নারীর অবমাননা আর নয়, ধর্ষকের শাস্তি চাই
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৬:২৬
আমরা শিক্ষিত হয়েছি তবে সভ্য নয়। শিক্ষিত এই সমাজে নারীদের সম্মান, অধিকার নিয়ে দু-চার লাইন ভাষণ দেওয়ার মানুষের অভাব নেই, কিন্তু সম্মান রক্ষার প্রশ্ন আসলেই সবাই নীরব। কোথায় নারীর অধিকার? যেখানে নারীরা নিরাপদ নয়। নারীর প্রতি সহিংসতা দিন দিন বাড়ছে। সেই সঙ্গে বেড়ে চলেছে ধর্ষণের হার। আমাদের দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায় এটি একটি আতংকের নাম। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও দুধের বাচ্চা থেকে শুরু করে ৬০-৬৫ বছরের বৃদ্ধাও ধর্ষিত হচ্ছে। প্রতিদিন খবরের কাগজে নারী নির্যাতনের চিত্র দেখতে পাই আমরা। আমরা শুধুমাত্র প্রকাশিত খবরগুলো জানি , লাঞ্ছনার ভয়ে অপ্রকাশ্য থেকে যায় আরও অনেক খবর। আইন রয়েছে, প্রচার প্রচারণা চলছে, কঠোর নিয়মের বেড়াজালের মাঝেও কমছে না এই নির্যাতনের চিত্র। নারীর উন্নয়নে চলছে অনেক কর্মপ্রচেষ্টা, নারী শিক্ষার জন্য নেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন উদ্যোগ তবুও বারবার প্রমাণিত হচ্ছে—নারীরা নিরাপদ নয়।
ধর্ষকের হয় না কোনো দৃষ্টান্তমূলক বিচার, নেই কোনো শাস্তি, কোনো লজ্জা । সব লাঞ্ছনা, অত্যাচার নারীদের সহ্য করতে হয়। আমাদের সমাজ আজও একচোখাই থেকে গেলো, দোষ যতোই পুরুষের হোক ঘুরেফিরে লাঞ্ছিত হতে হয় নারীকে।
স্বাধীন দেশে ধর্ষকেরাও স্বাধীন। তারা ঠিকই সমাজে বাকী সবার মতো লাগামহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে । কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছে নির্যাতিত নারীরা। ভয়ে ভয়ে বেঁচে থাকে তারা, একদিকে সমাজের মানুষের সমালোচনার ভয় অন্যদিকে পশুরূপী কিছু মানুষের নিষ্ঠুর নির্যাতনের ভয়। আর কতো ভয়ে ভয়ে বাঁচবে নারীরা।
‘আমরা নারী,
আমাদের সম্মান কোথায় ?
আমাদের স্বপ্নগুলো কিছু মানুষের লালসায় শেষ হয়ে যায়’।
কোথায় নারীর রক্ষক? নারীরা নীরব । প্রতিবাদ করবে কিভাবে তারা । একটা ধর্ষণের প্রতিবাদ করতে যেয়ে আরও একটা নারী ধর্ষণের শিকার হয়ে যায়। প্রতিবাদ করবে কোন সমাজে, যে সমাজে ধর্ষিতা নারীকে কোণঠাসা করে রাখা হয় নাকি সেই সমাজে যেখানে ধর্ষকেরা স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ায়।
একটা মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে তার মানে সে চরিত্রহীন। কেউ আবার দু-তিন লাইন সান্ত্বনার বানী শুনিয়ে দেয়। ধর্ষণের খবর পেতেই কিছুদিন তোলপাড় হয়ে যায়। সময়ের সাথে সাথে ঠিকই চাপা পড়ে যায় ধর্ষণের ঘটনা। আবার আরেকটি খবর ছাপা হয় , এভাবেই একের পর এক নতুন নতুন খবরের আড়ালে চলে যায় নির্যাতিত মেয়েদের অভিযোগ।
লজ্জা ধর্ষকের হওয়া উচিত— কিন্তু আমাদের সমাজে লজ্জা তো ধর্ষিতার, তার পরিবারের। সমাজ যখন নির্যাতিত মেয়েকে ধর্ষণের শিকার বলে পরিচয় দেয় তখন লজ্জা সেই সমাজের হওয়া উচিত। ধিক্কার সেই সমাজকে যেখানে নারীদের সম্মান নেই, যে সমাজে একজন নারীকে ভোগ্য-পণ্য মনে করা হয়।
‘নীরব থাকো হে নারী
নতুবা
এ সমাজ তোমায় লাঞ্ছিত করতে একটি বারও ভাববে না’।
এটাই এখনকার অবস্থা । কিন্তু আমরা এটা ভাবি না, আজ যে নির্যাতিত হয়েছে সে যেমন কোনো পরিবারের মেয়ে তেমনি কাল আমার পরিবারের কেউ নির্যাতনের শিকার হবে না এমন কোনো নিশ্চয়তা আছে কি?
মেয়েরা ঘরে বাইরে কোথাও নিরাপদ নয়। আমাদের সমাজের মেরুদণ্ড দুর্বল। সমাজের কিছু কটূক্তি নারীদের প্রতিবাদী মনোভাবকে দমিয়ে রাখে । প্রতিবাদ করলেও ন্যায়বিচার করা হয় না । আমাদের মূল্যবোধ কোথায় । ধর্ষকের সঙ্গে একই সমাজে বসবাস করতে পারি কিন্তু নির্যাতিত মেয়েদের জন্য সুস্থ সমাজ দিতে পারিনা।
প্রতিটি নারীর প্রশ্ন— আমরা কি কোনোদিন একটি নিরাপদ সমাজ পাবো না? যেখানে নারীদের খারাপ দৃষ্টিতে নয় বরং সম্মানের চোখে দেখা হবে।
ধর্ষকের উপযুক্ত শাস্তি প্রয়োজন। ধর্ষণের কারণ নিয়ে সমালোচনার অভাব নেই কিন্তু প্রতিবাদ কোথায়? কিছু হীন মানসিকতার পরিচয় দিয়ে চলেছে এসব সমালোচকরা প্রতিনিয়ত। সামাজিকীকরণের একটা বড় প্রভাব রয়েছে এর পেছনে। মূল্যবোধের অভাব, নৈতিক শিক্ষার অবক্ষয় মানুষকে পশুরূপী করে তুলছে, যে পশুদের শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত কারও আপনজন। এমনটা নয় যে এসব অমানবিক নির্যাতন আমাদের চোখের আড়ালে হচ্ছে, সকলের চোখের সামনে ঘটছে এই ঘটনাগুলো। কেউ অসহায়ের সুযোগ নিচ্ছে কেউ আবার প্রভাব ফলাতে ব্যস্ত।
শিশু ধর্ষণ, নিজ পরিবারের দ্বারা ধর্ষণের শিকার, মেয়ের সামনে মাকে ধর্ষণ, চলন্ত বাসে ধর্ষণ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও বাদ নেই। এসব বর্বর নির্যাতনের কথা আমাদের মানবিকতাকে নাড়া দেয় না। নারীদের তাদের ভয় কাটিয়ে উঠতে হবে। ‘আমরা নারী , আমার পারি’। যুগে যুগে নারীদের জন্য নারীরাই সংগ্রাম করে গেছে। তার দৃষ্টান্ত আমরা ইতিহাস ঘাঁটলে পাবো। তাই বদ্ধ ঘরের কোণে পড়ে না থেকে প্রতিবাদ করতে হবে।
নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ একান্তই প্রয়োজন। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। একে অন্যকে দোষারোপ করা বন্ধ করুন। আর কতো নোংরামির দর্শক হয়ে থাকবেন সবাই? বিদ্রোহের বীজ বপন করতে হবে, নারী পুরুষকে সম্মিলিত হয়ে প্রতিবাদ করতে হবে।
ধর্ষক আর ধর্ষিতার সংজ্ঞায়নে কিছু প্রশ্ন ছুড়ে না দিয়ে সমাধানের পথে আসতে হবে। ধর্ষক সমাজের কেউ হতে পারে না। অনেক তো হলো, আর কতো নীরব থাকবে সমাজ-রাষ্ট্র । দেশমাতৃকে রক্ষার জন্য যারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তারা সেই মাতৃত্বের অপমানে আজ নীরব কেন?
আর কত ধর্ষণের খবর ছাপা হলে সরকারের নীরবতা কাটবে। আইনকে কঠোর করতে হবে । অপরাধী কোন দলের সেটা বিবেচনা না করে তার অপরাধের শাস্তি দিতে হবে। আমাদের দেশে আইনের প্রয়োগ সঠিকভাবে হয় না এজন্য ধর্ষকের মনোবল বৃদ্ধি পায়। অপরাধীর জন্য এমন শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে যেন অন্য অপরাধীদের কাছে সেটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে। আমরাই পারি এমন সমাজ গড়ে তুলতে যেখানে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে, তাদের সম্মান অক্ষুণ্ণ থাকবে। আসুন সবাই মিলে এগিয়ে আসি ধর্ষণমুক্ত সমাজ গড়তে।
লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়