রব্বুবিয়াতের নীতি, ইনসানিয়াতের নীতিই ছিল ভাসানীর রাজনৈতিক দর্শন
১৮ নভেম্বর ২০২০ ১৫:১৩
রব্বুবিয়াতের (স্রষ্টার পালনবাদ) নীতি, ইনসানিয়াতের (মানবতাবাদ) নীতিই ছিলো মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক দর্শন ও চর্চা। সৃষ্টিকর্তা যেমন তার প্রত্যেক সৃষ্টির জন্য পক্ষপাতহীনভাবে সমান নিয়ামত দান করেছেন, তেমন ভাসানীও চাইতেন রাষ্ট্রও তেমনি তার প্রতিটা নাগরিকের জন্য সবকিছুর সমান ভাগ-বাটোয়ারা করবে। বাতাসের অক্সিজেন, নদীর পানি, মাটির উর্বরতা, ফলের স্বাদ-গন্ধ— এগুলো সকলের জন্যই সমানভাবে অবারিত। দুনিয়ার সকল সৃষ্টিই একই অক্সিজেন পায়, মানুষও পায়। ধর্ম-লিঙ্গ-ভাষা-বর্ণ-জাতিভেদে অক্সিজেন কম বেশি হয় না। নদীতে একই ঘাটে গোসল করলে সকলের জন্যই ওই নদীর পানি একইভাবে অবারিতই থাকে। চাপকলের পানি হিন্দুর জন্য একরকম আর মুসলমানের জন্য অন্যরকম হয়না; দুজনের জন্যই সুমিষ্ট পানিই বরাদ্দ করেন স্রষ্টা। রব্বুবিয়াত বা স্রষ্টার পালনবাদের সার কথা এটাই। ভাসানীও এমন রাষ্ট্র বিনির্মাণের সংগ্রামই করেছেন আজীবন, যেখানে ধর্ম-লিঙ্গ-ভাষা-জাতি-বর্ণ কোন পরিচয়ই রাষ্ট্রের খেদমত প্রাপ্তির জন্য মুখ্য হবে না। সবার উপরে থাকবে ‘ইনসানিয়াত’। এরচেয়ে বড় সাম্যের কথা, এরচেয়ে বড় ধর্ম আর কী হতে পারে! তারপরও ‘ভেকধারী ও বেবুঝ’ কিংবা ‘পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত’ ‘সমাজবিচ্ছিন্ন উন্নাসিক’ ‘কমিউনিস্ট’রা তাকে ‘মোল্লা’ আর সৃষ্টিকর্তার পালনবাদ বা রব্বুবিয়াতের নীতিবিবর্জিত ‘প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মীয় মৌলবাদী’রা তাকে ‘কমিউনিস্ট’ বলে তিরস্কার করতে ছাড়ে না।
বাংলাদেশের অহংকারী ও সমাজবিচ্ছিন্ন বামপন্থীদের ‘শিক্ষিত পাশ্চাত্য চোখ’ বাংলাদেশের চোখ নয়, উনারা রাশিয়ান কিংবা চাইনিজ চোখ দিয়ে বাংলাদেশকে দেখেছেন, এখনো দেখছেন। সাদাকালো টেলিভিশনের স্ক্রিনে লাল-নীল-সবুজ-হলুদ-বেগুনী রঙয়ের অসমসত্ব মিশ্রণে তৈরি গ্লাসের ভিতর দিয়ে যেমন রঙিন দেখা যায়। কিন্তু ভাসানী এই জনপদের চোখ দিয়ে দেখতেন, ফলে পরিষ্কারভাবে রাজনীতি নির্ধারণ করে সেইমতো চর্চাও করে গেছেন। আর অন্যদিকে পেট্রো ডলারে পুষ্ট, ওয়াহাবি মতবাদের অনুসারী ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলরা স্রষ্টার সৃষ্টিকে ভালো না বেসে ‘স্রষ্টাপ্রেম’ দেখান। যদিও আলুর দাম ৫০ টাকা হলেও স্রষ্টার সৃষ্টি ইনসানের কষ্ট তাদের পীড়িত করে না। নদী মরে গেলে, পাহাড় ধ্বংস হলে, বাতাস বিষাক্ত হলে যে রবের সৃষ্টির পেরেশানি হয়, তার বিরুদ্ধে ওই গোষ্ঠীর তৎপরতা তেমন দেখা যায় না। কিন্তু মওলানা ভাসানী মানুষের পেরেশানিতে কাতর হতেন, হতেন সোচ্চার। ফারাক্কা বাঁধ বিরোধী লংমার্চ তিনি মানুষকে ভালোবেসেই করেছিলেন জালেম শাসনের বিরুদ্ধে।
খুব ছোটবেলায় এতিম হওয়া চ্যাগা মিয়া বিশ্বনেতা মওলানা ভাসানী হয়ে উঠেছিলেন ইনসানিয়াতের জন্য লড়াই করেই। মানুষের প্রতি তার প্রেমই তাকে ঠেলে নিয়ে গিয়েছিলো জিন্দেগীভর সকল লড়াইয়ে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ— প্রতিটা পর্বে ভাসানী ছিলেন মুখ্য নেতৃত্বে। দুই দুইটি রাজনৈতিক দলের তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা; আওয়ামী লীগ ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি। স্বরাজ পার্টি, খিলাফত, কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ইত্যাদি রাজনৈতিক সংগঠনে অবস্থান করেও ভাসানী একজন ধার্মিক ও একইসাথে ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদী নেতা ছিলেন। চিরকাল তিনি শোষকের বিরুদ্ধে এবং শোষিত-অবহেলিত-নিপীড়িত-বঞ্চিতের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, লড়াই করেছেন। ব্রিটিশ শোষক, জমিদার শোষক, পাকিস্তানি শোষক, বাংলাদেশি শোষক, সকল কালের সকল শোষকের বিরুদ্ধেই লড়াই করেছেন শোষিতের নেতা হয়ে।
তিনি বলতেন, ‘শোষকের কোনো জাতি নাই, ধর্ম নাই, দেশ নাই, বর্ণ নাই— তার একমাত্র পরিচয় সে শোষক।’ আর তার বিপরীতে তিনি ধর্ম-ভাষা-লিঙ্গ-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে সকল শোষিতের পক্ষে লড়াই করেছেন রাজনৈতিকভাবে।
আজকের বাংলাদেশে যে শাসন চলছে, তা থেকে নিস্তার পেতে, জুলুমবাজির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রাম গড়ে তুলতে ভাসানীর কাছেই ফিরতে হবে। সেখানেই দিশা, তার দেখানো পথ, তার চর্চিত পথই মুক্তির পথ। একথা ভাসানীর রাজনৈতিক শীষ্য শেখ মুজিবুর রহমানও বুঝতেন। বুঝতেন বলেই ১৯৫৭-তে গুরুকে ছেড়ে গিয়েও আবার ১৯৬৯-এ আবার ফিরতে হয়েছিল তাকে। ভাসানীর শিষ্যত্বই তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ বানিয়েছিল। ভাসানী শিখিয়ে গেছেন— বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য বদলাতে হলে বাংলাদেশি চোখ দিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে দরদ দিয়ে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। ইনসানিয়াতের পক্ষে ইনসাফের রাষ্ট্র কায়েম করতে রব্বুবিয়াতের নীতিতে অগ্রসর হওয়ার বিকল্প নেই। বাংলাদেশের মানুষের শত্রু কে, কে আমাদের মিত্র— তা বুঝতে গেলেও খেয়াল করতে হবে কোন কোন শক্তি ভাসানীকে ভুলিয়ে দিতে চায়, কোন কোন শক্তি ভাসানীর পথে পথ খুঁজে এগিয়ে যেতে চায়।
এই মহান নেতা মওলানা ভাসানীর ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাকে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে সশ্রদ্ধ সালাম জানাই। আপনি বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন মানুষের মুক্তি সংগ্রামে, জালেমের বিরুদ্ধে ইনসানের লড়াইয়ের মধ্যে।