংগঠনের কর্মীদের দেখা যায়। ইসলামি ছাত্র শিবির প্রকাশ্য রাজনীতি ছেড়ে অনেকটাই গোপনে তাদের কার্যক্রম নিয়ে যাওয়ায় হয়তো ভিপি নূর ও তার সংগঠনের সঙ্গে ছাত্র শিবিরের যোগসূত্র পাওয়া কঠিন, তবে কিছুদিন আগেও রাজু ভাস্কর্যে নূর ক্যাম্পাসসহ সারা দেশে প্রকাশ্যে ছাত্র শিবিরের রাজনীতি ব্যক্তিস্বাধীনতা অবহিত করে বৈধতা চেয়েছেন।
এছাড়াও দেখা যায় ডাকসু ভিপি নুরের বিভিন্ন দূতাবাসে দৌড়াদৌড়ির দৃশ্য; এমনকি যে ভারতবিরোধীতা পুঁজি করে তার রাজনীতি, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের যে কাউকে ভারতের দালাল, র’ এজেন্ট এবং সাম্প্রদায়িক ট্যাগ দিতে কোনো সৌজন্যতাবোধের ধার ধারেন না, তার নিজেরই এসব রাজনৈতিক রেটোরিকের বিপরীতে দেখা যায় নূর ভারতের হাইকমিশনারের সঙ্গে কোনো রাষ্ট্রীয় পদে আসীন না হয়েও সৌজন্যতাবোধের অজুহাত দিয়ে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করতে। স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে কী এমন এজেন্ডা নিয়ে তিনি সেসব দূতাবাসে দূতিয়ালি করতে যান আবার কোন পরিচয়ে এবং কেন তিনি সেসব জায়গায় প্রবেশাধিকার পান? যেই বিরোধী মতের নাম করে তিনি এসব দূতাবাসে প্রবেশের সুযোগ পাচ্ছেন সেগুলো কতটুকু যৌক্তিক কিংবা সংবিধান সম্মত কি-না সে বিষয়ে কোনো আলোচনা, বিশ্লেষণ হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। কারণ ভিন্নমত যদি অন্য দেশের এজেন্ডা বাস্তবায়ন হয়, যা সংবিধান বিরুদ্ধ, তবে সেটি কোনক্রমেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
লেখক: শিক্ষার্থী
আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়