বঙ্গবন্ধু’র কনিষ্ঠ পুত্র: না ফুটতেই বৃন্তচ্যুত ফুল
১৮ অক্টোবর ২০২০ ২০:৪৫
আজ ১৮ অক্টোবর শেখ রাসেলের জন্মদিন। ১৯৬৪ সালের এমন এক হেমন্তের মৃদু শিশির স্নাত রাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘর আলো করে পৃথিবীতে পা রাখে কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল (১৯৬৪-১৯৭৫)। হেমন্তে তার জন্ম, কিন্তু ঝরা পালকের মতো অন্তর্ধান ছিল তার নিয়তি। কুয়াশার চাদর নিয়ে তার বেড়ে ওঠা।
পরিবারের অন্য সদস্যদের তুলনায় ভিন্ন এ মানবের জীবন কেটেছিল অনাবিল আনন্দে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ঘাতকরা এই শিশুকেও নির্মমভাবে হত্যা করে। বাঁচানোর জন্য বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে এক কর্মচারী তাকে লুকিয়ে রেখেছিল। রাসেল মনে করেছিল, সে ছোট্ট শিশু, তাকে হয়তো কিছু বলবে না।
এজন্য আতঙ্কিত হলেও ঘাতকদের সামনে সে বের হয়ে আসে। কিন্তু ঘাতকের কালো থাবা ছোট্ট রাসেলকে নির্মমভাবে আঘাত করে। শহিদের খাতায় লিখিত হয় আরও একটি পবিত্র নাম।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন পৃথিবী বিখ্যাত দার্শনিক, চিন্তাবিদ, শান্তি আন্দোলনের সক্রিয় সংগঠক বার্ট্রান্ড রাসেলের ভক্ত। বঙ্গবন্ধুর ওপর তার প্রিয় লেখক দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের প্রভাব ছিল। বার্ট্রান্ড রাসেলকে নিয়ে বেগম মুজিবের সঙ্গে আলোচনাও করতেন। বেগম মুজিব গৃহবধূ হয়েও যে প্রখর রাজনৈতিক প্রজ্ঞাসম্পন্ন হয়ে উঠেছিলেন, তার পেছনেও ছিল বঙ্গবন্ধুরই অবদান। বঙ্গবন্ধুর কাছে শুনে শুনে বেগম মুজিবও হয়ে উঠেছিলেন রাসেলভক্ত। আর সে কারণেই হয়তো কনিষ্ঠ সন্তানের নাম রেখেছিলেন রাসেল। মনে হয়তো প্রচ্ছন্ন আশা ছিল তাদের ছোট ছেলেটিও যদি বার্ট্রান্ড রাসেলের মতো যশস্বী-মনস্বী হয়ে ওঠে।
ছেলেবেলা থেকে বাবা আর বড়ো বোন শেখ হাসিনার সঙ্গে থাকতেই বেশি পছন্দ ছিল তার। বাবা যেখানে যেতেন সেখানেই যাওয়ার জন্য বায়না ধরত।বঙ্গবন্ধুও তাকে কাছে কাছে রাখতেন। বঙ্গবন্ধু যখন জেলে ছিলেন তখন পরিবারের সবার সঙ্গে রাসেলও বাবাকে দেখতে যেত। পরিবারের সবাই যেমন জেলখানাকে বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বাড়ি মনে করতেন তেমনি রাসেলের মনেও তা স্থায়ী হয়ে যায়। ফিরে আসার সময় সবাই চলে আসলেও রাসেল আসতে চাইতো না। বলত, ‘আমি আব্বুর সঙ্গে আব্বুর বাড়িতে থাকব।’
বঙ্গবন্ধুর পরিবারের বাগান শোভিত করে যে পুষ্পকলি মেলেছিল, তা প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই একদল পাষণ্ড সব তছনছ করে দিল। ফুলটি ফুটতে পারল না। সৌরভ ছড়াতে পারল না। শেখ রাসেলের জন্মগ্রহণের সময়টি বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ ইতিহাসের জন্য এবং বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের জন্যও এক গুরুত্বপূর্ণ কাল। বঙ্গবন্ধুর বয়স তখন ৪০। তিনি তখন রাজনৈতিক মঞ্চে আরোহণের জন্য একটির পর একটি সিঁড়ি ভাঙছেন। তার সময়ের অন্য সব বাঙালি নেতার আপসকামিতা-ভীরুতার বিপরীতে তিনি এক আপসহীন সাহসী মানুষ হিসেবে জনগণের কাছে পরিচিত হয়ে উঠছেন। শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু তাকে পরাভূত করতে পারছে না। রাসেলের জন্মের পরের বছরগুলোই বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের প্রকৃত উত্থানপর্ব।
শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘আমাদের পাঁচ ভাইবোনের সবার ছোট্ট রাসেল। অনেক বছর পর একটা ছোট্ট বাচ্চা আমাদের বাসায় ঘর আলো করে এসেছে, আনন্দের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। আব্বা বার্ট্রান্ড রাসেলের খুব ভক্ত ছিলেন, রাসেলের বই পড়ে মাকে বাংলায় ব্যাখ্যা করে শোনাতেন। মা রাসেলের ফিলোসফি শুনে শুনে এত ভক্ত হয়ে যান যে নিজের ছোট্ট সন্তানের নাম রাসেল রাখেন’।
রাসেল শেখ হাসিনাকে ‘হাসুপা’ বলে ডাকত। কামাল ও জামালকে ভাই, আর রেহানাকে আপু। কামাল ও জামালের নাম কখনও বলত না। অনেক চেষ্টা করার পর ডেকেছিলে-‘কামমাল’, ‘জামমাল’। তবে সব সময় ‘ভাই’ বলেই ডাকত তাদের। তার অতি প্রিয় দু’টি সাইকেল এখনো রয়েছে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িটিতে। যে সাইকেল নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটত।
শেখ রাসেলের কোমলমতি মনের উদাহরণ আনতে গিয়ে আরেকটি ঘটনারও উল্লেখ করেন তার প্রিয় হাসুপা। তিনি লিখেছেন, ‘মা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতেন। রাসেলকে কোলে নিয়ে নীচে যেতেন এবং নিজের হাতে খাবার দিতেন কবুতরদের। হাঁটতে শেখার পর থেকেই রাসেল কবুতরের পেছনে ছুটত, নিজ হাতে ওদের খাবার দিত। আমাদের গ্রামের বাড়িতেও কবুতর ছিল। কবুতরের মাংস সবাই খেত। বিশেষ করে বর্ষাকালে যখন অধিকাংশ জায়গা পানিতে ডুবে যেত, তখন তরিতরকারি ও মাছের বেশ অভাব দেখা দিত। তখন প্রায়ই কবুতর খাওয়ার রেওয়াজ ছিল। তাছাড়া কারও অসুখ হলে কবুতরের মাংসের ঝোল খাওয়ানো হতো।… রাসেলকে কবুতরের মাংস দেওয়া হলে খেত না। ওকে ওই মাংস খাওয়াতে আমরা অনেকভাবে চেষ্টা করেছি। ওর মুখের কাছে নিয়ে গেছি, মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে…ওই বয়সে ও কী করে বুঝতে পারতো যে, ওকে পালিত কবুতরের মাংস দেওয়া হয়েছে’।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ভয়াল রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হলে পরদিন হামলার মুখে পড়ে মা’র সঙ্গে রাসেলকেও দেওয়াল চলে যেতে হয়। তারপর দীর্ঘ নয় মাস ধানমন্ডির ১৮ নম্বর বাড়িতে বন্দি থাকতে হয়েছে পাকিস্তানি বাহিনীর পাহারায়। তখন রাসেলের দিনগুলো কেটেছে নিরানন্দে। প্রথমদিকে রাসেল বঙ্গবন্ধুর জন্য খুব কান্নাকাটি করত। তার ওপর ভাই কামাল মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ায় তাকে পায়নি, সেটাও তার জন্য কষ্টকর ছিল। মনের কষ্টে চোখের কোণে সব সময় পানি থাকত তার। তবে ছোট্টবেলা থেকে মনের কষ্ট নিজেই বহন করতে শিখেছিল রাসেল। ১৯৭১ সালে সজীব ওয়াজেদ জয়ের জন্ম হলে বন্দিখানায় তার আনন্দ সঙ্গী জুটেছিল। সারাক্ষণ তার পাশেই থাকত সে। একাত্তরে ঢাকায় বিমান হামলার সময় রাসেল তুলা নিয়ে এসে জয়ের কানে গুঁজে দিত।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন। এয়ারপোর্টে গিয়েছিল পিতাকে আনতে। পোশাকের ব্যাপারে ছোট্টবেলা থেকেই তার নিজের পছন্দ ছিল। বঙ্গবন্ধুর জাপান সফরের সময় রাসেলও সেখানে যেতে পেরে আনন্দে মেতে উঠেছিল। তবে মাকে ছেড়ে কোথাও তার থাকতে খুব কষ্ট হতো। বাইরে পিতার সান্নিধ্যে থেকেও মার কথা মনে পড়লেই মন খারাপ করত। ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে কামাল ও জামালের বিয়ের অনুষ্ঠানে রাসেল ওর সমবয়সীদের সঙ্গে মিলে রঙ খেলেছিল। বিয়ের পর সব সময় ভাবিদের পাশে ঘুরঘুর করত সে। ১৯৭৫-এর ৩০ জুলাই শেখ হাসিনা জার্মানিতে স্বামীর কর্মস্থলে যাওয়ার পর রাসেলের খুব মন খারাপ হয়ে যায়।
শেখ হাসিনা জার্মানি যাওয়ার সময় রাসেলকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু তার হঠাৎ জন্ডিস হওয়ায় শরীর খারাপ হয়ে পড়ে। সে কারণে বেগম মুজিব তাকে আর শেখ হাসিনার সঙ্গে যেতে দেননি। রাসেলকে যদি সেদিন তিনি সঙ্গে নিয়ে যেতে পারতেন, তাহলে তাকে আর হারাতে হতো না। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের নির্মম বুলেটে ক্ষতবিক্ষত করা হয় ছোট্ট রাসেলকে। মা, বাবা, দুই ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী, চাচার লাশের পাশ দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে সবার শেষে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয় শেখ রাসেলকে। তার আগে সে বারবার বলেছিল, ‘মায়ের কাছে যাবো’। তৃষ্ণার্ত হয়ে পানি খেতেও চেয়েছিল। মায়ের কাছে নেওয়ার নাম করেই হত্যা করা হয় শিশু রাসেলকে।
মাত্র ১০ বছর ৯ মাস ২৭ দিনের স্বল্পায়ু জীবন ছিল তার। শেখ রাসেলের জন্মদিনে আমাদের অঙ্গীকার হোক, আর অসহিষ্ণুতা নয়, আর অপরাধীদের প্রশ্রয় বা দায়মুক্তি নয়। বাংলাদেশ হোক সব শিশুর, সব মানুষের নিরাপদ বাসভূমি।
জয় বাংলা।
লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়